সন্ত্রাসের ভুত

আর্টিজান আক্রমণের পর জঙ্গীদের উৎস সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হচ্ছে - কেন হলো, কে দায়ী - এই সব আর কি? আর আমার মনে পড়ছে ছোটবেলায় বিভিন্ন কাজের কথা - যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার ইট বা আবর্জনা নেয়ার কথা। তখন আমরা এই ইট বা আবর্জনা এক হাত থেকে অন্য হাতে দিয়ে দিতাম - আর এভাবেই ওসব চলে যেত গন্তব্যে। দেশের বর্তমান সন্ত্রাসী পরিস্থিতির দায়ও  সবাই এভাবে একের ঘাড়  থেকে  অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। যদি আমরা ইট বা আবর্জনা নিজে নিয়ে অতি যত্নে পাশের জনের হাতে পৌঁছে দিতাম, এখন সবাই চেষ্টা করছে ঐ দায়টা না নিতে।কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতলে দেখা যাবে এসবের দায়িত্ব আমাদের সবার - পরিবার, স্কুল, কলেজ, পাড়াপ্রতিবেশী, বিরোধীদল, সরকারীদল, প্রশাসন - সবাই আমরা কোনো এ কোনো ভাবে এটাকে ঘটতে দিয়েছি। আর এভাবেই মন্ত্রীর ভাষায় বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো অদৃশ্য সুতায় গাঁথা মালা হয়ে ঐ মন্ত্রী, সরকার, রাজনৈতিকদল, সমাজ - সবার গলায় কলংকের মতো গেথে গেছে।

আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়েছি, এখনো কথায় বার্তায় প্রায়ই পুরোনো সময়ে ফিরে যাই  - অনেকে দেশটা হারিয়ে গেলো বলে আক্ষেপ করে। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের হারিয়ে যাওয়াকে বিশ্বাস করি না - দেশটা বেঁচে আছে আমাদের মধ্যে, আর তার চেয়েও বেশি করে পশ্চিমা বিশ্বে।  সোভিয়েত ব্যবস্থাকে রুখতেই পশ্চিমে একের পর এক গড়ে উঠেছে ওয়েলফেয়ার  স্টেট। এই যে আজ পশ্চিমে মানুষের জীবন যাত্রা এতো উন্নত, তার পেছনেও কাজ করেছে  একই চিন্তা - পুঁজিবাদের মধ্যেও মানুষের জীবনের মান বাড়ানো যায় সেটা প্রমান করার চেষ্টা। সেদিক থেকে দেখলে সোভিয়েত দেশের ৭১ বছরের শারীরিক উপস্থিতি পৃথিবীর বুকে এক বিশাল ছাপ  রেখে গেছে, যেটা কখনো মোছার নয়। তবে  দেশটার যেমন ভালো দিক ছিল, খারাপ দিকেরও  অভাব  ছিল না। আজ পশ্চিমা বিশ্ব তার অনেক খারাপ দিকগুলোই গ্রহণ করছে।

সোভিয়েত দেশ ভাঙ্গায় যে পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি তা বলা যাবে না। দেশে দেশে নষ্ট হয়ে গেছে গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম।এটাতো আমাদের কমবেশি সবারই জানা যে, ব্রিটিশ ভারতে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন রোধ করতেই ইংরেজরা বন্দীদের  মধ্যে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্য বিতরণ করতো, যাতে ওরা সন্ত্রাসী পথ ত্যাগ করে। পরে এরাই গঠন করে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি। শুধু ব্রিটিশ ভারতেই নয় পরে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পরে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদের আন্দোলন। সারা পৃথিবীতেই মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সোচ্চার এইসব কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো এক ধরণের স্যানিটারী কর্ডন হিসেবে কাজ করেছে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন হয় ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়, নয়তো স্তিমিত হয়ে পরে। সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যায় বিভিন্ন শিশু-কিশোর আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

আমার ছোট বেলায় আমাদের গ্রামে খেলাঘর ছিল না। তবে এলাকায় খেলাঘর আর কচিকাঁচার আসর ছিল। কলেজ শেষ করে নিজে গ্রামে খেলাঘর আসর গড়ে তুলি, ঐ সময় এলাকায় একের পর এক গড়ে উঠে খেলাঘর আসর। শক্তিশালী হয় ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী।  ক্ষেতমজুর সমিতি, কৃষক সমিতি, মহিলা পরিষদ - সবাই শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ায়। এটা ১৯৮২-১৯৮৩ কথা। তখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, ধনী-গরীব  নির্বিশেষে,  সব বয়সের মানুষের সুযোগ ছিল বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িত হবার।  আর এটাই তখন অনেককেই সন্ত্রাসের পথে না যেতে সাহায্য করে। তাই বাংলাদেশের বাম ও প্রগতিশীল দলগুলোর সরাসরি দায় না থাকলেও বর্তমানে  সমাজের এই রাডিকালাইজেশনে  তাদেরও যে কিছুটা ভূমিকা বা ভুমিকাহীনতা রয়েছে - সেটা কি  তারা এড়াতে পারবে?

তবে এটা আজকে শুরু হয়নি।  ঐ সময়েই মানে পঁচাত্তরের পর থেকেই  সরকার বাহাদুরদের প্ররোচনায় শিবিরের মতো রগ-কাটা  সংগঠনের আবির্ভাবও ঘটে স্বাধীন বাংলার মাটিতে। ১৯৮১। তখন কলেজে পড়ি। ঐ সময় আলী আকবর নামে ইংরেজির এক শিক্ষক এলেন আমাদের মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে।  এখানে বরাবরই ছাত্র লীগ শক্তিশালী।  ছাত্র দল, জাসদ ছাত্র লীগও দুর্বল নয়।  ছাত্র ইউনিয়ন ভোটে না জিতলেও ছাত্রদের মধ্যে প্রভাব রাখতো। কলেজের অনেক শিক্ষক ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন - প্রগতিশীলদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে দেখতাম তাদের।  তারপর একদিন দেখলাম এই সব শিক্ষকরা রেগুলার নামাজে যেতে শুরু করলেন। আর এভাবেই সেই হাসি খুশি, সদা  ফিটফাট অধ্যাপক আলী আকবর মানিকগঞ্জে  সূচনা করলেন জামাতের রাজনীতি। আমার মনে হয় বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই ঠিক এভাবেই সবার অগোচরে স্কুল কলেজে ঢুকে পড়েছিল জামাতের তথা স্বাধীনতা বিরোধী রাজনীতি। অনেক হয়তো বুঝেও উঠতে পারেননি কিভাবে শান্তলোকেদের মিষ্টিভাষে তারা ধরা পরে গেছেন ধর্মীয় রাজনীতির ইন্দ্রজালে।

এরশাদের পতনের পর, যখন আওয়ামীলীগ, বিএনপি সহ দেশের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো হাতে হাত মিলিয়ে  স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইএ নামে, তখন  একটা সুযোগ ছিল স্বাধীনতার বিরুদ্ধ  শক্তিকে রাজনীতি থেকে নির্বাসন দেবার। বলতে পারেন, বিএনপি স্বাধীনতার পক্ষে কবে থেকে? তবে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক (?) বলার মধ্যে দিয়ে বিএনপি না চাইলেও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়, নিতে হয়।  ঐ সময় বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ট সংসদীয় দল হয়।  তখন যদি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিতো, তাদের হয়তো জামাতের সমর্থন খুঁজতে হতো না।  ভারতে কম্যুনিস্টরা বেশ কয়েক বার কংগ্রেসকে   সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছে সরকারে যোগ না দিয়েও, বিরোধী দল হিসেবে থেকেও। এর পরে তো আওয়ামীলীগ নিজেই জামাতের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিলো। আসলে আদর্শের থেকে ক্ষমতা যখন বড় হয়, তখন এরকম বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় বই কি।

দেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার পর যখন আই এস বা আল-কায়েদা এর দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সেটা উড়িয়ে দিয়েছেন দেশে বিদেশী সংগঠন নেই বলে। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে রিক্রুটের জন্যে  দেশে আসতে  হয়না। বাইরে বসেই ওরা নিজেদের অনুসারীদের এক করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সন্ত্রাসীরা যদি দেশীয় প্রোডাক্ট হয়, সেটা যে আরো কত ভয়ঙ্কর মন্ত্রী কি তা বোঝেন? আর দেশের ভেতরে যাতে সন্ত্রাসী তৈরির কারখানা গড়ে না উঠে তার জন্য কি করছেন ওনারা? এভাবে চললে কিছুদিন পরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে আর বাইরে যেতে হবে না - সেটা কি মনে রাখে আমাদের সুশীল সমাজ।

আমার মনে হয় আমরা সব সময় হীনমন্যতায় ভুগি - আমরা দোষ স্বীকার করতে ভয় বা লজ্জ্যা পাই। যা কিছু বিদেশী, বিশেষ করে আরব দেশী, তাই আমরা লুফে নেই। তবে শারজাহ বা দুবাই হয়ে দেশে যাবার পথে অনেক বাংলাদেশীদের,  যারা আরব দেশগুলোতে শ্রমিকের কাজ করে, কথা  শুনে বুঝেছি ওরা এই আরব  দেশ, এদেশের মানুষ সম্পর্কে কতটা মোহমুক্ত।  আমাদের দেশে যেমন আমাদের নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতির প্রচার প্রোপাগান্ডা থাকা দরকার, তেমনি আরব বিশ্বে আমাদের নাগরিকদের উপর ঘটা বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধেও প্রচার থাকা দরকার। এইযে একাধিক বার সৌদি আরবে আমাদের নাগরিকদের শিরচ্ছেদ করা হলো, সামাজিক নেটওয়ার্কে তা নিয়ে অনেক হৈ চৈ হলেও সরকারি ভাবে সেটা কতটা হয়েছিলো তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। দেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে হলে মানসিক ভাবে স্বাধীন হতে হবে, দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে, তার প্রচার করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, সৌদি আরবে মক্কা-মদিনা অবস্থিত, এর সাথে সৌদি রাজতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই - সৌদি রাজবংশ বা আরব জাতি - এদের ধর্ম ইসলাম, যেমনটা আমাদের দেশের ৯০% মানুষের। আরবে জন্মেছে বলেই তারা ভালো মুসলমান নয় বা বাংলাদেশ জন্ম বলে আপনি খারাপ মুসলমান নন। তাই তাদের কাছ থেকে অন্ধভাবে সব গ্রহণ করার কারণ নেই।  তা ছাড়া হাজারো স্যুট-বুট পরে আমরা যেমন কোনো সময়ই সাহেব (মানে ইউরোপিয়ান) হতে পারবো না, ঠিক তেমনি ভাবেই কোটি টাকা দামের আলখেল্লা পড়লেও আমরা আরব হতে পারবো না। হীনমন্যতা ত্যাগ করুন। ভালো মুসলমান হবার জন্য আরব হবার দরকার নেই, যেটা দরকার সেটা ভালো মানুষ হওয়া। নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন, অন্যদের সম্মান করতে শিখুন, দেখবেন অন্যের সম্মান আর ভালোবাসা পেতে কষ্ট হবে না।

সব শেষে যেটা বলতে চাই, নিজেরা যতদিন না নিজেদের ঘরের ছেলেদের সামলাবেন, নিজেদের ভেতরের দলাদলি, গুলাগুলি বন্ধ না করবেন, ততদিন এই রকম সন্ত্রাসবাদীরা তৈরি হবে এতে অবাক কি? নিজেদের থেকে শুরু করুন, দল-মত নির্বিশেষে যারাই বেআইনি অস্ত্রের ঝংকার তুলে তাদের শাস্তি দিন, যে সব দল, গোষ্ঠী সন্ত্রাস করে বা সন্ত্রাস সমর্থন করে তাদের নিষিদ্ধ করুন, আর সবাই মিলে রাজনীতি আর ভোটের উর্দ্ধে উঠে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, দেখবেন কয়েক মাসের মধ্যে এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে যাবে।

দুবনা, ১৬ জুলাই ২০১৬ 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি