স্ট্যাটাস

আজ ফেসবুকে সিডনী থেকে অজয় দাশগুপ্ত  লিখেছেন তাঁর এক লেখা থেকে কয়েক লাইন চুরি করে কে যেন নিজের লেখার শিরোনাম করেছে। উনি নামকরা লেখক, রেগুলার বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোয়। বিভিন্ন ধর্মী তাঁর লেখা, পড়তে ভালো লাগে। ওঁর আজকের স্ট্যাটাস দেখে আমার অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেল, যা নিয়ে অনেকদিন ভাবছি। আর সেটা হল, যে লোক এই প্লাগিয়াট বা চুরি বা নকলের সাথে জড়িত সে কী আদৌ এটাকে চুরি বা প্লাগিয়াট ভাবছে?
নববর্ষের মাত্র কয়েকদিন আগে আমার জন্মদিন, তাই এই সময়টায় অনেক শুভেচ্ছা পাই – জন্মদিনে, নববর্ষের – যাকে বলে রংবেরঙের শুভেচ্ছা। তখন আমার প্রায়ই মনে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম শীতের কথা। আমি এ দেশে আসি ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে। এদের শরতের শুরু, তবে তখনই এখানে আমাদের মাঘের শীত। এখানে এসেই প্রথম হাতমোজা বা গ্লাভস ব্যবহার করলাম। রাস্তায় একদিন আমাদের সিনিয়র টিচার আলেক্সেই ইভানোভিচ কাতকানভের সাথে হ্যান্ডশেক করতে গেছি, উনি হাতমোজা খুলে হ্যান্ডশেক করে বললেন এরপর থেকে কারো সাথে হাত মেলাতে গেলে সেটা যেন গ্লাভস খুলে করি। কারণ হ্যান্ডশেক বন্ধুত্বের প্রতীক, তাই হাতে হাত মেলানো  দরকার, গ্লাভসের সাথে গ্লাভসের নয়। আমার মনে হয় এটা শুধু হ্যান্ডশেকের বেলায় নয়, সব ক্ষেত্রেই সত্য। আর তাই কাউকে যদি শুভেচ্ছা জানাই, শুভেচ্ছা কথাটা নিজেই লিখি। আজকাল যখন বিভিন্ন উপলক্ষ্যে রাশি রাশি শুভেচ্ছা পাই, বা ঘুম থেক উঠে একগাদা সুপ্রভাত পাই, সে সবই থাকে ফেসবুক বা অন্য কোন রিসোর্স থেকে নেওয়া ছবি বা কার্ড। সেগুলো সুন্দর, কিন্তু আর্টিফিশিয়াল। হয়তো সবাই ভালবেসেই এটা করে, কিন্তু আমি কেন যেন ওতে আন্তরিকতার অভাব দেখতে পাই, বন্ধুর হাতের উষ্ণতা খুঁজে পাই না ওতে। আমার তখন মনে হয় সেই গ্লাভস পরে হ্যান্ডশেকের কথা।
আরও একটা কথা। আজকাল প্রায়ই দেখি বন্ধুরা ফেসবুকে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের জন্ম, মৃত্যু, ভালবাসার পারসেন্টেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্য আমাদের জানাচ্ছেন। আমার বন্ধুরা যারা এটা করে, তাদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত মানুষ। আমি জানি তারা এটা করে জোক করে। কিন্তু অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাও এটা করে। আমি অবাক হব না যদি তাদের কেউ কেউ এটাকে বিশ্বাস করে, এই কোয়ান্টাম জ্যোতিষীর কথায় বিশ্বাস করে নিজের সম্পর্কে এসব ধারণা পোষণ করতে শুরু করে। আমি নিজে যেহেতু কখনও এসব ব্যবহার করিনি, বলতে পারব বা এরা কোন ধরণের ভবিষ্যৎ বানী করে, তবে ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের চারিত্রিক বর্ণনা দেখে মনে হয় এই জ্যোতিষী ভদ্রলোক চাটুর ব্যাপারটা খুব ভালো ভাবেই রপ্ত করেছেন।

ফিরে আসি অজয় দার কথায়। আসলে ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম আমাদের নিজেদের অগোচরে বিভিন্ন রকম মন্ত্র আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে অনবরত। ছোটবেলায় যদি কেউ ধার করে বিলাসিতার জিনিস কিনত, শুধুমাত্র অলসেরা তাকে তিরস্কার করত না। আজ সবাই ক্রেডিটে আরাম আয়েশের জীবন কাটাচ্ছে। একই ভাবে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম দিনে চব্বিশ বার আমাদের বলছে এটা ট্রাই করো, ওটা দেখ। সবই বিনেপয়সায় (আপাত দৃষ্টিতে)। তাই আজকাল মানুষ আর কপিরাইটের কথা মনেই রাখে না। ফেসবুক অনেকটা সরকারি লঙ্গরখানা, আস, সব নিজের মনে করে খাও, পারলে বন্ধুর জন্যও নিয়ে যাও। তাই যেসব লোক আপনার লেখাটা, কারো ছবিটা নিজের মনে করে নিয়ে এখানে সেখানে ব্যবহার করে ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটাই এখনকার সংস্কৃতি। উন্নত দেশগুলোয় প্রাইভেট প্রোপার্টি বা ব্যক্তি মালিকানা আইন দিয়ে সংরক্ষিত, ওখানে ছোট বেলা থেকেই সেটা শেখান হয়। আমাদের দেশে সেসবের বালাই নেই – এখানে জোর যার মুল্লুক তার। ফেসবুক আমাদের ভোগের মন্ত্র শিখিয়েছে, দায়িত্ব, কর্তব্যের কথা শেখায় নি। তাই স্ট্যাটাস চুরিটাকে জনপ্রিয়তার সূচক হিসেবে ধরে উপভোগ করা ছাড়া আর কোন গতি আছে বলে মনে হচ্ছে না।

দুবনা, ০৭ জানুয়ারি ২০১৯  



                        



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি