একজন মুক্তিযোদ্ধা

সাদেক হোসেন খোকা নিউ ইয়র্কে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন ওনাকে আমি জানতাম ঢাকার মেয়র এবং বিএনপি নেতা হিসেবে হয়তো এ কারণেই ওনার অন্য পরিচয় এতদিন চাপা পড়ে ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যতদিন বেঁচে থাকেন, তারা কারও পথের দিশারী, কারও প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই তাদের সম্পর্কে জীবদ্দশায় নিরপেক্ষ কথাবার্তা তেমন শোনা যায় না মৃত্যুর পরে অবশ্য অন্য কথা তখন সবাই পরিমিতভাবে ভালোটা বলারই চেষ্টা করেন, বলেন সেই সুত্র ধরে নতুন অনেক কিছু জানলাম সাদেক হোসেন খোকা সম্পর্কে যেমন তিনি পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন, দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ছিলেন সত্তরের দশকের আবাহনী-মোহামেডানের বাইরের তৃতীয় শক্তি ব্রাদার্স ইউনিয়নের সংগঠক ইত্যাদি ইত্যাদি তবে পরে বিএনপিতে যোগদান করায় তার এসব পরিচয় আড়ালে চলে যায়, উনি হয়ে ওঠেন শুধুই বিএনপি নেতা অনেকেই তাঁর এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি ফলে তাঁর একাত্তর বা একাত্তর পূর্ববর্তী পরিচয় ঢাকা পড়ে গেছে অন্তত আমার এসব জানা ছিল না, সেটা অবশ্য আমার দুর্বলতা, আমার অজ্ঞতা
আমার বরাবরই মনে হয়েছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এসবই আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে
পাকিস্তান সরকার যদি মানুষের ভোটের রায় মেনে নিত আর হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে পঁচিশের কালো রাতে এদেশের মানুষের উপর ঝাপিয়ে না পড়তো, ইতিহাস অন্যভাবেই লেখা হত ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে কারারুদ্ধ না করলে। এই যুদ্ধে তখন মানুষ অংশ নিয়েছে, লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেছে করেছে। ঘরে যখন আগুন লাগে অধিকাংশ মানুষ তখন আগুন নেভাতেই ব্যস্ত, খুব কম মানুষই তখন ভবিষ্যতের নতুন ঘরের নকশা আঁকেন। যুদ্ধেও তাই। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল দেশকে শত্রু মুক্ত করে শান্তিতে বসবাস করতে আর রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কি হবে সেটা নিয়ে ভেবেছেন সবাইকে যে একইভাবে ভাবতে হবে তার তো কোন মানে নেই তাহলে তো পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে একটাই রাজনৈতিক দল থাকত তা তো হয়নি বিভিন্ন দেশে বরং নতুন নতুন দল গড়ে উঠছে ট্রাম্পের জয় প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার কথাই প্রমাণ করে বাংলাদেশেও তো স্বাধীনতার পর একের পর এক দল তৈরি হয়েছে বাম ঘরানার দলই তো কত প্রায়ই কেউই টেকেনি আবার বিএনপি টিকে গেছে, জাতীয় পার্টিও অবশ্যই এর একটা প্রধান কারণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কিন্তু তার পরেও বিএনপি যতটা ভিত্তি পেয়েছিল মানুষের মাঝে, জাতীয় পার্টি সেটা পায়নি অথবা ধরেন জাসদের কথা, যারা পঁচাত্তরের আগেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় ফ্যাক্টরে পরিণত হয়। এই দলের সংগঠকরা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন আসল কথা হল, স্বাধীনতার পর বিরাজমান রাজনৈতিক শক্তি সবাইকে নিজেদের এজেন্ডার নীচে এক করতে পারেনি এখানে মনে রাখতে হবে, ভারত বিভাগের পরে যখন মুসলিম লীগ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হয়, তারাও সবাইকে ধরে রাখতে পারেনি শেখ মুজিবের মত নেতারা, যারা পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের বিজয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন, পাকিস্তান জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই প্রথমে ছাত্র লীগ ও পরে আওয়ামী (মুসলিম) লীগ গঠন করে মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের এস্টাব্লিসমেন্টের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারেন তাই যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন তাদের অচ্ছুত না ভেবে কেন গেলেন সেটা ভাবাই জরুরী

সাদেক হোসেন খোকা বিএনপি থেকে নির্বাচন করে ঢাকার মেয়র হন
যতদূর জানি নির্বাচন ভোটার বিহীন ছিল না রীতিমত লড়াই করে জয় লাভ করেন আনিসুল হকের মত এতটা চ্যারিস্ম্যাটিক না হলেও তিনি কাজ কর্ম ভালই করেছেন বলে মনে হয় বিএনপির মত একটা দলের নেতা হয়েও কমরেড মনি সিংহ, কমরেড ফরহাদ, কমরেড সাইফুদ্দিন মানিকের নামে ঢাকার রাস্তার নামকরণ করতে বুকের পাটা লাগে সাহস লাগে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মতিউল ও কাদেরের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে একটি ভাস্কর্য তার সময়ই গড়া এ সবই বিএনপির রাজনীতির মধ্যে থেকে গেরিলা যুদ্ধের মতই একাত্তরের চেতনার ধারক ও বাহক সরকারের সময় যেখানে মনি সিংহ সহ অনেক প্রবীন ও পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন আসে, সাদেক হোসেন খোকার এসব কাজ নিঃসন্দেহে তাঁর মধ্যে লুকিয়ে থাকা বামপন্থী মানুষের, মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় বহন করে। বামপন্থী কত নেতাই তো আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় দলের ভিড় জমিয়েছে, কিন্তু কয়জন তাঁদের অতীত রাজনৈতিক বিশ্বাসে প্রতি এতটুকু সম্মান প্রদর্শন করতে পেরেছেন?  

তাঁর পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক জীবনে সব কিছুই আমাদের ভালো লাগবে সেটার কোন কারণ নেই
সব কিছুর পরেও তিনি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকার মেয়র এসব বিবেচনায় এনেই তাঁকে যথাযথ মর্যাদায় দেশের মাটিতে সমাহিত করা উচিত, বিশেষ করে এটা যখন তাঁর নিজের ইচ্ছে সেটা না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিভাবে দেশের জন্য লড়াই করবে, দেশ ও দশের পাশে দাঁড়াবে?

দুবনা, ০৫ নভেম্বর ২০১৯




Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি