ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড

১৯৯৭ সাল। ইন্ডিয়া যাচ্ছি পুনায় একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। বাংলাদেশ থেকেই যাচ্ছিলাম। ফ্লাইট ছিল রাত ৮ টার দিকে। এয়ারপোর্টে এসে দেখি আগের প্লেনটা ছাড়বে। বাংলাদেশ বিমানের লোকজন ডেকে বলল, "সীট আছে, চলে যান।" আমিও উঠে বসলাম। মনে হল যেন মিনিবাসে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা যাচ্ছি। যাই হোক, কিছুক্ষন পরে (সত্যি বলতে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা আসতে যত সময় লাগে তারও কম সময়ে) কলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম। তারপরেই শুরু হল দম আটকানো কাহিনী। যেহেতু আমি দেশে ছিলাম মাত্র কয়েক দিন তাই ভিসার জন্য নিজে যাইনি, বন্ধু রকিব দালাল দিয়ে করিয়ে দিয়েছে। সেকালে দালালরাই ভিসা করত, এটাই ছিল অঘোষিত নিয়ম। এয়ারপোর্টে নেমে ফর্ম ফিল আপ করলাম। যেহেতু পুনা যাচ্ছি সেটাই লিখলাম। ঝামেলা হল ইমগ্রেশন পার হতে গিয়ে। সবাই বেরিয়ে গেছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। আমার অবশ্য তাড়া ছিল না। আমার দাদা জানে আমি পরের ফ্লাইটে আসব, তাই সেভাবেই এয়ারপোর্টে আসবে। আগে বেরুলেই কী, আর পরে বেরুলেই কী? এক সময় ইমিগ্রেশন অফিসারকে পাসপোর্ট দিলাম। উনি দেখে বললেন ভিসা নকল।
- মানে?
পাশের কাউন্টারে এক ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখিয়ে বললেন
- ওর ভিসা আপনার পরে ইস্যু করা, অথচ ওর ভিসার ইস্যু নম্বর আপনার আগে।
যেহেতু নিজে ভিসা করিনি, তাই সেটা আসল না নকল তা আমার জানা ছিল না। কী করা? বললাম
- দেখুন মাত্র দুটো ভিসা দেখে আপনি কার ভিসা আসল আর কার নকল সেই সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। যেহেতু তারিখ আর নম্বর অনুযায়ী আগেরটা পরে আর পরেরটা আগে দেখাচ্ছে, এটা ঠিক একটা জাল। কিন্তু কোনটা সেটা যাচাই করতে মিনিমাম আরও একটা জেনুইন ভিসা লাগবে। লজিক আর অংক সেটাই বলে।
- আপনি কি করেন?
- কসমোলজির উপর গবেষণা করি।
- আপনি কোথায় যাবেন?
- পুনা। রিলেটিভিটির উপর একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দিতে। এই দেখুন আমার ইনভাইটেশন।
- আপনার পুনার প্লেন বা ট্রেনের টিকেট বুক করা আছে? এত রাত্রে কোথায় যাবেন?
- আমার দাদা আমাকে নিতে আসছে। আমার নেক্সট ফ্লাইটে আসার কথা ছিল। সীট খালি ছিল বলে আগে চলে এসেছি। ওরা সময় মত নিতে আসবে।
- আপনাকে দেখে মনে হয়না আপনি বাংলাদেশে থাকেন। কোথায় থাকেন আপনি?
- রাশিয়া।
- প্রমান আছে?
- কি প্রমান দরকার? এই আমার ইন্সটিটিউটের আইডি কার্ড।
- এটা দেখে তো কিছু বুঝছি না। আর কিছু?
- এই যে আমার ফ্যামিলি এ্যালবাম।
হঠাৎ একলোক প্রশ্ন করলেন
- আমি যাই, রাশানে কি হবে?
- ইয়া ইদু।
- আপনার ভাইয়ের টেলিফোন নম্বর আছে?
- এই নিন।
ওরা ফোন করল। বউদি ধরল।
- বিজন সাহা নামে কেউ আসছে আপনাদের ওখানে? কেউ তাকে নিতে আসবে?
- হ্যাঁ। ওর তো আরও পরে আসার কথা। ওর দাদা বেরিয়ে গেছে। লেক সার্কাসে আরেক দাদার ওখানে বসে গল্প করছে। আমি পেজ করে দিচ্ছি। ওরা এক্ষুনি চলে আসবে।
- ওকে। ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন।
- ধন্যবাদ। আপনি রাশান জানেন?
- না।
- তাহলে যে প্রশ্ন করলেন?
দেখুন, আপনার বলার ভঙ্গি দেখেই বুঝেছি ভাষাটা আপনি জানেন। না জানলে চটজলদি উত্তর দিতে পারতেন না। এটা ছিল সাইকোলজিক্যাল টেস্ট। এনি অয়ে, ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া। হ্যাভ এ নাইস টাইম।
বেরিয়ে এসে দেখি সেই ছেলেটা অপেক্ষা করছে।
- ভাই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে খুব ঝামেলায় পড়তাম।

একটু পরে স্বপন দা আর কল্যাণ দা চলে এল। আমরা রওনা হলাম লেক সার্কাসের পথে।

এরপর অনেক বার ভেবেছি, আচ্ছা, এই যে আমরা দেব দানব, ভাল মন্দ ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে এত কথা বলি, কিন্তু কোন তৃতীয় পক্ষ, যা কিনা ফ্রেম অফ রেফারেন্স হতে পারত, ছাড়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছই, সেটা কতটুকু লজিক্যাল? বিশেষ করে যখন চারিদিকে দেবতার নামে এত দানবীয় কাজকর্ম করা হয়!

দুবনা, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ 
 
 
 
 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি