এক সকালের জীবন বৃত্তান্ত
ভোরের ট্রেনটা অনেকটা অ্যালার্মের কাজ করে। প্রতিদিন কাকা ডাকা ভোরে ট্রেনটা
যখন প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাতাসের বুক ভেদ করে একটু একটু করে এগিয়ে যায়, সারা
শহরটা যেন হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জাহাজ চলে গেলে নদীর ঢেউ যেমন কূলে এসে আছড়ে পড়ে,
কুকুরের ডাক, পাখিদের কোলাহল বা গাড়ির শব্দও ঠিক তেমনি ভাবে একের পর এক আছড়ে পড়ে ঘুম
জড়ানো কানে। বিছানার অর্ধেকটা জুড়ে ঘুমুচ্ছে বইয়েরা। ওদের কেউ কেউ চোখ খুলেই
ঘুমিয়ে আছে। অদ্ভুত সব কারবার।
- আচ্ছা, তুমি এই
বইখাতা, কলম পেন্সিল, ক্যামেরা, কম্পিউটার এসব পাশে নিয়ে ঘুমোও, অসুবিধা হয় না।
- না, অসুবিধার কি
আছে। এটা আমার জন্মগত অভ্যেস। বালিশের নীচে বইখাতা, কলম পেন্সিল সব সময়ই থাকতো।
ক্যামেরা, কম্পিউটার এসব অবশ্য নতুন আমদানী, ছোটবেলায় আমার ঘুমের সাথী ছিল
মার্বেল, লাটিম আরও কত কিছু। আসলে বুঝলে, আমি যখন অন্য কোথাও যাই, যেখানে সব কিছু
ছিমছাম – আমি কী যেন একটা মিস করি। আজ হঠাৎ বুঝলাম এই বিশৃঙ্খলা আমি মিস করি। “আমি
বিশৃঙ্খলার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত।“ এর মধ্যে অন্য একধরণের মজা আছে। এটাকে ঠিক বলে
বোঝানো যায় না, এটা অনুভব করতে হয়।
রোদের আলো জানালায় টোকা দেয়। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ঘরে। বইখাতা, কলম
পেন্সিল সবাই ঘুম থেকে উঠে বসে। কয়েক বছর আগের শুকনো আপেল, ক্ষয়ে যাওয়া পাতা, শুকনো
ডালপালা সবাই চোখ মেলে চায়, যেন বলে “ওঠ শিশু মুখ ধও পর নিজ বেশ”
- শুনছ, চা হলে
মন্দ হয় না।
- হুম। করে নিলেই
তো পার বাপু।
- আচ্ছা। মেইলটা
একটু চেক করে নিই।
মেইল চেক, ফেসবুক... কি করে যে সময় কেটে যায়। রাতের কিছু কাজ হাতে ছিল।
দুয়েকটা পেপার দেখা দরকার। অফিস যেতে হবে ...
- চা এর আর দরকার
নেই। তুমি বরং রান্নাটা বসিয়ে দাও, আমি স্নান করে নিচ্ছি।
- কোনটা আগে করবে?
রান্না নাকি স্নান?
- রান্না বসিয়ে
দাও। রান্না হতে হতেই স্নানটা সেরে ফেলা যাবে।
- আকাশটা কেমন
মেঘলা দেখেছ? বৃষ্টি পড়ছে হয়তো।
- হুম, ছবি তোলার
পারফেক্ট সময়। তোমরা রান্না স্নান এসব কর, আমি বরং কয়েকটা ছবি তুলে নিই।
চালেরা গরম জলে সাঁতার কাটতে শুরু করে। মাংসও গায়ে মশলা মেখে নেমে পড়ে ফুটন্ত
ফ্রাই প্যানে। দুটো গ্লাস জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে ধুসর আকাশ। ওদের বড় শখ আজ
প্রোফাইল বদলানোর। অপেক্ষায় কখন কেউ ক্যামেরার ক্লিক করবে। মাংসের গন্ধে ঘর ভরে
যায়, ওদিকে ছবির জন্য অপেক্ষমান দুই বন্ধু। ক্ষণিক বিলম্ব। জেদি মাংসের দল রেগে
লাল। স্নান শেষে এসে দেখে রান্না ঘরে লঙ্কা কাণ্ড। সে বোঝে না মাংসের যুক্তি। কী
হত দু’ মিনিট অপেক্ষা করলে। নিজেরা তো পুড়লই এক ঘর মানুষের কপালটাও পোড়াল। আজ আর
বলা যাবে না “খাবারটা যা হয়েছে!“ ঘর থেকে ভেসে আসে জাকির হোসেনের তবলার আওয়াজ আর শঙ্কর
মহাদেভানের কণ্ঠ। গানের সুরে আর তবলার তালে তালে ওরা সবাই মিলে পোড়া মাংসগুলো চালান
করে দেবে পেটের ভেতর। এক এক করে ফটোগ্রাফার, রাঁধুনি আর অলস ছেলেটা সবাই ঢুকবে
জ্যাকেটের ভেতর। এখন সবাই এক হয়ে যাবে। অফিসে একাধিক স্বত্ত্বায় কেউ বিশ্বাস করে
না।
দুবনা, ২৪ অক্টোবর ২০১৯
দুবনা, ২৪ অক্টোবর ২০১৯
Comments
Post a Comment