বড় দা
সকাল বেলাতেই বেশ কয়েক বার রতন চেষ্টা করছিলো কল দেবার, নেটের ঝামেলায় কল রিসিভ করার পরও কানেকশন পাওয়া যাচ্ছিলো না। তাই লিখলাম নেট ঠিক হলে কল দিতে। উত্তরে রতন জানালো ঘন্টা খানেক আগে বড় দা মারা গেছে। আমার জ্যাঠাতো দাদা বড় দার বয়েস হয়েছিল আশির উপরে, কয়েক সপ্তাহ আগেই পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে, সবাই বলছিলো হাটাহাটি বেশি না করতে, দূরে না যেতে। কার কথা কে শোনে। আবার কয়েকদিন আগে দোকানে গেছিলো, বৃষ্টির পর পিছল রাস্তায় পরে যায়। কারা যেন দেখে বাড়ি নিয়ে আসে। প্রেসার হাই। ডাক্তার দেখে বলেছিলো হাসপাতালে ভর্তি হতে, রাজি হয়নি। তবে ওটা যে স্ট্রোক ছিল, এ ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না। গত কাল স্ক্যান করা হয় - আজ রিপোর্ট দেবার কথা। এর মধ্যেই এই ঘটনা।
বড় দা আমাদের বারো ভাই আর পাঁচ বোনের বিশাল সংসারে (বাবা-কাকা-জ্যাঠারা চার ভাই মিলে) ভাইদের মধ্যে সব থেকে বড় আর আমি সবার ছোট। আমার জন্মের পর নাকি মা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরে, তাই আমি মানুষ (?) হই বড় দা আর বড় বৌদির কোলে পিঠে। তবে যেহেতু বড় দা কাজের জন্য বছরের অধিকাংশ সময় বাইরে বাইরে থাকতো তাই যত দিন বাড়ি থাকতো বড় দার কাছেই আমার সময় কাটতো। বড় দা তখন যাত্রার দল করতো - নাম ছিল "অম্বিকা নাট্য প্রতিষ্ঠান।" আমাদের গ্রামে এ ছাড়াও "অন্নপূর্ণা" নাম আরও একটি দল ছিল। প্রতি বছর যখন দলের উদ্বোধন হতো, বড় দা বলতো একটা টাকা (কয়েন) নিয়ে আসতে, তাই পোষ্টারে স্বত্বাধিকারীর ওখানে ছোট করে আমার নামটাও লেখা থাকতো।
বড় দা বাড়ি থাকলে আমি তার সাথেই খেতাম একই থালায়। আমাদের জন্য তাই ছিল সাধারণের চেয়ে একটা বড় আকারের থালা। খাবার তৈরী হলেই বড় দা আমাকে ডাকতো বিজন, বিজন বলে চিৎকার করে। আমি যেতাম না। অপেক্ষা করতাম যতক্ষণ না গাধা বলে ডাকছে। কেন যেন ওই ডাক তা আমার পছন্দ হতো তখন। মানে বড় দার মুখে ওই ডাকটা। ওটা বড় দার জন্যই প্যাটেন্ট করা ছিল। দেশে গাধা বলতে বোকাকেই বুঝায়। পড়াশুনা করে হয়তো এখন দেশীয় গাধাত্ব কাটিয়ে ওঠা গেছে। তবে রাশিয়ায় গাধা হলো একগুঁয়েমি, জেদী এ সবের প্রতীক। সেদিক থেকে দেখলে আমি এখনও গাধাই রয়ে গেছি - রাশিয়ান গাধা।
পরে যখন বড় হই, ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি বড় দার সাথে আগের সেই সম্পর্কটা আর ছিল না। বড় দা ছিল অর্থোডক্স টাইপের মানুষ, আওয়ামীলীগের রাজনীতি হয়তো মেনে নিতে পারতো, কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি - ওর বাবারে। একবার তো বললেই "কি সব লেনিন লেনিন করিস। বিদেশী মানুষ। এর চেয়ে কৃষ্ণের নাম নিলেও তো হয়।" আমি বললাম, "বড় দা, কৃষ্ণ নিজেও তো বাঙালী নন।" তার পর তো রাশিয়ায় চলে আসা। বাড়িতে বেড়াতে গেলে দেখা করতাম, কথা হতো। এখনো বাড়িতে ফোন করলে সব সময়ই বড় দা - বড় বৌদি কেমন আছে জিজ্ঞেস করতাম। এখন থেকে আর বড় দার কথা জিজ্ঞেস করা হবে না। তবে সেই যে ভালোবাসা যেটা সারা জীবনই অনুভব করেছি ওনাদের পক্ষ থেকে সেটা থেকে যাবে। হয়তো বা কখনো ভোলগার তীরে হাঁটতে হাঁটতে বড় দার কথা ভাববো, কথা বলবো মনে মনে, যেমনটা প্রায়ই বলি মা বাবার সাথে। মৃত্যতেই জীবন শেষ হয় না, শুরু হয় নতুন জীবন, নতুন বাস্তবতায়, নতুন মাত্রায়। তাই রাশিয়ানরা মৃত্যুর দিনকে বলে দ্বিতীয় জন্মদিন।
দুবনা, ২৯ জুলাই ২০১৬
Comments
Post a Comment