অক্টোবর বিপ্লব



আজ মহান অক্টোবর বিপ্লবের ১০২ তম বার্ষিকী। অনেকটা অগোচরেই চলে গেল দিনটা, যদিও ইদানীং কালে আবার আজকের দিনে রেড স্কয়ারে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। আমাদের ছাত্র জীবনে মিলিটারি প্যারেড হত না, তবে বিশাল জনসমাবেশ হত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মিছিল করে মানুষ চলে যেত রেড স্কয়ারের বুকে হেঁটে হেঁটে। আমি নিজেও বেশ কয়েক বার গেছি এসব ডেমনস্ট্রেশনে ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে। জুবভস্কি বুলভারে শুরু হত, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে রেড স্কয়ার পর্যন্ত। চেরনেঙ্কো, গরবাচেভ হাত নাড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাতেন। এখন অবশ্য অক্টোবর বিপ্লব দিবস উপলক্ষ্যে প্যারেড হয় না, প্যারেড হয় ১৯৪১ সালের ৭ নভেম্বরের প্যারেডকে স্মরণ করে। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মির জয়যাত্রা। “পিছানোর জায়গা নেই, পেছনে মস্কো” এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রেড আর্মি বেরিয়ে পড়েছিল বিজয় মার্চে যার শেষ ১৯৪৫ সালের মে মাসে বার্লিনে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কমিউনিস্ট আন্দোলনে স্থবিরতা এসেছে। এই পতনকে সমাজতন্ত্রের পরাজয় বলে ধারণা করা হয়। নিঃসন্দেহে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক ভুল ত্রুটি ছিল, তবে সেটা কি তত্ত্বের নাকি প্রয়োগের সেই বিতর্ক এখনও রয়ে গেছে, থাকবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও সে যে প্রভাব রেখে গেছে বিশ্ব ইতিহাসে সেটা কোন দিনই ম্লান হবে না। তার সক্রিয় সমর্থনে শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোই স্বাধীনতা লাভ করেনি, পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি মনভাব বদলাতে বাধ্য হয়েছে। আজ পশ্চিমা বিশ্বে যে ওয়েলফেয়ার স্টেটের জন্ম সেটাও সমাজতন্ত্রকে প্রতিহত করার এক পুঁজিবাদী উদ্যোগ বা কৌশল।
যেকোনো বড় কাজ অনেক মানুষকে একত্রিত করে, অক্টোবর বিপ্লবও তার
ব্যতিক্রম ছিল না। আর প্রায় প্রতিটি যুগান্তকারী ঘটনার পরই এর নেতাদের মধ্যে দেখা দেয় বিভিন্ন প্রশ্নে মতবিরোধ। এ জন্যেই মনে হয় প্রায় সবাই সব সময় শত্রু খুঁজে বেড়ায়, তাতে একদিকে যেমন নিজেদের ঐক্য ধরে রাখা যায়, অন্যদিকে জুজুর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থনও লাভ করা যায়। সেদিক থেকে দেখলে শত্রুর উপস্থিতি এক ধরণের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। সেটা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, এখনও দেখছি।
জানি ইতিহাস যদি, কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করে না, তবুও মাঝে মাঝে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে কি হত, যদি অক্টোবর বিপ্লবের কুশীলবরা নিজেদের মধ্যে মরণ যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন উন্নত করার কাজে নিজেদের সঁপে দিতেন। যদি না লেনিন দার্শনিক জাহাজে করে রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের ইউরোপে পাঠিয়ে দিতেন, যদি না তিরিশের দশকে স্ট্যালিন পার্টির মধ্যে ও বাইরে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালাতেন? সব রকমের শুদ্ধি অভিযানের পেছনে কাজ করে সন্দেহ আর সন্দেহের বশে চারিদিক কচুকাটা করতে করতে এক সময় নিজের মৃত্যু শয্যায় জল দেওয়ার মত মানুষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আসলে শত্রুকে পরাজিত করার পর বন্ধুদের মধ্যে এই যে কলহ তার মাশুল মানুষ দেশে দেশে দিয়েছে, দিচ্ছে। বাংলাদেশেও এটা ঘটেছে। একাত্তরের বিজয়ী সেনানীরা অল্প দিনের মধ্যে চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছে, যার মাশুল জাতি আজও দিচ্ছে। অ্যামেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতারা বিভিন্ন প্রশ্নে নিজেদের প্রচণ্ড মতবিরোধ থাকার পরও সেটাকে কন্ট্রোলে রাখতে পেরেছিলেন। যেখানেই নিজেদের মতভেদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সেখানেই ঘটেছে বিপর্যয়। আর এই মতভেদ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ এসবের উপরে নির্ভর করে না। তাই সমাজতন্ত্রের পতনে শুধুমাত্র তত্ত্বগত ভুল খুঁজলে হবে না, দেখতে হবে তার প্রয়োগ আর যারা সেটা প্রয়োগ করেছেন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের একাত্মতা। আমার বিশ্বাস তত্ত্ব হিসেবে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ তার আবেদন হারায়নি, ভবিষ্যতে সে আবার সমাজকে নাড়া দেবে, সমাজ বদলের মন্ত্র হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। মহান অক্টোবর বিপ্লব মেহনতী মানুষকে যুগ যুগ ধরে উদ্বুদ্ধ করবে তার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে।   
       

দুবনা, ০৭ নভেম্বর ২০১৯


Comments

  1. আমরা যে ভুলটা প্রায়ই করি, সেটা হল সমাজতন্ত্রকে গণতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাই। সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্র থাকতে পারবে না তার কি কোন কথা আছে? পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্র সমার্থক নয়। গণতন্ত্র হল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যাপক মানুষের (সবার) অংশগ্রহণ। সোভিয়েত ব্যবস্থায় সেটা ছিল, তবে যথেষ্ট পরিমানে নয়। পার্টি ছিল শেষ কথা, যেটা গণতন্ত্রকে খর্ব করেছে, করছে। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ - এসব হল জাতীয় সম্পদে মানুষের অধিকার, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। তবে এ সব ব্যবস্থাতেই মানুষই নিজের ভাগ্যবিধাতা। পুঁজিবাদে ব্যক্তি মানুষ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদে কালেক্টিভ মানুষ। যেহেতু সব কিছুর পরে মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তাই সমাজতন্ত্রের সমষ্টি মানুষের ধারণা এক সময় ঠিক কাজ করে না। তখন গণতন্ত্র বিশেষ ভাবে দরকার হয়। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দুর্গতির উপর। দেশে দেশে আজ যে যুদ্ধ, ধ্বংস এসব পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের টিকিয়ে রাখতে চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের উপর। তবে এটা ঠিক সমাজতন্ত্রের বর্তমান প্রেক্ষাপট পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সেটা শুধু তত্ত্বের দুর্বলতা নয়, প্রয়োগের দুর্বলতাও।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি