জানা অজানা

ছোট কাকাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম "বিশ্বাসে মিলায় হরি তর্কে বহুদূর।" এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে তর্ক করে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না, তাঁকে পেতে হবে বিশ্বাস করে। কিন্তু সমস্যা হল, তর্ক না করলে, প্রশ্ন না করলে সব বিশ্বাসই একদিন অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হতে বাধ্য। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, "তাহলে আমরা কি দুইয়ের সাথে দুই যোগ করলে চার হবে সেটাও অবিশ্বাস করব?" অবিশ্বাস করতেই পারেন, তবে আপনি চাইলেই এটা যে সত্য তা প্রমাণ করতে পারবেন। এখানে কথা হচ্ছে সেসব নিয়ে যা আমরা চাইলেই প্রমাণ করতে পারি না। আপনাকে অবিশ্বাস করতে হবে বা সন্দেহের চোখে দেখতে হবে সেটাই যেটা আপনি চাইলেই যখন খুশি তখন প্রমাণ করতে পারবেন না। তবে এটাও ঠিক দুয়ে দুয়ে চার বিশ্বাস করবেন বলেই বিজ্ঞান বইয়ে যা কিছু লেখা আছে আপনাকে সেটাই বিশ্বাস করতে হবে এমন কোন কথা নেই। সেখানে অনেক কিছুই আছে যা এক পরিস্থিতিতে সঠিক হলেও ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঠিক নয়। যেমন ত্রিভূজের তিন কোণের সমষ্টি। স্কুলে আমরা পড়ি সেটা দুই সমকোণ। তবে এটা সত্য শুধুই সমতলে। বক্রতলে সেটা ঠিক নয়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে বিজ্ঞানে বিশ্বাস আমরা করব বটে তবে সময়ে সময়ে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলব, আমাদের জ্ঞান সঠিক কিনা সেটা ঝালাই করে নেব, যাচাই করে নেব। কিন্তু তর্কে যদি বহুদূরই হয় তাহলে কি আমরা কখনই লক্ষ্যে পৌঁছুব না? প্রশ্ন হল, লক্ষ্যটা কী? জ্ঞান অর্জন করা নাকি অন্য কিছু?  কেউ কিন্তু বলছে না আমি এ মুহূর্তে যেটা জানতে চাইছি সেটাই শেষ, এর বাইরে অজানা কিছু নেই, থাকবে না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে অনেক বিজ্ঞানীই ভাবতেন "পরম কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের" (absolute black body radiation) মত আরও দু একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই পদার্থবিদ্যার আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। কিন্তু কী দাঁড়ালো? ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আবিষ্কার করলেন কোয়ান্টার - আমরা পেলাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এর পরে প্রশ্ন করতে করতেই এলো আপেক্ষিক তত্ত্ব। এসব নতুন নতুন তত্ত্ব আমরা পেয়েছি পুরনো তত্ত্বে সন্দেহ করে। উত্তর পেয়েছি। কিন্তু তাতে প্রশ্নের শেষ হয়নি, জেগে নতুন প্রশ্ন, সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অজানার নতুন হিমালয়। বিশ্বাস করা মানে তাই জানা নয়, নিজের অজানাকে সিমেন্ট করা, অজ্ঞানতার মূর্তি গড়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে তাঁর পূজা করা। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাদের কাছে তিনি সর্ব শক্তিমান, সর্বজ্ঞানী, তাঁকে জানতে হলেও তো আপনার জ্ঞান দরকার। আচ্ছা বলুন তো, একজন অশিক্ষিত মানুষ কি একজন শিক্ষিত মানুষের সাথে সমানে সমানে কথা বলতে পারবে? না, আমি অশিক্ষিত মানুষকে ছোট করতে চাইছি না। "ষোল আনাই মিছে" কবিতা এখনও মনে আছে। একজন পেলে ফুটবল সম্পর্কে অনেক জানলেও তিনি কিন্তু রোগের ব্যাপারে যেকোনো ডাক্তারের চেয়ে অনেক কম জানেন। মানে হচ্ছে, আপনি যদি কাউকে জানতে চান, তাঁর সাথে সমানে সামনে কথা বলার জ্ঞানটুকু থাকতে হবে।  আর তিনি যদি সর্বজ্ঞ হন, বুঝতেই পারছেন আপনার জানার পরিমাণ কত বিশাল হওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন না করে আপনি সে জ্ঞান কোথায় অর্জন করবেন? তাই বলছি কি, বিশ্বাস না করা কঠিন, তবে বিশ্বাস করা আরও কঠিন যদি আপনি সত্যি সত্যি আপনার বিশ্বাসটা শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করাতে চান। প্রশ্ন করুন।


দুবনা, ১৬ অক্টোবর ২০২০ 




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি