এক দুলালের গল্প



(১)
অনেক দিন আগে এক গাঁয়ে দুলালের জন্ম এখন তাকে আর অজ পাড়াগাঁ বলা যায় না, তবে আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগে এটা অজ পাড়াগাঁই ছিল ঐ সময় আসলে এ অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামই ছিল এ রকমের শুধু মাত্র বড় রাস্তার (হাই ওয়ে) পাশের বা বড় নদীর ধারের গ্রামগুলো এ বিশেষণ মুক্ত ছিল অন্য গ্রামগুলো ছিল সভ্যতার থেকে অনেক দূরে বর্ষাকালে নৌকা পথে সেখানে যাওয়া গেলেও শুকনো মরসুমে নিজের চরণ যুগলই ছিল একমাত্র ভরসা মাঝেমধ্যে ভাগ্য অনুকূলে থাকলে অবশ্য গরুর গাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে সেখানে যাওয়া যেত, তবে সেটা ঘটত কালেভদ্রে এমনই এক অজ পাড়াগাঁয়ে দুলালের জন্ম, বেড়ে ওঠা শিশুকাল তার কেটেছে গাঁ সংলগ্ন বিশাল মাঠের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আর ঐ যে অনেক দূরে যেখানে আকাশটা টুপ করে নেমে এসেছে মাঠের সবুজে, বড় হয়ে সে সেখানে যেতে পারবে কিনা এই ভেবে শীতের শেষে তার সময় কাটত আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠে হলুদ রঙের সর্ষে ফুল দেখে সে সময় সে অবশ্য চোখে সর্ষে ফুল দেখার একটাই মানে জানত – আর তা ছিল মাঠের পরে মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হলদে আর সোনালী সর্ষে ফুলের সোনা ঝরা হাসি আর ভাবত এটাই তার সোনার বাংলা

দুলাল ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে সেময় অবশ্য মধ্যবিত্ত বলতে তাদেরই বোঝান হত যাদের ছিল কিছু জমিজমা বা গ্রামের বাজারে ছোটোখাটো একটা দোকান, দু’ একটা গরু, যে বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাড়ির কাজের ফাঁকে স্কুলে যেত অল্প জমি আর ছোটোখাটো ব্যবসার মত তাদের স্বপ্নগুলোও ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে একটু লেখাপড়া শিখবে, মেয়েদের ভালো পাত্রে বিয়ে হবে, ছেলেরা বড় হয়ে বাড়ির ছোট ব্যবসায়ের দায়িত্ব নেবে যদি ভাগ্যে থাকে কোনমতে বি.. পাশ করবে তখন ছেলে বি.. পাশ মানে এক বিশাল ব্যাপার

দুলালও অবশ্য তখন এসব নিয়ে ভাবত না
ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সম্পর্কে তার তখন কোন ধারণা ছিল না বললেই চলে আসলে ইঞ্জিনিয়ার শব্দটাই সে জানত না অসুখ বিসুখ হলে নিম পাতা, চিরতা বা পাট পাতার জলই ছিল প্রথম ও প্রধান ওষুধ কখনও বা হলুদ বাটা অবস্থা একটু গুরুতর হলে পাড়ার কবিরাজ বা পাশের বস্তির ফকির আসত ঝাড়ফুঁক করতে কালেভদ্রে কয়েক গ্রাম পেরিয়ে আসতেন রেবতী ডাক্তার তার ভাঙ্গা সাইকেলে চড়ে এসেই চাইতেন এক কাপ চা দুলালদের বাড়িতে এমনিতে চা খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না দুলালের মনে হত শুধু মাত্র রেবতী ডাক্তারের জন্যই ওদের বাড়িতে চা রাখা হয় বুড়ো রোগা মানুষটা দুলালের পেটে  কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টা করতেন আসলে ওনার কান থেকে যে নলটা ঝুলত (দুলাল পরে জেনেছে সেটার নাম স্টেথস্কোপ) সেটা শরীর স্পর্শ করা মাত্রই দুলালের সুড়সুড়ি শুরু হত আর ও হেসে একেবারে কুটিপাটি তাই এই ব্যবস্থা কখনও নাড়ি দেখতেন আবার কখনও নিজের জিহ্বা দিয়ে ওর জিহ্বা ছুঁয়ে দেখতেন এতে সিগারেট আর মুখের দুর্গন্ধ সব মিলিয়ে দুলালের সে যে কী অবস্থা! আর সব শেষে ছিল যত রকমের তেতো ওষুধ তাই ডাক্তার কখনই দুলালের মনে দাগ কাটেনি আর যাই হোক দুলাল ডাক্তার হতে চায়নি 

(২)

প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় দুলালের অবসর সময় কাটত পাড়ার ছেলেদের সাথে ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা এসব খেলে ফুটবল যে খেলত না তা নয় তবে পা দিয়ে লাথি মারত বলেই এর নাম ছিল ফুটবল আসলে সেটা বল ছিল না পাড়ার বিধবার বাড়ি থেকে চুরি করা জাম্বুরা বলের অভিনয় করত কখনও কখনও মাঠে যেতে হত গরু চড়াতে, কখনও বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে হত মাঠে বা দোকানে এক কথায় দুলালের শৈশব ছিল গাঁয়ের আর দশটা ছেলেরই মত

হাই স্কুলে পড়ার সময় দুলাল যেন নতুন জগৎ আবিষ্কার করল
হাই স্কুল ছিল গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে, দু’ দুটো ছোট গ্রাম পেরিয়ে এখানে নিজের গ্রামের ছেলেমেয়েরা ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের অনেকেই পড়াশুনা করে এই প্রথম পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি নতুন বন্ধুদের কাছ থেকে দুলাল জানতে পারে নতুন গ্রামের গল্প সেখানকার জীবনযাপন, সেখানকার রাস্তাঘাট নিজের গাঁয়ের মত হলেও তাতে কী যেন একটা রহস্যের গন্ধ ছিল দুলাল তখন বুঝত না আসলে তার জানার সীমানা এভাবে একটু একটু করে বিস্তারিত হচ্ছে, আর নতুন জ্ঞান তাকে আরও নতুন কিছু জানার জন্য আগ্রহী করে তুলছে আসলে বইয়ের বাইরে, স্কুল কলেজের সীমানার বাইরেও যে বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার থাকতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবন চলার পথের পাশে সেটা আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না এটাও মনে হয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার, আমাদের জীবন দর্শনের একটা বিশেষত্ব
হাই স্কুলেই দুলাল ডাক্তারি পেশার মহত্বের সাথে পরিচিত হয় প্রাইমারী আর হাই স্কুলের প্রথম দিকের গরু, বর্ষাকাল এসবের রচনার পর সে এখন জীবনের লক্ষ্য রচনা পর্বে প্রবেশ করেছে শহর থেকে কিনে আনা এক নোট বই পড়ে সে জেনেছে ডাক্তার মানে রেবতী ডাক্তার নয় ডাক্তার মানে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, ডাক্তার মানে গাড়ি-বাড়ি, ডাক্তার মানে ভালো চাকরি বা নিজস্ব প্র্যাকটিস, ডাক্তার মানে মানুষের সেবা করা এক কথায় ডাক্তার মানে গ্রামের ছেঁড়া পাজামা পাঞ্জাবি পরা উসকো খুশকো   চুলের বাউন্ডুলে সমাজসেবী নয়, ডাক্তার মানে নামী দামী, সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সর্বজন শ্রদ্ধেয় সমাজসেবী ঐ বইয়ে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, অ্যাডভোকেটসহ অনেক পেশার কথাই লেখা ছিল, কিন্তু দুলালের কেন যেন ডাক্তারি পেশাটাই মনে ধরল তাই সে তখন থেকেই নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করল আর সে জন্যে যা দরকার, তা ছিল মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করা, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা কারণ সে জানত একমাত্র ভাল রেজাল্ট করতে পারলেই তার মধ্যবিত্ত বাবা ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে ডাক্তারি পড়ানোর রিস্ক নেবেন, নইলে  গ্রামের অন্যান্য দশটা ছেলের মতই তাকেও বি.. পাশ করে বাবার দোকানেই বসতে হবে
দেখতে দেখতে চলে গেল কয়েক বছর
সেকালে জীবনের গতি ছিল এতই মন্থর, এতই ঘটনাবিহীন যে মনে হত চারিদিকে কিছুই বদলায় নি শুধু বাবার মাথায় কিছু পাকা চুল আর উচ্চতায় বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই সে মনে করতে পারত না আসলে আগেই বলেছি যুগটা ছিল ভিন্ন রকমের বর্তমানের ডিজিটাল এরায় ঘুম ভাঙতেই হাতে পাই নতুন জেনারেশনের নতুন ডিভাইস এখন পরিবর্তনের সাথে পাল্লায় মানুষ অনবরত হার মানছে আর সে যুগে পরিবর্তন ঘটত চোখের আড়ালে দুলাল তার নাতিদীর্ঘ জীবনে শুধু একটা ঘটনাই মনে করতে পারে যখন হাজারো মানুষের ঢল নেমেছিল তাদের আদিগন্ত বিস্তৃত সর্ষে ক্ষেতে অজানা মানুষের স্রোত তাদের গ্রামের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল অজানার পথে, জীবনের সন্ধানে তখন গ্রামের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে মিলে মিশে সে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল জনস্রোতে ভেসে আসা এই ছিন্নমূল মানুষগুলোকে এ ছিল ১৯৭১ সালের কথা দুলালের বয়স তখন বড়জোর পাঁচ জীবনে অনেক কিছু ভুলে গেলেও সেদিনের ঘটনা এখনও তার মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে ভাসছে, যেন এই মাত্র তার চোখের সামনে ঘটে গেছে এই ঘটনা
(৩)
স্কুলের পাট শেষ হলে এল কলেজে ভর্তির পালা
রেজাল্ট ভালো করেছিল তাদের স্কুল থেকে এর আগে এত ভালো রেজাল্ট কেউ করেনি বাবার মনে যেটুকু সন্দেহ ছিল, স্কুলের শিক্ষকদের কথায় সেটা ঘুচে গেল ঠিক হল দুলাল এলাকার মফঃস্বল শহরের কলেজে পড়াশুনা করবে কথাটা যত সহজ কাজটা তত সহজ নয় বাড়িতে থাকতে দুলালের জন্য আলাদাভাবে রাঁধতে হয়নি শহরে যাওয়া মানে তার জন্য আলাদা খরচ এ ছাড়া আছে হোস্টেল চার্জসহ আনুষঙ্গিক খরচ তাছাড়া বাড়ি থাকাকালীন দুলাল শুধু খেতই না, সব সময় বাড়ির বিভিন্ন কাজেকর্মে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত সেদিক থেকেও দুলালের শহরে যাওয়া ছিল ওর বাবার উপর শুধু অর্থনৈতিকই নয়, শারীরিক ও মানসিক চাপও তারপরও ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুলালের বাবা একদিন দুলালকে নিয়ে এলেন শহরে দুলাল ইচ্ছা করেই গেল সরকারী হাসপাতালের পাশ দিয়ে গ্রামের টিনের আর শনের কুঁড়েঘরের পাশে হাসপাতালের পুরনো একতলা বিল্ডিংও দুলালের চোখে প্রাসাদের মত মনে হল সে আবার ভাবল ডাক্তারি পেশার কথা শহরের চাকচিক্য দেখে, নিওনের আলোতে দোকানপাট, গাড়ি ঘোড়া দেখে দুলালের বাবাও স্বপ্ন দেখলেন তার ছেলে ডাক্তার হয়ে কীভাবে শুধু তাদের বংশেরই নয়, গ্রামের মুখও উজ্জ্বল করছে    

কলেজেই দুলাল পরিচিত হল ছাত্র রাজনীতির সাথে
বিভিন্ন দলের নেতারা তাকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করল নিজেদের নীতি আদর্শের কথা বোঝাল তবে দুলাল খেয়াল করল যে সবাই ভালো ভালো নীতি আদর্শের কথা বললেও শুধুমাত্র ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা কিছুটা হলে তা মেনে চলে অন্যেরা ভালো ভালো কথা বললেও ব্যক্তিজীবনে তার ধারকাছ দিয়েও যায়না আদর্শ তাদের কাছে শুধুই শ্লোগান তাছাড়া ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা, দুর্বলের পাশে দাঁড়ানো দুলালের সহজাত প্রকৃতি তাই দ্বিধা না করে সে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিল ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ল খেলাঘর, উদীচী এসব সংগঠনের সঙ্গে লেখাপড়াও চলল একই সাথে অভাবনীয় ভালো রেজাল্ট করল সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরের বছর ছাত্র ইউনিয়নের বৃত্তি নিয়ে সে পড়তে এল সোভিয়েত ইউনিয়নে সেটা ছিল ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর এখানেই দুলালের সাথে আমার পরিচয়, বন্ধুত্ব আর সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই এই গল্পের অবতারনা
মস্কো তখনও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের তীর্থভূমি দেশ বিদেশের বিপ্লবীরা এখানেই খুঁজত সমর্থন মস্কোই তাদের পথ দেখাত, বিভিন্নভাবে সাহায্য করত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সে সমস্ত সাহায্যের একটা ছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ছেলেমেয়েদের আধুনিক ও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা, যাতে বিপ্লব পরবর্তী দেশ গড়তে তারা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশ থেকেও প্রতি বছরই সোভিয়েত ইউনিয়নে আসত প্রচুর ছেলেমেয়ে স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে সোভিয়েত দেশের সাথে এক চুক্তি করেন শুনেছি প্রথম ব্যাচগুলোর ছাত্রছাত্রীদের সাথে বঙ্গবন্ধু নিজে দেখা করে তাদের এ ব্যাপারে ব্রিফিং করতেন তবে পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের মতই সোভিয়েত ইউনিয়নও আর বন্ধুর তালিকায় ছিল না তাই সরকারিভাবে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়েই এ দেশে পড়তে আসত এ সময় সিংহভাগ ছেলেমেয়েই আসত সিপিবি, সোভিয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি, ন্যাপ, বাকশাল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক বা গণসংগঠনের মাধ্যমে সরকারী অনুমোদন না থাকায় এসব ছিল বেআইনী, তাই এদের আসতে হত মিথ্যে বলে, যেমন সোভিয়েত দেশে অধ্যয়নরত ভাইবোন বা অন্য কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে বলে ব্যাপারটা ছিল ওপেন সিক্রেট সবাই সব জানত, তারপরেও এটুকু রাখঢাক করে চলত আমি নিজেও যেহেতু মাত্র দুই বছর আগে, মানে ১৯৮৩ সালে সিপিবির স্কলারশিপ নিয়ে মস্কো এসেছিলাম, তাই এসব বেশ ভালভাবেই জানতাম

(৪)
সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া করার কারণে ছোট বড় অনেকের সাথেই আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হত, যেটা দেশে হয়ত সব সময় সম্ভব ছিল না
দুলালের সাথেও আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে আমি আমার এক সহপাঠী বন্ধুর সাথে মেস করে খেতাম ও আসার পরে আমাদের মেসে যোগ দেয় ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ওর দেশে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা জানতে পারি জানতে পারি ওর স্বপ্নের কথা যেহেতু দেশে অধিকাংশ মানুষের ধারণা বিদেশে থাকা মানেই অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করা, তাই ওর মধ্যবিত্ত পরিবারও আশা করত দুলালের সাহায্যের সেই স্বল্প স্টাইপেন্ড থেকে কিছু কিছু টাকা বাঁচিয়ে ও চেষ্টা করত বাড়িতে পাঠাতে পড়াশুনাও করত মনোযোগ দিয়ে এখানে বলে রাখা ভালো যে দুলাল যখন মস্কো আসে ওর সাবজেক্ট ছিল এগ্রিকালচার তাই আসার পর থেকেই ওর একান্ত চেষ্টা ছিল বিষয় পরিবর্তন করে মেডিসিনে চলে যাওয়া এটা করার জন্যে দরকার ছিল ভালো পড়াশুনা, ভালো রেজাল্ট ওর নিজের আর ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দুলাল মেডিসিনে ভর্তি হয় নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আরও একটু এগিয়ে যায় 

বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় সবার মতই দুলালও অবাক হয়ছিল মস্কোর রাস্তাঘাট, লোকজন দেখে
এই উঁচু উঁচু বসত বাড়ি, এই প্রশস্ত আর ঝকঝকে রাস্তাঘাট, মেট্রো, ট্রামে-বাসে-ট্রেনে বই বা খবরের কাগজে মুখ গুঁজে থাকা মানুষজন সবই ছিল অবাক করার মত কারো কোন তাড়া নেই কী এক প্রশান্তির ভাব সবার চোখে মুখে এ যেন এক অন্য বিশ্ব খারাপ কিছু যে ছিল না তা নয় তবে সে বুঝেছিল মানুষ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে নয় ভাল মন্দ সব মিলিয়েই সমাজ তাই যেকোনো সমাজে ভালর পাশাপাশি মন্দও থাকবে সেটাই স্বাভাবিক আসল কথা এই ভাল মন্দের অনুপাত তখনও পেরেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তের উত্তাল হাওয়া সোভিয়েত ব্যবস্থাকে দোলা দিতে পারেনি তবে পরিবর্তনের হাওয়া এরই মধ্যে বইতে শুরু করেছে

দুলাল অন্য দশটা মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রীর মতই ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছিল
আমি নিজে পড়তাম ফিজিক্সে ক্লাসের পরে লাইব্রেরীতে বসে হোম টাস্ক করে যেতাম বন্ধুদের বিরক্ত করতে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই ড্রয়িং নিয়ে ব্যস্ত থাকত নিজেদের রুমে তবুও ওদের সাথে ভালই আড্ডা হত কিন্তু ডাক্তারদের কথা ভিন্ন ওরা সব সময় মুখ গুঁজে বসে থাকত বইয়ের পাতায় আড্ডায় বসলেও যদি দুই মেডিক্যালের ছাত্র একসাথে হত তাহলেই হল ক্লাসের বাইরে আর কোনই কথা নেই ওদের তবে এটাও ঠিক, যদি আমাদের মাঝে মধ্যে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিল সেটা ওদের ছিল না মোটেই ফলে ওদের গ্রুপগুলোর পরিবেশ ছিল বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ওরা গ্রুপে জন্মদিন বা অন্যান্য উৎসব পালন করত, কখনও গ্রুপের সবাই মিলে বেড়াতে যেত আমাদের গ্রুপ ছিল শুধুই নামে সবাই ছিলাম ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট, মানে যার যার তার তার তার মানে এই নয় যে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল না, তবে সেটা একেবারেই ভিন্ন ধরণের যারা একসাথে কোন এক্সপেরিমেন্টে জড়িত তাদের কথা ভিন্ন, কিন্তু থিওরিতে যারা পড়ে তাদের মধ্যে কালেক্টিভ কাজকর্মের টেন্ডেন্সি কম হতে পারে কোন ক্লাস বা গ্রুপ কতগুলো ইন্ডিভিজুয়ালের সমষ্টি হবে নাকি সত্যিকারের কালেক্টিভ হবে সেটা নির্ভর করে কাজের ধরণ বা সাব্জেক্টের উপর   ঐ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে ভালো চায়ের অভাব ছিল দেশ থেকে আর কলকাতা থেকে আমি প্রায়ই চা পেতাম তাই আমার গ্রুপমেটরা আমার রুমে আসত সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডায় তবে আমাদের আড্ডার গল্প ছিল ক্লাসের বাইরের কখনও ফটোগ্রাফি, কখনও সিনেমা, কখনও বই, কখনও মিউজিক আবার কখনও ফুটবল বা আইস হকি নিয়ে কথা হত আমার রুমমেট আর আমি দু’জনেই এসব পছন্দ করতাম, যদিও আমাদের প্রিয় গ্রুপ বা টিম ছিল ভিন্ন ভিন্ন যেমন ও বিটলসের ভক্ত ছিল আর আমি পিঙ্ক ফ্লয়েডের ও ৎসেএসকেআ-এর সাপোর্টার আর আমি স্পার্তাকের

(৫)

ফিরে আসি দুলালের কথায়
পড়াশুনার চাপ থাকলেও ওর বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ ছিল তাই ও প্রায়ই আমার সঙ্গী হত আমার ছিল ছবি তোলার শখ ওকে নিয়ে  যেতাম মস্কোর বিভিন্ন প্রান্তে; ঘুরতাম, ছবি তুলতাম কখনও যেতাম মিউজিয়ামে শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখতে, কখনও থিয়েটারে যাকে বলে জীবনকে যতটুকু উপভোগ করা যায়, ক্লাসের বাইরে জীবন থেকে যতটুকু শেখা যায় সেটা করার চেষ্টা করতাম এই ঘরাফেরার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের স্বপ্নের কথা বলতাম, বলতাম দেশে গিয়ে কে কি করব, কীভাবে সমাজতন্ত্রের দেশে পাওয়া শিক্ষাকে দেশের কাজে লাগাব, কীভাবে নিজেরাও হব সমাজতন্ত্রের সৈনিক আমাদের সে স্বপ্নে নিজেদের ভবিষ্যতের চেয়ে দেশের ভবিষ্যতের কথাই বেশি উঠে আসত দেশ থেকে সিপিবির কেউ আসলে দেখা করতাম তাঁদের সাথে, মন দিয়ে শুনতাম তাঁদের কথা দেশে তখন সিপিবির স্বর্ণ যুগ কৃষক সমিতি, ক্ষেত মজুর সমিতি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি গণসংগঠন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে মনে হত মস্কোয় বসেই আমরা দেশে বিপ্লবের গন্ধ পেতাম তারপর এল পেরস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তের দমকা হাওয়া ফরহাদ ভাই মারা গেলেন দেশের বিপ্লবী হাওয়া স্তিমিত হল মস্কোয় আমাদের মধ্যেও দেখা দিলো বিভিন্ন প্রবনতা কাঁচা টাকার প্রবল আকর্ষণে সাম্যবাদের আদর্শের পথ থেকে ছিটকে পড়ল অনেকেই ক্লাসের পড়ার থেকে ডলারের কোর্স, সিঙ্গাপুর থেকে আনা কম্পিউটারের দামের হিসেব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনেকে তখন আমাদের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের মনে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়ে দু’হাতে মস্কোর বাতাসে উড়ে বেড়ানো পয়সা ধরাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হল এটা যে শুধু আমাদের মধ্যে ঘটেছে তা নয় সারা সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে সবাই কমবেশি চেষ্টা করেছে এই স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সরকারী স্টাইপেন্ডে আর দিন চলছিল না এমন কি শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য হলেও প্রায় সবাইকে কিছু না কিছু অতিরিক্ত আয়ের পথ খুঁজতে হয়েছে অথবা দেশে টাকার জন্য লিখতে হয়েছে তবে ঐ সময় কেউ কেউ শুধু টিকে থাকার জন্য টুকটাক ব্যবসা করলেও অনেকেই ব্যবসাকেই তাদের পেশা হিসেবে বেছে নেয় এই অনেকের মধ্যে দুলালও ছিল একজন  

এরপর থেকেই দুলালের সাথে আমার সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু হয় না, আমরা এ নিয়ে কোন তর্ক-বিতর্ক করিনি, কেউ কাউকে এর ভালমন্দ দিক নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করিনি আমাদের পথ দু’ দিকে বেঁকে গেছে আগে আমরা একসাথে অনেক সময় কাটাতাম, অনেক কিছু করতাম এখন সেসবের প্রতি ওর আর আগ্রহ ছিলনা মিউজিয়াম আর থিয়েটারের পরিবর্তে ওর পছন্দ এখন হোটেল আর রেস্টুরেন্ট, কোন বই বা দেশের অবস্থা নিয়ে কথা না বলে ও এখন ব্যবসার কথা বলতে, ডলারের রেট, কম্পিউটারের দাম এসব নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে এক সময় পরস্পরের সংগ আমাদের জন্য যত না আনন্দের তার চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক বলে মনে হতে শুরু করল না, দোষটা ওর নয়, আমারই আমিই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি, যখন সবাই দু’ হাতে পয়সা লুফে নিতে ব্যস্ত, আমি ওদের সঙ্গ দিতে পারিনি অন্যদের প্রতি আমার অবশ্য কোন ক্ষোভ ছিল না, যতটা ছিল দুলালের প্রতি আমার কেন যেন মনে হয়েছে ও কাজটা ঠিক করছে না ও নিজের স্বপ্নটাকে পালিয়ে যেতে দিচ্ছে কে জানে? হয়ত খুব সাদাসিধে ছিলাম আমি আমার কেন যেন মনে হত যে ডাক্তার হতে চায়, সে ডাক্তার হতে চায় ডাক্তার হওয়ার জন্যই, চিকিৎসা করার তাগিদ থেকে, মানুষের সেবা করার আনন্দ থেকে পরে অবশ্য বুঝেছি চিকিৎসা, মানব সেবা এসব থাকলেও ডাক্তারের সামাজিক মর্যাদা, টাকাপয়সা, গাড়ি-বাড়ি এসবও ডাক্তারিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে কম ভূমিকা পালন করে না আর কারো স্বপ্ন যদি টাকাপয়সা, গাড়ি-বাড়ি এসবই হয় তাহলে সেটা যে শুধু ডাক্তারির মাধ্যমেই হতে হবে তেমন তো কোন কথা নেই তবে যেহেতু আমার মনে হয়ছিল দুলাল ডাক্তার হতে চেয়েছিল প্যাশন থেকে, যেমনটা কিনা আমি পদার্থবিদ হতে চেয়েছি, তাই ওর এই পেশা থেকে চলে যাওয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারিনি না, ব্যাপারটা এ নয় যে ও পড়াশুনা বাদ দিয়েছে, তবে ইদানীং কালে ও পড়াশুনাটা করছে অনেকটা দায়সারা গোছের, ঠিক যেটুকু না করলে নয় যেন কোন মতে সার্টিফিকেট হাতে পেলেই হয়ে যায় এভাবেই আমি ওর মধ্যে দেখতে পেয়েছি ভবিষ্যতের একজন সত্যিকারের ডাক্তারের মৃত্যু এটাই আমাকে ব্যথিত করেছে আসলে শুধু দুলালের একার ঘটনাই নয়, এ সময়ে আমাদের অনেকেই, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম, একই সাথে চলাফেরা করতাম, স্বপ্ন দেখতাম দেশে ফিরে দেশের ও দশের জন্য কাজ করার, ধীরে ধীরে নতুন স্রোতে ভেসে যেতে শুরু করে নিজেকে কেমন যেন সমাজচ্যুত মনে হয় ধীরে ধীরে নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিলাম সামাজিক কাজকর্ম থেকে সময় কাটত নিজের থিসিসের কাজ করে, গল্পের বই পড়ে পুরনো বন্ধু ও সহপাঠীদের অনেকেই এর মধ্যে মস্কো ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল ফলে সব মিলিয়ে জীবন হয়ে উঠল বেশ দুর্বিষহ এর মধ্যে ধার দেনাও কম হয়নি আসলে সময়টাই ছিল অন্য রকম কথায় বলে বড়লোকের প্রতিবেশী হলে ইচ্ছা অনিচ্ছায় বড়লোকি চাল দেখাতে হয় আমাদেরও হয়েছিল সেই অবস্থা অনেক সময় এরকম হত কোন বন্ধুর সাথে বেড়াতে গেলাম কোন হোস্টেলে খাওয়া দাওয়া, গল্পগুজব হল তখন ওরা পাব্লিক ট্র্যান্সপোর্টে যাতায়াত করত না অনেক সময় ভদ্রতার খাতিরে নিজেই ভাড়াটা দিতাম আবার এমন হত, হয়ত এই আসছি বলে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল ব্যবসার কাজে বসে থাকতে থাকতে রাত দুপুর তখন আবার বাধ্য হয়ে ট্যাক্সিতে ঘরে ফেরা এভাবেই কিছু ধার হল বন্ধুদের কথায় গেলাম সিঙ্গাপুর কাজ ছিল যাওয়া আসা আর ফেরার পথে ওদের কেনা কোন জিনিসপত্র নিয়ে আসা বিনে পয়সায় দেশটা ঘোরা হত, সাথে কিছু টাকাও দিত কিছু দিন এ টাকায় চলল এর পর বন্ধুদের কথায় গেলাম ইস্তাম্বুল সারাদিন ছবি তুলে সন্ধ্যায় কিছু কেনাকাটি করে মস্কো ফিরলে বন্ধুদের মাথায় হাত ঐ সময় একটা কথা চালু ছিল – লাভে ক্ষতি, মানে খুব খারাপ কিছু হলে লাভটা কম হতে পারে আমিই মনে হয় হাতেগোনা দু’চার জনের একজন যার নাকি সত্যি সত্যি ক্ষতি হয়েছিল পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে আরও একবার সিঙ্গাপুর যাই এবং বন্ধুদের সহায়তায় ধার দেনা শোধ করতে পারি সেই সাথে আরও একটা শিক্ষা পাই সেটা হল আর যাই হোক এসব ব্যবসা আমার জন্য নয় এখানে দুটো কথা বলে নিই আসলে মানুষ যখন তার অভিজ্ঞতার কথা বলে সে সাধারণত দু ভাবে সেটা বলে আপনাকে কোন কাজে অনুপ্রেরনা দিতে চাইলে সে সাধারণত শুধু ভালো দিকটা বলে, আর অনুৎসাহিত করতে চাইলে বলে এ কাজে কষ্টের কথা পরে আমার অনেকের সাথে দেখা হয়েছে যারা মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করেছে যারা ভালো করেছে তারা সবাই সে দেশের সুনাম করে, আইনের কথা বলে, বলে কিছু খারাপ লোক থাকলেও তাকে সবাই ভালবাসত ইত্যাদি যারা ওখানে গিয়ে সব হারিয়েছে তারা সমস্ত দোষ চাপায় সে দেশের মানুষ, আইন আর পরিস্থিতির উপর ঐ সময়ে মস্কোয় টাকা পয়সা ইনকাম করা গেলেও সেটা সবার জন্য ছিল না তার জন্য দরকার ছিল অনেক পরিশ্রম ও রিস্ক নেওয়ার সাহস       
(৬)
এরই মধ্যে দুলাল চলে গেছে শহরে
হোস্টেলে থেকে ব্যবসা করা অসুবিধে তখনও মোবাইল ফোনের যুগ শুরু হয়নি আর ব্যবসা মানেই কম্যুনিকেশন, মানে ফোন, ফ্যাক্স ইত্যাদি তাই শুধু দুলাল নয়, যারা ব্যবসার সাথে সিরিয়াসলি জড়িত হয়ে পড়েছিল  তাদের অনেকেই চলে যায় শহরে তখন মস্কোয় দু ধরণের ব্যবসা ছিল বিদেশিদের জন্য একটা ছিল সিঙ্গাপুর থেকে কম্পিউটার, ফোন, ফ্যাক্স, প্রিন্টার, স্ক্যানার ইত্যাদি ইলেকট্রনিক সামগ্রী বা তুরস্ক থেকে বিভিন্ন রকমের পোশাক এনে  বিক্রি করা আরেকটা ছিল ডলার কেনাবেচা সোভিয়েত সমাজে ব্যবসা মানেই ছিল কালোবাজারি বা স্পেকুলেশন যদিও এর মধ্যে ব্যবসার আইনকানুন শিথিল করা হয়েছিল  কিন্তু সাধারণ মানুষ তখনও এসব কাজ খুব ভালো চোখে দেখত না আসলে কোনটা আইনি আর কোনটা বেআইনি তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের কনফিউশন ছিল যার সুযোগ নিত পুলিশ, কাস্টমসের লোকজন আর বিভিন্ন স্তরের আমলারা   খোলা বাজার অর্থনীতির আগমনে তখন এ দেশের মানুষের, বিশেষ করে বৃদ্ধ/বৃদ্ধাদের, অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয় তাই অনেকেই নিজের ফ্ল্যাটের একটা রুম ভাড়া দিতেন এখানে থাকত ফোনের সুবিধা অনেকে সে সময় বিয়েও করে এ দেশে ব্যবসায়ের বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্যে শহরে বাস করার ফলে এর পর দুলালের সাথে আর দেখা হয়নি মাঝে কার মুখে যেন শুনলাম, ও ফ্ল্যাট কিনেছে বিয়েও করেছে মস্কোর বাংলাদেশীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী ও তখন মস্কোয় বিদেশি গাড়ি তেমন একটা দেখা যেত না যাও ছিল তা ভলভো, মার্সিডেজ এসবের মধ্য সীমাবদ্ধ তাই নতুন মডেলের কোন গাড়ি কেউ কিনলে সেই খবর যাকে বলে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যেত এভাবেই কানে এল দুলালের খুব নামকরা একটা মডেলের গাড়ি কেনার কথা

এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেল
পেছনে পড়ে রইল কোটি কোটি মানুষ হারিয়ে যাওয়া সেই দেশের স্মৃতি বুকে করে সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা, পেছনে ফেরার পথ নেই কত স্বপ্ন যে সেই আগস্টে উল্কাপাতের মত ঝরে পড়েছিল কে জানে! একই সাথে নতুন স্বপ্নে, নতুন আশায় বুক বাঁধছিল হাজারও মানুষ আজ পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারা কষ্টকর ভাঙ্গা গড়ার সেই হিসেবে কে জিতল আর কেই বা হারল     

১৯৯৩ সালে আমি থিসিসের কাজ শেষ করি ১৯৯৪ সালে কাজ নিয়ে চলে যাই মস্কোর অদূরে দুবনা নামে ছোট্ট এক শহরে মস্কোয় থেকে যায় আমার ফ্যামিলি সে সময় মস্কো আসতাম ছুটির দিনে, ব্যস্ত থাকতাম সংসার নিয়ে কালেভদ্রে যেতাম বন্ধুদের আড্ডায় এরকম এক আড্ডায় শুনলাম দুলালের ব্যবসায় সমস্যার কথা আসলে তখন সবাই ছিল সমস্যা জর্জরিত ছাত্রজীবনে প্রায় সবাই একসাথে শুরু করেছিল ব্যবসা তখন টাকা পয়সার চেয়েও বড় পুঁজি ছিল পরিশ্রম, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস তখনও ব্যবসায়িক পার্টনাররা ছিল একে অন্যের কমরেড কিন্তু ক্যাপিটাল যখন বাড়তে শুরু করল টান পড়ল বন্ধুত্বে, বিশ্বাসে কে কাকে আগে ঠকাবে এটাই ছিল দেখার বিষয় এভাবে কত লোকের ব্যবসা যে লাটে উঠল, কতজন যে পথে বসল তার হিসাব কে রাখে! শুনলাম দুলালের সাথেও এরকম কিছু ঘটেছে ১৯৯৬ সালে আমার ফ্যামিলি দুবনা চলে আসে, তাই মস্কো আর যাওয়া হত না যদিও অনেকের সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম, সেটা বিভিন্ন কারণে তেমন প্রম্পট ছিল না ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মস্কোয় আসা হত কালেভদ্রে বাংলাদেশী বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হত আরও কম তখন কার কাছে যেন শুনলাম দুলাল রাশিয়া ছেড়ে চলে গেছে কেউ বলল মালয়েশিয়া কেউ বলল সিঙ্গাপুর এক সময় দুলাল সেন্ট পিটার্সবার্গে থাকে বলেও শুনেছি কিন্তু কোন ভাবেই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি, সে চেষ্টাও করিনি                      
()
২০০৯ সালে আমার ফ্যামিলি মস্কো ফিরে গেলে আবার নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয় পুরনো বন্ধুদের সাথে প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সদস্যদের, তারপর অন্যদের সাথে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া নতুন করে পরিচিত হই মস্কোর বাঙ্গালী সমাজের সাথে আমার ছাত্রজীবনে শুধু ছাত্ররাই আসত এ দেশে, এখন ব্যবসা বা অন্যান্য কাজকর্মে জড়িত মানুষের সংখ্যাই বেশি কেউ কেউ এখানে ছোটোখাটো কোর্স শেষ করলেও অধিকাংশই সে সবের ধার ধারেনি প্রথম থেকেই জড়িত হয়েছে ব্যবসা বা চাকরির সাথে অনেকে আবার এখান থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানোর ইচ্ছে নিয়ে আসে কেউ কেউ এতে সফল হলেও অনেকেই আটকে গেছে রাশিয়ার সীমাহীন প্রান্তরে তবে এটাও ঠিক এখন ব্যবসা আগের মত নেই, অন্যান্য দেশের মতই এখানেও ব্যবসা কঠিন হয়ে গেছে পুরনো বন্ধুদের তেমন কেউ আর নেই অধিকাংশই ফিরে গেছে দেশে, একটা বিরাট অংশ ইংল্যান্ড, ক্যানাডা, অ্যামেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে কেউ কাজ করছে নিজেদের পেশায়, কেউবা অন্য কোন পেশায় চলে গেছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে অনেকের সাথে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে এক কথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও, ছাত্রজীবনে সম্পর্কের টানাপোড়ন থাকলেও আজ সবাই আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রোডাক্ট সেই স্মৃতিকে আগলে রেখে সবাই চেষ্টা করে একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে, একে অন্যের খোঁজ খবর রাখতে     

দীর্ঘ ১৪ বছর পরে আমি দেশে যাই ২০১১ সালে সময়টা মূলত কাটে গ্রামের বাড়িতে শৈশব অন্বেষণে বিগত পঁচিশ বছর আমি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তনই দেখেছি, দেখেছি মহাপরাক্রমশালী একটা বিশাল দেশের ভাঙ্গন একই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যে গড়ার কাজ চলছে,  আমার দেশ, আমার গ্রামও যে আমূল বদলে গেছে সেটা মনে হয়নি আমার ফেলে যাওয়া তরা এখন আর গ্রাম নয়, কলকারখানা, নতুন রাস্তাঘাট এর জীবনে এনেছে শহরের আমেজ এরই মাঝে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি ক্রমাগত হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি কখনও কালীগঙ্গা নদীর তীরে, কখনও বা দক্ষিণের হলুদ বরণ সর্ষে ক্ষেতে এরই মধ্যে ছুটে যাচ্ছি সোভিয়েত ফেরত বন্ধুদের আড্ডায়  গল্পে গল্পে ফিরে যাচ্ছি আশির দশকের মস্কোর রাস্তায়, সেই মিখলুখো মাকলায়া স্ট্রিট, লেনিনস্কি প্রস্পেক্ট, জুবভস্কি বুলভারের প্রগতি প্রকাশনে সেসব আড্ডায়,            সোভিয়েত ফেরত বিশেষজ্ঞদের সংগঠন সাব-এর বাৎসরিক বনভোজনে দেশ বিদেশ থেকে আসা পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়,  দেখা হয় ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতির সাথে কিন্তু দুলালের দেখা মেলে না কোথাও কেউ কোন খবরই দিতে পারে না ওর ব্যাপারে

তিন মাস দেশে কাটিয়ে মস্কো ফিরে আসি
ফিরে নতুন করে চেষ্টা করি দুলালের খবর জানতে এর মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মস্কোয় বসবাসকারী পুরনো বন্ধুদের অনেকের সাথেই দেখা হয়, যোগাযোগ গড়ে ওঠে নতুন করে ওদের কাছে জানতে চাই দুলালের কথা কিন্তু সেই একই কথা – কেউ বলছে ও রাশিয়ায় আছে, কেউ বলছে অন্য দেশে কেউ নিজে দেখেনি, সবই শোনা কথা যত না খবর, তার চেয়ে বেশি গুজব  যেন ছেলেটা সবার জীবন থেকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে  এক সময় খোঁজ নেওয়া বন্ধ হল এভাবেই একদিন দুলাল আমার ভাবনা থেকে উধাও হয়ে গেল
(৮)

২০১৪ সাল
অক্টোবর দেশে গেছি আসলে এবার মূলত গেছিলাম ইন্ডিয়ার বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে নিজের কাজে তার আগে ও পরে দেশে কয়েকদিন থাকা আর কি! দেশে গেলে সময় কাটাই গ্রামে, নিজেদের বাড়িতে সকালে সন্ধ্যায় নদীর তীরে বা মাঠে ঘুরে ছবি তুলি, দুপুর কাটে গল্প করে, বই পড়ে এমনই এক অলস দুপুরে ফোন এল না, নম্বর দেখে চেনার উপায় নেই ফোন ধরতেই ওদিক থেকে শোনা গেল
- বিজন দা, কেমন আছেন?
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল এ তো দুলালের কণ্ঠস্বর এর আগে কখনও ওর সাথে টেলিফোনে কথা হয়নি তাই একটু সন্দেহ হল তবুও জিজ্ঞেস করলাম     
-   দুলাল? তুমি কোত্থেকে?
-   চিনতে পেরেছেন তাহলে?
-   না পারার কি আছে? আমি অনেককে তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি কেউ বলতে পারেনি তুমি আমার নম্বর কোথায় পেলে?
-   আমি ফেসবুকে আপনার আসার খবর আর নম্বর পেয়েছি আপাতত ঢাকায় আছি আপনি কোথায়?
-   আমি গ্রামেই সময় কাটাই এখানেই আছি
-   ঢাকায় আসেন অনেক দিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি গল্প করা যাবে
-   আমি তো কিছু এখানে চিনি না ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে ও যেদিন যায়, আসব তোমাকে জানাব
-   ঠিক আছেআমার সাথে দেখা না করে কিন্তু মস্কো ফিরে যাবেন না আমি আপনার ফোনের অপেক্ষা করব যদি মনে করেন, আমি নিজে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসব আপনার এলাকা থেকে
-   না, সেটার দরকার নেই তুমি চাইলে এমনিতেই বেড়াতে আসতে পার আমার এখানে আর ঢাকায় আমি আসব নিজের কাজকর্ম নিয়েই তখন প্ল্যান করে তোমার সাথেও আড্ডা দেব
-   কথা রইল দেখা হবে
-   শিওর!

গ্রামোফোন থেকে ভেসে আসছে পিঙ্ক ফ্লয়েডের বিখ্যাত মিউজিক অনেক দিন গ্রামোফোনে মিউজিক শোনা হয় না ছাত্রজীবনের কত প্রিয় জিনিস যে সময়ের সাথে বাতিল হয়ে গেছে এখনও কয়েক শ রেকর্ড ঘরে পড়ে আছে শোনা হয় না ফেলে দিতেও হাত ওঠেনা 
-   পিয়ানো কে বাজায়?   
-   আমার মেয়ে
-   আচ্ছা! ক’জন ছেলেমেয়ে তোমার?
-   দুই মেয়ে এখন অ্যামেরিকা গেছে ওদের মায়ের সাথে ওখান থেকে ক্যানাডা যাবে আমারও যাওয়ার কথা ছিল ওদের সাথে আপনি আসছেন জেনে রয়ে গেলাম নেক্সট উইকে ফ্লাই করব
-   আচ্ছা জানা ছিল না আমিও তোমার বিজনেস প্ল্যানে ঢুকে গেছি
-   না না, কি যে বলেন? আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আপনার সাথে দেখা করার জন্য টিকেট চেঞ্জ করেছি
আমি প্রসঙ্গ বদলে বলি
-   তোমার একটা মেয়ে ছিল না মস্কোয়?
-   হ্যাঁ
-   যোগাযোগ আছে?
-   না আসলে ও ছোট থাকতেই ওর মা’র সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তবে ওর কোন কিছুর অভাব নেই আমি গাড়ি, বাড়ি সব রেখে এসেছি
-   তুমি নিজেকে এতটা অবমূল্যায়ন করলে?
-   ঠিক বুঝলাম না
-   তুমি বললে না ওর কোন কিছুর অভাব নেই আছে দুলাল, অভাব আছে! ওর বাবা নেই আমার তো অনেক বয়স হল এখনও কারো সাথে আলাপ হলে জিজ্ঞেস করে বাবা মা বেঁচে আছে কি না? তোমাকেও নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করে? ভেবে দেখ তো তোমার মেয়েকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে ও কি উত্তর দেবে?
-   বিজন দা!
-   স্যরি! আসলে আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি কথা প্রসঙ্গে কথা এল
(৯)
এর মধ্যেই বাজতে শুরু করেছে রবিশঙ্কর আরও একজন প্রিয় শিল্পী
-   কি খাবেন বলেন? ভালো হুইস্কি আছে ভদকাও আছে অথবা ওয়াইন?
-   যেটা খুশি কোন আপত্তি নেই তবে আমি চা খেতেই বেশি পছন্দ করি
-   হুইস্কির সাথে বরফ দেব?
-   না, সেটার দরকার নেই আমি তো রাবোচি মানে শ্রমিক শ্রেনীর লোক র’ই দাও
-   আপনি কি এখনও পার্টি করেন? আপনার লেখা পড়ে তাই মনে হয়
-   তুমি আমার লেখা পড় সেটা তো জানতাম না?
-   আমি ফেসবুকে আপনাকে ফলো করি আপনার পোস্ট রেগুলার দেখি
-   তাই বল আমি তো ভাবলাম তুমি গোয়েন্দা লাগালে কি না আমার পেছনে
-   না না কি যে বলেন? আপনি কিন্তু পার্টির ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন
-   ওটা আওয়ামী বন্ধুদের প্রোপাগান্ডা আমি কোন পার্টি করি না সেই ১৯৮৯ সাল থেকে দলছুট
-   কিন্তু আপনার লেখা ...
-   দেখ, কোন আদর্শে বিশ্বাস করতে তো দল লাগে না আমি কিন্তু পার্টি করে আদর্শে বিশ্বাস করিনি সাম্যবাদের আদর্শে বিশ্বাস করি বলেই এক সময় পার্টি করতাম এখনও সেই আদর্শেই বিশ্বাস রাখি, তবে পার্টিতে নয়
-   কেন?
-   দেখ আমার মত মানুষের কোন কালেক্টিভে থাকা কঠিন এই যেমন ধর স্কুলজীবনে অনেকেই ডাক্তার হতে চায় কিন্তু ...
-   বিজন দা, আপনি আবার ...
-   স্যরি আমি একটা উদাহরণ দিতে চাইছিলাম ঠিক আছে, অন্যভাবে বলছি আমাদের গ্রামে নদীর এক জায়গায় গুদারা মানে ফেরি আছে ওতে করে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ অন্য পাড়ে যায় সবার প্রাথমিক গন্তব্য ওপার তারপর যে যার পথে চলে যায় কেউ বাড়ি ফেরে, কেউ বেড়াতে যায়, কেউ ভালো কাজ করতে, কেউ বা চুরি করতে মাঝি জানেই না কে কী কারণে নদী পাড়ি দিচ্ছে
-   মানে......
-   ঠিক ধরেছ এই যে আমাদের দেশের নৌকায় চড়ে কত লোক এম পি থেকে শুরু করে কত কিছু হয় তোমার কি মনে হয় না আজকের নৌকার খুব কম যাত্রীর গন্তব্যই এক? গ্রামের ঘাটের ফেরির মত নৌকাও অনেকের কাছেই নির্বাচনী বৈতরণী পারের বাহন মাত্র নৌকাটা উদাহরণ অন্যান্য দলগুলোও প্রায় একই রকম যেখানে যার যার গন্তব্য এক এক রকম সেখানে এক সাথে পথ চলাটা কঠিন অন্তত আমার জন্য তাই আর কোন দল করি না নিজের ভাবনায় বিশ্বস্ত থেকে লেখালেখি করি কখনও সেটা যায় কারো পক্ষে, কখনও কারো বিপক্ষে কথায় বলে বোবার শত্রু নেই আমি তো বোবা নই তাই সবাই মনে করে আমি অন্য দলের লোক
-   আরেকটু ঢালব?
-   ঢালো ও হ্যাঁ, তোমার মেয়েরা এখন অ্যামেরিকায় বলেছিলে কি করে ওরা?
-   স্কুলে পড়ছে এখানে স্কুল শেষ করলে ওখানেই থাকবে নিউইয়র্ক আর টরেন্টোয় দুটো বাড়ি করেছি আপনি কিন্তু বললেন না আমার ফ্ল্যাটটা আপনার কেমন লাগল?
-   ফ্ল্যাটটা তো ভালো করে দেখাই হল না আমি আসলে কোথাও গেলে শুধু মানুষের কাছেই যাই, বাড়ির মানুষগুলোই আমাকে আকৃষ্ট করে অন্য কিছু তেমন দেখা হয়ে ওঠেনা আমরা সবই করি নিজেদের সুবিধার জন্য বাড়ির প্যাটার্ন, পোশাক পরিচ্ছদ সব এমন ভাবে করি যাতে সেখানে সময় কাটিয়ে বা কাজ করে আরাম পাই আরামের ব্যাপারটা একেক জনের একেক রকম তবে তোমার ড্রয়িং রুমটা সুন্দর অনেক পুরনো জিনিস দেখতে পাচ্ছি সেই গ্রামোফোন, বইপত্র, রেকর্ড – ঠিক যেন ছাত্রজীবনের ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে পেলাম দেখছ না, কেমন গা এলিয়ে, মন খুলে গল্প করছি এর মানে খুব ভালো লাগছে
-   আর এই বাঁশঝাড়টা?
-   অপূর্ব আমাদের গ্রামের বাড়িতেও বাঁশঝাড় আছে যখন পূর্ণিমার চাঁদ বাঁশঝাড়ের মাথা থেকে উঁকি দেয়, সে যে কী দৃশ্য, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না তবে ফ্ল্যাটে বাঁশঝাড়ের আইডিয়া খুব সুন্দর এটাকে আমরা এখন বলি ইকোফ্রেন্ডলি 
(১০)
দরজায় টোকা পড়ল দরজা খুলতেই এক ছেলে বিভিন্ন রকমের খাবারের প্যাকেট এনে রাখল টেবিলের ওপর
-   বাসায় কেউ নেই তাই বাইরে খাবারের অর্ডার দিয়েছিলাম আপনার আপত্তি নেই তো?
-   না, কোন অসুবিধা নেই তবে এসব না করলেও পারতে
-   মানে?
-   আমি ঢাকায় থেকে গেলে সাধারণত দোস্তের ওখানে রাত কাটাই  সারাদিন ব্যস্ত রোগীদের নিয়ে ফ্রি হয় রাত বারোটার দিকে বলা আছে আমাকে নিয়ে যাবে রাতে সেই ছাত্রজীবনের মত দু’জনে কিছু একটা করে খাই আর গল্প করি সারা রাত ও কাজে যায় দুপুরের দিকে যাওয়ার আগে আমাকে কোথাও রেখে যায় যেখান থেকে আমার ভাই কিংবা অন্য কেউ বাড়ি নিয়ে যায় সে দিক থেকে বলতে পার দেশে এলে আমি অনেকটা পার্সেলের মত, এক হাত থেক অন্য হাতে চলে যাই
-   আচ্ছা উনি বিয়েথা করেননি?
-   না আমি ওকে বলি “তুই বিয়ে করিস না তাহলে ঢাকায় আমার থাকার জায়গা থাকবে না আর
-   ওখানে না গেলে হয় না?
-   আসলে জান কি, ওর সময় তেমন নেই মধ্য রাতের পরেই আড্ডা দেওয়ার একটু সময় পাই আমি তো ছাত্রজীবনে পাভ্লভস্কায়া থাকাকালীন মিকলুখো মাক্লায়া এলে ওর ওখানেই থাকতাম ঐ থেকে অভ্যেসটা রয়ে গেছে আমাদের হাতে তাছাড়া এখনও প্রচুর সময় কথার তো শেষ নেই আগামীর জন্যেও কিছু রেখে দিতে হয়
-   আপনার আরেক বন্ধু ছিল মেডিসিনে পড়ত এখন কোথায় ?
-   অ্যামেরিকায়
-   যোগাযোগ আছে?
-   ছিল এখন নেই
-   কেন?
-   আসলে বুঝলে তো সবাই তাদের নিজের নিজের মত করে আমাকে অসুখী করতে চায়
-   যেমন?
-   ও আগে ফোন করত মাঝে মধ্যে ওর চাকরি, বাড়ি-গাড়ির গল্প করত বলত আমাদের ব্যাচে আমি নাকি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়দের একজন ছিলাম রাশিয়ায় পড়ে থেকে আমি সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছি না আছে বাড়ি, না গাড়ি যাকে বলে গুড ফর নাথিং
-   আপনি কি তাই মাইন্ড করেছেন ওর ওপর?
-   মাথা খারাপ! শুধু বলেছি, “দ্যাখ আমি খুব সুখে আছি যে কাজটা করি সেটা খুব প্রিয় প্রচণ্ড উপভোগ করি এ কাজ তুই বিশ্বাস করবি না, এই আনন্দের জন্য ওরা আমাকে বেতনও দেয় ভাবতে পারিস?” এরপর ও আর কখনও ফোন করেনি কে জানে হয়ত  বলা দরকার ছিল, “হ্যাঁ রে, খুব কষ্টে আছি খুব ভালো করেছিস তুই চলে গিয়ে“ আসলে সমস্যা কি জান, লোকজন আমাকে সুখ দুঃখের সার্টিফিকেট দিতে বসে আছে, আর আমি সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করছি না ক’জন সেটা সহ্য করতে পারে বল?
-   তা যা বলেছেন
-   কে জানে? এটাই হয়ত আমাদের জাতীয় চরিত্র “নিজে যারে সুখী বলে সেই সুখী নয়, লোকে যারে সুখী বলে সেই সুখী হয়!”
-   পারেনও আপনি!
-   না না, এটা আমার ব্যাপার নয় অনেকে যেখানে চোখ কান খুলে রেখে দিয়ে চলে, সেখানে আমি চোখ কান খোলা রেখে চলি দেখি মানুষ কি বলে, কেমনে চলে, কি ভাবে সেটাই বলি সমস্যাটা মাথায় হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ, আমার মাথায় কখনও কখনও মনে হয় আমার মাথার খুলির চেয়ে নারকেলের খুলিতে বাস্তব বুদ্ধি অনেক বেশি  বাই দ্য বাই, তুমি এখন গান গাও? বেলোরাশিয়া নিয়ে গানটা তোমার গলায় চমৎকার লাগত!
-   না, এখন আর হয়ে ওঠে না মস্কোয় থাকতেই বাদ পড়ে গেছে
-   আচ্ছা আমার দুই বন্ধু খুব ভালো ছবি আঁকত আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পর্যন্ত পেয়েছিল ওরাও ছবি আঁকা বাদ দিয়েছে তোমাদের মত ট্যালেন্ট থাকলে আমি গান গেয়ে আর ছবি এঁকেই জীবন কাটিয়ে দিতাম ছোট বেলায় টুকটাক ছবি আঁকতাম বিশেষ কিছু নয় তাই মেয়েকে আর্ট স্কুলে পড়িয়েছি খারাপ আঁকে না তবে এটাকে পেশা হিসেবে নেয়নি ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার শখ ছিল আর আগ্রহ ছিল অংকে আর পদার্থবিদ্যায় ওদের নিয়ে আমি সেই শৈশবেই আটকে রইলাম বড় হতে পারলাম না তোমাদের মত!    
(১১)
-   একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
-   কর!
-   আপনিও তো অনেকের মতই বাইরে কোথাও যেতে পারতেন ইচ্ছে হয়নি অন্য কোথাও গিয়ে কাজ করার?
-   হয়েছে আবার হয়নি আসলে জান, অনেক ছোট বেলায়, যখন রাজনীতি বা ভালমন্দ বোঝার মত বুদ্ধি তেমন হয়নি ঠিক তখনই দেশটিকে আমি ভালবেসে ফেলেছি ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব যুদ্ধের আগে, বাবা আমাদের একটা গ্লোব কিনে দেন ওখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ম্যাপ দেখেই ওর প্রেমে পড়ে যাই এখনো মনে আছে ম্যাজেন্টা রঙের সেই দেশটা নিচে হলুদ চীন আর ডান দিকে সবুজ অ্যামেরিকা যুদ্ধের সময় এ তিন দেশের ভূমিকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি শ্রদ্ধা আরও বাড়লো ১৯৭২ সালে ইন্ডিয়া গেলাম, সেখানে কিনলাম এক মানচিত্র এখানে অ্যামেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের রঙ গেছে বদলে সবুজ রঙে ওকে আরও সুন্দর লাগছিল এরপর ধীরে ধীরে পরিচিত হলাম রুশদেশের উপকথা, ম্যালাকাইটের ঝাপি, ইস্পাত, আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে ইত্যাদির সাথে এরপর চেখভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়ের হাত ধরে কখন যে মনের ভেতর  রুশ দেশের জন্য একটা সফট কর্নার গড়ে উঠলো নিজেই জানিনা এরপর এলো রাজনীতি সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা এভাবেই চলে এলাম মস্কো একসময় অবশ্য সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠি, বিশেষ করে এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব দেখে বিভিন্ন সময় নিজে এর সাক্ষী ছিলাম, বিশেষ করে রাতের মস্কোয় যখন আরবাত স্ট্রিট থেকে বিটলস বা রকপ্রেমী যুবকদের ধরে নিয়ে যেত পুলিশ তখন ধীরে ধীরে অ্যামেরিকান ডেমোক্র্যাসির দিকে ঝুকে পড়ি ১৯৯২ সালে তো বিভিন্ন জায়গার দরখাস্ত পর্যন্ত পাঠাই পোস্ট ডকের জন্য কয়েক জায়গা থেকে পি এইচ ডি’র অফার পাই
-   গেলেন না কেন?
-   জানই তো, আমাদের ফ্যাকাল্টিতে এক সময় বাংলাদেশের অনেক ভালো ভালো ছাত্ররা পড়াশুনা করতেন সাজু ভাই, মুফিজ ভাই, অমলদা, গনেশদা, জয়নুল ভাই, নজরুল ভাই, শিবুদি এরা সবাই এসেছিলেন পঁচাত্তরের আগে এরপর বিশাল গ্যাপ ছিল যখনকার কথা বলছি, তখন আমাদের ফ্যাকাল্টিতে আমিই ছিলাম সিনিয়র মোস্ট কাউকে জিজ্ঞেস করার উপায় ছিল না ভাবলাম, কয়েক মাস পরে থিসিস ডিফেন্ড, সেটা না করে আবার পি এইচ ডি করতে যাওয়ার কোন মানে হয়?
-   তারপর?
-   তারপর আর কি? ১৯৯৩ সালে থিসিস শেষ করে ১৯৯৪ সালে দুবনায় চলে গেলাম মনিকার জন্ম হল কাজ, সংসার এসবের মধ্যেই ডুবে গেলাম
-   ওই সময় না যাওয়ার জন্য আফসোস হয় না?
-   না গোর্কির একটা কথা আছে উনি যখন মস্কোর উদ্দেশ্যে নিজের শহর ত্যাগ করেন, ওনার দাদু বলেন, “সবার কথা শুনবি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিবি নিজে যাতে পরে কাউকে   দোষ দিতে না হয়“ আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত ছিল নিজের নেওয়া তাই আফসোস করার সুযোগ নেই কাজ করছি কাজটাকে উপভোগ করছি এখানে আমার এক কলিগের কথা বলতে পারি এক জার্মান ভদ্রলোক (আমাদের ওখানে প্রচুর জার্মান কাজ করে) একদিন তাঁকে বলছিলেন “জার্মানিতে কোন সময়ই পাই না সাত সকালে ট্র্যাফিক ঠেলে কোন মতে ইন্সটিটিউটে পৌঁছুই সারাদিনের কাজ শেষ যখন বাসায় ফিরি সূর্য অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়েদেয়ে বেডে যেতে যেতে রাত দুপুর ব্যক্তিগত জীবন বলতে আর কিছু নেই“ উত্তরে আমার কলিগ বলেছিলেন, “ আমাদের বেতন তোমাদের দশভাগের একভাগ কিন্তু সময়ের অভাব নেই ইচ্ছে হলেই বন থেকে ঘুরে আসতে পারি বা ভল্গার তীরে বেড়াতে যেতে পারি কাজের এমন স্বাধীনতা চাইলে কিছু তো ত্যাগ করতেই হবে!” আমি ওঁর সাথে একমত তাছাড়া বিগত এক দশকের বেশি সময়ে অ্যামেরিকা যেভাবে মিসাইল ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে গণতন্ত্রের চাষ করছে দেশে দেশে তাতে আমি গণতন্ত্রের প্রতিও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছি এখনো অনেক বন্ধুরা, যারা ওদিকে থাকে, বলে “চলে এস আমরা আছি প্রথম দিকে আমরা যে ধাক্কা খেয়েছি সেটার সামাল দিতে পারব তাছাড়া তুমিও দ্রুত কিছু একটা পেয়ে যাবে এবং দুবনার চেয়ে অনেক ভালো করবে
-   তাহলে?
-   তাহলে আর কি? কাজ তো শুধু বেতন, ভালো অফিস, কম্পিউটার এসব নয়, কাজের, বিশেষ করে সৃজনশীল কাজের জন্য সবার আগে দরকার মেন্টাল কমফোর্ট, মানসিক স্থিতি এদিক সেদিক বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখেছি, কিন্তু এখানে আমি যতটা কমফোর্ট ফিল করি, অন্য কোথাও ততটা নয় মানে দুবনা বা মস্কোয় আমি যতটা অ্যাট হোম ফিল করি অন্য কোথাও সেটা করি না হতে পারে অ্যাডাল্ট লাইফ পুরোটাই এখানে কাটল বলে ২০০০ সালে জার্মানি একটা ভালো সুযোগ এসেছিল, আলসেমি করে আর যাওয়া হয়নি। আসলে কারণ যতটা না আলসেমিতে আর চেয়ে বেশি ওদের কঠিন শৃঙ্খলায়। যখন শুনলাম কখন কে কাজে এল না এল তার উপর গোপনে নজরদারি রাখা হয়, বুঝলাম এটা আমার নয়। সো...         

(১)
-   মস্কোর খবর বলবেন না?
-   কি জানতে চাও বল?
-   কারা কারা আছে? কি করছে?
-   পুরনোদের মধ্যে তেমন কেউ নেই অবশ্য এটাও ঠিক যে আমি খুব বেশি লোককে চিনিও না তাই শুধু যারা আমাদের সাথে ওঠা বসা করত ওদের কথা বলতে পারব না, আমাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয় পনের কুড়ি জন হবে এর মধ্যেও অনেকেই চলে যাবে বলে ভাবছে মস্কোয় আজকাল আর লাভে ক্ষতি হয় না, সত্যিকার অর্থে ক্ষতি হয় অন্তত ব্যবসায়ী বন্ধুরা তো তাই বলে তাছাড়া আমি নিজেও মস্কো থাকি না লোকজনের সাথে দেখা হয় মূলত কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে কখনও বা ফোনে কথা হয় এতো গেল বাংলাদেশী কমিউনিটির কথা তবে মস্কো অ্যাজ এ হোল বদলাচ্ছে এখন তো  শহরকে চেনাই যায় না রাস্তা ঘাট সব অন্যরকম গাড়ি ঘোড়ার চেহারা অন্য রকম নব্বই-এর দশকে মানুষ যে রকম অ্যাগ্রেসিভ ছিল এখন সেটা নেই এক কথায় দেশ সামনের দিকে এগুচ্ছে ধীর গতিতে তবে অন্যান্য দেশের মতই সমাজের খুব ছোট্ট একটা অংশই এই উন্নয়নের ফসল ঘরে তুলছে, মানে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ উন্নয়নের ফসল অন্যের ঘরে তুলছে, স্বল্প মজুরির বিনিময়ে
-   যাব একবার মস্কো দেখতে
-   চলে এস আচ্ছা, আমি তো আমার গল্প বলেই সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিলাম এবার তোমার কথা বল  
-   আমার কথা আর কি বলব? দেখছেনই তো ভালো আছি দেশে ফিরে একটা শপিং মল করেছিলাম বিভিন্ন বিজনেস আছে কয়েকটা দেশে বাড়ি আছে নাগরিকত্ব আছে কয়েকটা দেশের ভালো আছি
-   কয়েকটা দেশের নাগিরকত্ব কি ভালো থাকার লক্ষণ, নাকি নিরাপত্তাহীনতার লক্ষণ?
-   আমি ওভাবে ভাবি নি মনে হয় এটা সচ্ছলতার লক্ষণ
-   কে জানে? কয়েক বছর আগে যখন দেশে ফিরলাম, মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বন্ধুদের ওখানে থাকতাম তুমি ওদের চেন  আমাদের সবার শেকড় গ্রাম বাংলায়, মধ্যবিত্ত পরিবারে তবে এখন সবাই ঢাকায় (মানে যাদের সাথে দেখা হয়েছে) চাকরি করছে এক বা দুই সন্তান নিজেদের ফ্ল্যাট ছিমছাম পরিবেশ তবে একটা জিনিস খুব অবাক করল সবাই কেমন যেন একটা খাঁচায় নিজেকে বন্দী করে রাখছে মানে নিচে গেটকিপার উপরে তালা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে অফিসে যাওয়া এক কথায় পৃথিবীর সব আলো বাতাস, সব কোলাহলকে পর করে তারা নিজেরা সোনার খাঁচার বাসিন্দা হয়েছে আসলে আমরা যখন দেওয়াল তুলি, সেটা শুধু অনাকাঙ্খিত লোকজনের চলার পথেই বাধা সৃষ্টি করে না, আমাদের নিজেদের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রিত করে তাই আমার কিন্তু মনে হয় সচ্ছলতা শুধু স্বাধীনতা দেয়ই না, কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা কেড়েও নেয় আর সেটা হয় আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের টাকার গোলাম বনে যাই 
-   তাহলে আপনি কি আমার সচ্ছলতাকে ভালো মনে করছেন না?
-   কি যে বল? মোটেই না আমি বরং খুশি হই বন্ধুরা সচ্ছল হলে আর যাই হোক, ওদের দুঃখের কথা ভেবে মন খারাপ করতে হবে না
-   তাহলে?
-   আমার পয়েন্টটা ভিন্ন আমরা নিজেরা অনেক কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়ে এ পর্যায়ে এসেছি আমাদের এক ধরনের ইম্যুনিটি তৈরি হয়েছে কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা কি সেটা পাচ্ছে? সচ্ছলতা নিঃসন্দেহে ভালো তবে মাঝে মধ্যে একটু দেওয়ালের ওপাশের বাস্তবতার গন্ধ নিলে মন্দ হয় না ঐ দেখ আমি আবার মাইক্রোফোনটা নিয়ে নিলাম
-   না না, ঠিক আছে বলুন, আমি শুনছি
-   গ্রামের বাড়িতে কে আছে? ওদিকটায় যাও?
-   এখন আর কেউ নেই বাবা মা মারা গেছেন
-   স্যরি!
(১)
গ্লাস দুটোতে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে দুলাল বলে চলল 
-   বাড়িটা ওভাবেই পড়ে আছে ভাবছি একটা হাসপাতাল করব ওখানে এলাকার লোকজনদের জন্য
-   আইডিয়াটা খারাপ নয়, তবে ...
-   তবে কি?
-   দেখ, হাসপাতাল মানে বিশাল খরচ তাও আবার প্রতিদিন ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র সে এক এলাহি ব্যাপার এটা যদি তোমার বিজনেস প্রোজেক্ট না হয়, অন্তত ওখান থেকে ইনকামের স্কোপ না থাকে, এর ভবিষ্যৎ অন্ধকার
-   আপনিও বিজনেস ম্যান হয়ে গেলেন?
-   কি যে বল আমি ভাবছিলাম, তুমি যদি এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাও সেটা কীভাবে এফেক্টিভ করে তোলা যায়?
-   কোন আইডিয়া?
-   এমন কিছু করা দরকার যাতে এলাকার লোকজন নিজেরাই সেটাকে সামনে নিয়ে যেতে পারে হতে পারে প্রতি বছর কিছু মেধাবী গরীব ছেলেকে স্টাইপেন্ড দিতে পার ওরা নিজেরা বড় হয়ে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াবে হতে পারে এমন কোন প্রোজেক্ট যেখান থেকে এলাকার মানুষের আয়ের একটা ব্যবস্থা হয়
-   ঠিক আছে আমি এখনও কোন সিদ্ধান্তে আসিনি আপনার প্রস্তাবটাও ভেবে দেখব
-   হুম তোমার বাবার কথা কিছু বলবে না?
-   যোগাযোগ তো হলই আজ আর না তাছাড়া চাইলেই তো মস্কো আসতে পারি তখন না হয় বলব
-   এটা আমাদের মনে হয় আমরা সারা জীবন অনেক কিছুই চাই টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ি, সাফল্য – এসব চাওয়ার ভিড়ে বন্ধুর সাথে দেখা করতে চাওয়াটা কখন যে হারিয়ে যায় তা আমরা টেরই পাই না তাছাড়া পারাটাও কিন্তু এত সোজা নয় কাজ থেকে ছুটি ঠিকই নেওয়া যায়, কিন্তু নিজের কাছ থেকে ছুটি নেওয়া খুব কষ্ট একদিক সামলাবে অন্য দিকে আটকে পড়বে তাই চাইলেই পারি – বলাটা যত সহজ করাটা তত নয় তাছাড়া মানুষ যত উঁচুতে ওঠে তার পায়ের নীচ থেকে মাটি তত দূরে সরে যায়, অক্সিজেন কমে আসে, স্বর্গটাও আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে নরকটাও
-   সে আর বলতে! আপনি স্বর্গ নরকে বিশ্বাস করেন?
-   কেন বল তো?
-   মানে আগে তো আমরা কেউ এ সবের ধার ধারতাম না এখন অবশ্য অনেকেই ধার্মিক হয়ে গেছে তাই জিজ্ঞেস করলাম
-   পাপ করে কিনা তাই পাপ না করলে তো আর পুণ্যের জন্য ধর্না দিতে হত না
-   আপনি আবার এড়িয়ে গেলেন কথাটা স্বর্গ নরকে বিশ্বাসের কথা
-   আচ্ছা সে নিয়ে ভাবিনি, তবে স্বর্গে যাওয়ার শখ খুব একটা নেই
-   কেন?
-   দেখ একদল ওখানে শুধু ভালো ভালো খাবার দাবার আর আরাম আয়েশের কথা বলে, আরেক দল শুধু হুরপরী মানে প্রেম ভালবাসার কথা কথা বলে আমি তো চরমপন্থী মানে এক্সট্রিমিস্ট নই আমার দুটোই চাই তাই ওখানে আমার পোষাবে না  
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল
-   দোস্ত, আমার কাজ শেষ তুমি কোথায় আছ?
দুলাল আমার হাত থেকে ফোনটা নিল
-   ভাই, আপনি এই ঠিকানায় চলে আসেন বিজনদাকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে দেব আপনার অসুবিধা হবে না তো?
দুটো গ্লাসে ভদকা ঢেলে দুলাল বলল
-   খুব ভালো লাগল আপনার সাথে কথা বলে একটুও বদলাননি গত পঁচিশ বছরে মনে হচ্ছিল যেন নিজেই সেই যৌবনে ফিরে গেছি আমি কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে চাই না, তাই ভাইকে বাসায় ডাকলাম না আমিও যাচ্ছি না আপনার সাথে ড্রাইভার আপনাকে পৌঁছে দেবে আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক! চিয়ার্স!
  
(১)
এরপর আমি দেড় মাসের জন্য চলে যাই ইন্ডিয়া ওখানে বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে কাটিয়ে দেশে ফিরি ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে আর নিউ ইয়ারের ঠিক আগে ফিরে আসি দুবনায় এরপর কেটে গেছে কয়েক বছর সেদিন কি এক কাজে ডাইরেক্টরের অফিসে গেলে তার সেক্রেটারি হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন  অনেকদিন থেকেই নাকি আমার জন্যও নির্ধারিত বক্সে পড়ে আছে ওটা আসলে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে কত কিছুই যে বদলে গেছে! এক সময় ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরীর রিডিং রুমে বসে কিছু না কিছু না পড়লে পেটের ভাত হজম হত না পোস্ট বক্স চেক করতাম দিনে কয়েকবার করে এমনকি ঘুমুতে গেলেও হাত থেকে ঘড়ি খুলতাম না এখন এসব মনে হয় দূর অতীতের ঘটনা, অন্য জন্মের গল্প!
খাম খুলে দেখি দুলালের চিঠি এখানে তার প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে দিচ্ছি

প্রিয় বিজন দা,
          ভালো আছেন আশা করি অনেক বছর পরে আপনাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছি খুব ভালো লেগেছে আপনার সাথে কথা বলে, যদিও তখন সবকিছুই যে ভালো লেগেছিল সেটা বলতে পারব না পরে, আপনি চলে গেলে, কথাগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছি এখনও ভাবছি আপনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন বাবা ঢাকায় আমার বাসায় কখনও আসেননি যদিও আমার অর্থনৈতিক সাফল্যে খুশি হয়েছিলেন, তারপরেও একটা দুঃখ ছিল তার মনে উনি চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার হই, এলাকায় ফিরে প্র্যাকটিস করি এ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, গর্ব করে আমার কথা বলতেন এলাকাবাসীকে কিন্তু আমি যখন দেশে ফিরে প্র্যাকটিসের বদলে ব্যবসা শুরু করি উনি খুবই মনক্ষুণ্ণ হন মুখে না বললেও সেটা আমি বুঝেছি এ জন্যেই হয়ত তিনি নানা অজুহাতে ঢাকায় আসেননি আমার বাসায়

ঐ দিন কথা প্রসঙ্গে আপনি বলেছিলেন ধনসম্পদ করার জন্য ডাক্তার হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই
আমি আপনাকে খুব ভালো ভাবে চিনি তাই ঠিক কোন কথাটা আপনি বলতে চেয়েছেন   তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি এটাও আপনার চরিত্রের একটা দিক ভীষণ সোজা সাপটা কথা বলেন তাই আপনার সাথে যারাই কিছুদিন মেলামেশা করে তারা আপনাকে ভাল ভাবেই পড়তে পারে, আপনি কি বলছেন বা বলতে চাইছেন সহজেই বুঝতে পারে এটা আপনার দুর্বলতা আর সবলতা দুটোই আপনি ভাবছেন আমার জায়গায় অন্য কেউ ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেলে স্টাইপেন্ডটা হয়ত এভাবে মাঠে মারা যেত না হয়ত সে ডাক্তার হিসেবে কাজ করত কে জানে? হয়ত করত, হয়ত করত না! তবে আমি যে করছি না, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই আমার নিজেরও তো স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, মানুষের সেবা করার টাকাপয়সা, গাড়ি বাড়ি সবই তো হল, তারপরেও কোথায় যেন একটা কিন্তু রয়ে গেল সব থেকেও কি যেন নেই! একটা না পাওয়ার বেদনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় তবে সেটা যে কি ঠিক বুঝতে পারিনি আপনার সাথে কথা বলে বুঝলাম সেটা আমার আশৈশব লালিত স্বপ্ন জীবন চলার পথের কোন এক বাঁকে যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি এ জন্যেই মনে হয় নিজের এলাকায়  হাসপাতাল গড়ার কথা মনে হয়েছিল আমার

আপনি ঠিকই বলেছেন
হাসপাতাল গড়লেই তো শুধু হবে না, সেটা যাতে ঠিকমত কাজ করে তার ব্যবস্থাও করতে হবে তাই ভাবছি এলাকার কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াশুনার সুযোগ করে দেব কে জানে, হয়ত ওদের কেউ বাবার আর আমার সেই স্বপ্নকে সফল করে তুলবে, এলাকায় কাজ করবে অন্তত আমি ওদের সেটা করার জন্য উৎসাহিত করব হয়ত তখন, যখন দু’একজন ডাক্তারি পাশ করে বেরুবে, এলাকায় হাসপাতাল জাতীয় কিছু করব, যেখানে ওরা সপ্তাহে অন্তত একদিনের জন্য হলেও গিয়ে রোগী দেখবে আর এলাকার লোকজন সীমিত হলেও আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পাবে  
হ্যাঁ, মস্কো এবার নিশ্চয়ই আসব অনেক কথা এখনো বাকি সময় করে বাকি কথাগুলো সেরে নিতে হবে সেদিন আপনি মস্কোর বাংলাদেশীদের কথা বললেন যাদের অনেককেই আমি চিনি না তবে মস্কোর রাস্তাঘাট যেখানে এক সময় আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি, যেখানে হাঁটতে হাঁটতে আমারা আমাদের স্বপ্নের কথা বলেছি তাদের সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করে  যদি সম্ভব হয় ওদের কথা, সেখানে ঘুরে বেড়ানো নতুন মানুষজনের কথা লিখবেন ভালো থাকবেন - দুলাল
(১)
দুলাল,  প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই অনিচ্ছাকৃত দেরির জন্য আসলে আজকাল কেউ আর ডাকে চিঠি লেখে না, তাই পোস্ট বক্স চেক করা হয়না মাত্র সেদিন তোমার চিঠি হাতে এল হয়ত অনেক কিছুই আর প্রাসঙ্গিক নয়, তবুও লিখছি যেহেতু জানি না তুমি এখন এই ঠিকানায় থাক কি না, তাই এটাকে ফেসবুকেও তুলে দেব তুমি বলেছিলে আমাকে ওখানে ফলো কর সেই আশাতেই লিখছি ফেসবুকে আমার ইমেইল আই.ডি. পাবে যোগাযোগটা সেখানে করলে টাচে থাকতে পারব   
খুব ভালো লাগল তোমার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগছে জেনে যে তুমি মাইন্ড করনি ছাত্রের আইডিয়াটা ভালো আসলে সাহায্যের ব্যাপারটা যদি শুধু নিজেদের আদান-প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে,  মানে “তুমি আমাকে, আমি তোমাকে হয়” সেটা হয় ডোবার মত একদিন তা শুকিয়ে যায় কিন্তু এটা হওয়া উচিৎ নদীর মত, যা সামনের দিকে এগিয়ে যায় আর চলার পথে সবাইকে দু হাত ভরে জল দিয়ে যায় মানুষ যদি একে অন্যেকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করে, যে সাহায্য নেয় সে ঋণ শোধের কথা না ভেবে আরেকজনকে নিজের সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেয় শুধু তাহলেই সেটা নদীর মত বয়ে চলতে পারে, স্থান আর কালের সীমা পেরিয়ে নিজেদের মিশনকে আরও আরও দূরে নিয়ে যেতে পারে এতে করে একই সাথে বাড়ে বন্ধুত্বের পরিসর, আস্থার পরিসর জীবনে সবচেয়ে বড় কাজ হল নিজেকে খুঁজে পাওয়া আমরা প্রায়ই ভুল করে অনেক কিছুই খুঁজে বেড়াই, দরকারি অদরকারি অনেক কিছু দিয়ে ঘরদোর ভরে ফেলি আর এই আবর্জনার মধ্যে হারিয়ে ফেলি নিজেকেই একবার নিজেকে খুঁজে পেলে দেখবে জীবনটা কেমন সহজ হয়ে গেছে, জীবনের অর্থটা কী রকম পরিষ্কার হয়ে উঠেছে
এবার মস্কোর কথায় আসি ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এ শহরের নতুন নতুন রাস্তাঘাট দোকানপাটে ভরে গেছে শহর আমাদের প্রিয় লেনিনস্কি প্রস্পেক্টে কত যে নতুন বাড়িঘর উঠেছে বলে শেষ করা যাবে না শুধু সেখানেই নয় সারা মস্কো শহরের একই অবস্থা কয়েক বছর আগে মস্কো শহরকে মনে হত এক বিশাল কন্সট্রাকশন এরিয়া এখন নতুন সাজে সজ্জিতা পূর্ণ যৌবনা সে কয়েক বছর আগে দুবনা থেকে প্রথম প্রথম যখন মস্কো আসতাম ট্রেনে, বাসে, মেট্রোতে স্থানীয় রুশদের দেখা তেমন মিলত না এখন অবশ্য সেটা মনে হয় না বিশেষ করে বড় বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরের দিকে গেলেই সেই পুরনো মস্কোকে ফিরে পাওয়া যায় মিখলুখো মাকলায়া অবশ্য বদলে গেছে প্রচুর নতুন হোস্টেল সামনের মাঠ আর আগের মত অগছালো নেই  ডিজাইন করে গাছপালা লাগান হয়েছে ফোয়ারা থেকে শোঁ শোঁ করে জল আকাশের বুকে উপচে পরে গ্রীষ্ম কালে ছাত্র ছাত্রীও প্রচুর শুনেছি ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে  আমাদের সময় ছিল মাত্র হাজার পাঁচেক আমরা তখন গর্ব করে বলতাম এখানে ১২০ দেশের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে এখন দেশের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক শুধু তৃতীয় বিশ্ব নয়, উন্নত দুনিয়া থেকে ছেলেমেয়েরা আসে এখানে পড়তে  হোস্টেলের পেছনের বন আরও সাজান গোছানো। মনে  পড়ে, ওখানে আমরা প্রায়ই ছবি তুলতে বা ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম? কখনও বা সকালে দৌড়তাম? সব আগের মতই আছে তবে নব্বইয়ের দশকের ঝড়ের পরে এখন অনেক নিরিবিলি, অনেক শান্ত  আমাদের সেই প্রিয় পার্কগুলো, সেই সেন্টার , রেড স্কয়ার বা তার আশেপাশের এলাকা দেখতে আরও সুন্দর, আরও গেস্ট ফ্রেন্ডলি আমার বিশ্বাস কখনও সময় করে বেড়াতে এলে মস্কো তোমায় হতাশ করবে না        
আপাতত রাখছি অনেক শুভ কামনা                 

এখনও আমি দুলালের অপেক্ষায় আছি একদিন নিশ্চয়ই আসবে দেখা করতে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কে এই দুলাল? এটা আপনি, আমি, আমরা সবাই, যারা আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সোভিয়েত দেশে ছিলাম, যারা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ হয়েছি দুলাল আমাদের অনেকের এক গড়পড়তা রূপ দেবতারা যেমন একটু একটু করে নিজেদের শক্তি দিয়ে মহামায়া মহাশক্তি সৃষ্টি করেছিলেন, আমরা সবাই আমাদের নিজেদের চরিত্রের বিভিন্ন দিক দুলালকে দান করেছি সে আমাদের সবার সম্মিলিত রূপ, সে তাই কাল্পনিক নায়ক, সে সবার জন্যই একটা বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন

দুবনা, ০৯ জানুয়ারি ২০১৯  
  


                                


  


                   
 








               
                        


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি