মানুষ
অনেক দিন আগে, যখন ভিডিও ক্যাসেটের যুগ রমরমা এক বন্ধু আমাকে একটা ভিডিও দিয়েছিলেন দেখার জন্য। ওখানে ছিল রাশান চার্চের এক ফাদারের সাক্ষাৎকার। ফাদার আলেক্সান্দর, তিনি ব্রিটেনে এক রাশান চার্চের প্রধান। উনি বলছিলেন বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায় চার্চের কথা। এক জায়গায় বললেন বলশেভিকদের হাতে কিভাবে ঈশ্বর ঘরছাড়া, গৃহহারা হলেন।
আজ অযোধ্যার রাম মন্দির - বাবরী মসজিদের রায় বেরুলো।
মার একটি প্রিয় গান ছিল
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
পতিত পাবন সীতা রাম
ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম
সব কে সুমতি দে ভগবান
এই গানের উপর সেতার, সারোদ, সানাই ইত্যাদি অনেক শুনেছি, তবে কথা কখনও পড়িনি। মায়ের গাওয়া (আমাদের ছোটবেলায় সাথে সাথে আমরাও গাইতাম প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়) কথাগুলো যেভাবে মনে আছে সেভাবেই লিখলাম। ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে সেটা আসল কথা নয়। আসল হল রাম, ঈশ্বর, আল্লাহ সবাই এক। এ নিয়ে ছোটবেলায় আমাদের কখনও কোন প্রশ্ন ছিল না।
সেই সময় স্কুলে ধর্ম বলে এক বিষয় ছিল আমাদের। সেখানে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হত তিনি সর্বশক্তিমান (omnipotent), সর্বভূতে বিরাজমান (omnipresent)। তাঁর নামও অনেক। শ্রীকৃষ্ণেরই একশ আট নাম। তাই ভেবে পাই না, তিনি যদি সর্বশক্তিমানই হন, সর্বব্যাপী হন তাহলে মসজিদ বা মন্দির বা গির্জা থেকে তাঁকে কিভাবে বের করা যায়? আর যারা এটা করেন মানে ধার্মিকেরা এভাবে নিজ নিজ ঈশ্বরকেই তো ছোট করছেন। নিজেদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করছেন ঈশ্বরের সীমাবদ্ধতা, তাঁর দুর্বলতা। প্রমাণ করছেন ঈশ্বর আর যাই দিক, তাদের সুমতি দেননি।
১৯৯০ আর ১৯৯১ সালে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। একটা জিনিস আমাকে খুব অবাক করেছিল, সেটা হল প্রায় প্রতিবেশির মত মন্দির, মসজিদ আর প্যাগোডার উপস্থিতি। সিঙ্গাপুরে মুলত চাইনিজ, মালয়েশিয়ান আর ইন্ডিয়ানদের বাস। এরাই মুলত বৌদ্ধ, মুসলমান আর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। তারপরেও কেন এরা পাশাপাশি শান্তিতে বাস করতে পারছে? আমার ধারণা সেটা রাষ্ট্রের কারণে। একমাত্র রাস্ত্রই পারে তার নিরপেক্ষ নীতির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি বাজায় রাখতে। একই ভাবে রাস্ত্রই পারে জনগণকে ধর্মের কানাগলিতে ঢুকিয়ে "ডিভাইড অ্যান্ড রুল" আইনে চালনা করতে। পপুলিস্টিক আর ভোটের রাজনীতির খপ্পরে পড়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাস্ত্রকে আর নিরপেক্ষ রাখতে পারছে না। শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে ফাউস্টের মত বর্তমানের অনেক রাজনৈতিক দল জিম্মি হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে।
আজকের রায় সবাইকে খুশী করবে না, করতে পারে না। এই রায় আসলে হিন্দু বা মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে বা বিপক্ষে যতটা না তার চেয়ে বেশি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। বিচারটা শেষ বিচারে ঈশ্বরেরই হল। তিনি যে সর্বশক্তিমান নন সেটাই প্রমানিত হল। আর সেটা হল ঈশ্বরকে যারা সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করেন তাদের উদ্যোগেই।
মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ফাঁকফোকর দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবিও আমরা দেখি যখন হিন্দুরা ইদের নামাজের জন্য মন্দির ছেড়ে দেয় বা মুসলমানরা হিন্দু মন্দির পাহারা দেয়। এমন কি হতে পারত না যে দুপক্ষই অযোধ্যাতেও কোন আদালত ছাড়াই নিজেদের মধ্যে এক সমঝোতায় আসতেন। এখন সেটা করা সম্ভব না হলেও সবাই আদালতের রায়কে সবাইক সম্মান করতে পারেন, আর এভাবেই ঈশ্বর আল্লাহ যে এক ও অদ্বিতীয় সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন। সব কিছুর পরেও তারা সবাই মানুষ থাকবেন এটাই শুধু আশা করতে পারি।
Comments
Post a Comment