জনতার ঐক্য

কয়েক দিন আগে ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেয়ার করছে। সময়াভাবে তখন সেটা পড়া বা দেখা হয়নি, পরে আর পাইনি। তবে সেটার মূল কথা হল দেশে পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে একতা আছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে একতা আছে, শুধু জনগণের মধ্যে কোন একতা নেই। আমাদের রাষ্ট্রপতি মাঝে মাঝেই এমন অপ্রিয় সত্য কথা বলে ফেলেন। কিন্তু এটা শুধু নতুন প্রশ্নেরই জন্ম দেয়। আমার জানতে ইচ্ছে করে কেন আজ জনতা ঐক্যবদ্ধ নয় অথবা আমাদের দেশে আদৌ কি জনগণ আছে? জনতা, জনগণ খুবই বিমূর্ত আইডিয়া, রাস্তায় বা প্রতিবাদ মিছিলে যে জনতা বাড়িতে ফিরে সেই শিক্ষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষক, পিতা বা সন্তান। তাই যদি হয় তাহলে কি এমন ঘটলো যে এই শ্রমিক বা কৃষক বা ব্যবসায়ী জনগণের অংশ হয়েও জনগণের সাথে রইলো না, হঠাৎ করে তারা কিভাবে জনতার বিরুদ্ধে চলে গেল? আসলে জনগণের ঐক্য কি সব সময়ই দেখা যায়? এই যারা কিছুক্ষন আগেই একসাথে মিছিল করল কোন এক ইস্যুতে, বাড়িতে ফিরে দেখা গেল তারাই অন্য ইস্যুতে একে অন্যের মাথা ভাংতে পিছ পা হচ্ছে না। আসলে একক মানুষগুলো সমষ্টি হয়ে ওঠে, জনতা হয়ে ওঠে কোন বিশেষ মুহূর্তে। দেশ, গোষ্ঠী বা জাতির কোন বৃহত্তর স্বার্থ আদায় করতে। আর তার এই লড়াই প্রায়ই সরকারের বিরুদ্ধে। ফলে জনগণের কথা বলে দেশ চালালেও প্রায় সব সরকারই জনগণের প্রতিপক্ষ। তবে সেটা যে সব সময়ই আন্ট্যাগোনাস্টিক তা নয়। আমাদের দেশে জনতার ঐক্য গড়ে উঠেছে বাহান্নয়, একাত্তরে। তখন ঐক্যবদ্ধ জনতা দেশ স্বাধীন করেছে বুকের রক্ত দিয়ে। এর পরে স্বাধীন দেশে সেই জনতাই এরশাদকে গদিচ্যুত করেছে। ইদানীং কালে গণ জাগরণ মঞ্চে আমরা দেখেছি জনতার ঐক্য। প্রায় সব ক্ষেত্রে জনতার রোষ সরকারের বিরুদ্ধে গেলেও গণ জাগরণ মঞ্চ সরকার বিরোধী ছিল না। তারা চেয়েছিল সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করুক, উচিৎ শাস্তি দিক। সেটা অনেকটা মেনে নিলেও পরবর্তীতে সরকার নিজেই সেই মঞ্চের শক্তি বিনষ্ট করেছে। একইভাবে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে। যার ফলাফল আজ সরকার পরিবহন শ্রমিকদের হাতে জিম্মি, তাদের অন্যায় দাবী মানতে বাধ্য হচ্ছে, জনগণ আর এ ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করছে না, সরকারের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না। তাছাড়া বাংলাদেশে জনতার ঐক্য আদৌ সম্ভব কিনা কে জানে। এখন দেশের জনগণের একটা বিরাট অংশ দেশের সংবিধান মানে না, তারা জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীতকে নিজেদের পতাকা বা সঙ্গীত মনে করে না। দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে তারা ভিনদেশী, বিধর্মী সংস্কৃতি মনে করে। অবশিষ্ট মুষ্টিমেয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে ভারতের দালাল মনে করলেও দেশের এই বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা নিজেদের পাকিস্তানী বা আরব দেশের নাগরিক ভাবতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। চলনে বলনে, পোশাক পরিচ্ছেদে বাংলাদেশী নয়, বরং পাকিস্তানী, আরবি বা ইউরোপিয়ান কায়দা কানুন দেখিয়েই মনে শান্তি পায়। মূলত নিরাপত্তার কারণে অনেকেই ইউরোপ, অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। এক সময় গ্রামের শিক্ষিত মানুষেরা যেত শহরে চাকরি করতে। ঈদে বা পুজায় বা অন্য কোন ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে আসত বৃদ্ধ বাবা মার কাছে। এখন এদের অনেকেই চলে যায় সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে। গ্রামের সাধারণ মানুষ আজকাল কাজের খোঁজে ঢাকার আগে লন্ডন, কাতার, কুয়েত, দুবাইসহ ভিন দেশে যেতে চেষ্টা করে। দেশটাই যখন দিন দিন বিদেশ হয়ে যাচ্ছে তখন ঐক্যটা হবে কিসের ভিত্তিতে? একের পর এক নাগরিক অধিকার হারাতে হারাতে বাংলার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ এখন তাদের সবে ধন নীলমণি সেই ভোটের অধিকারটা পর্যন্ত হারাতে বসেছে। আর এ সবই করছে কোন সামরিক জান্তা নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। যাদের রাজনীতিটা লালন পালন করার কথা তারাই যদি রাজনীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয় কিসের আশায় মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে, কার পেছনে ঐক্যবদ্ধ হবে? জনতার ঐক্য বলতে যদি আপনারা সরকারি দলের পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে মার্চ করা বোঝান সেটা আলাদা কথা। এইতো গত কালই বাম গণতান্ত্রিক জোটের মিছিলে আক্রমণ হল সরকারি দলের পক্ষ থেকে। এসব দল আপনাদের জন্যে হুমকি নয়, ইতিহাস বলে তারা কখনই নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হয় না, তার পরেও যদি তারাই মিছিল মিটিং করতে না পারে, ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, জনতা ঐক্যবদ্ধ হবে কীভাবে? তারপরেও একদিন জনতা ঠিকই ঐক্যবদ্ধ হবে, কিন্তু তখন একাত্তর বা নব্বইয়ের মত আপনাদের সাথে জনগণের ঐক্যের সম্পর্ক থাকবে কিনা সেটা ভাবার বিষয়।

দুবনা, ২৯ নভেম্বর ২০১৯ 



Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি