নাগোরনি কারাবাখ – ককেসাসের কাশ্মীর?
নাগোরনি কারাবাখে ঐতিহাসিক ভাবে নন-ইন্দোইউরোপিয়ান জাতি গোষ্ঠীর লোকজন বাস করত। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা দ্বিতীয় শতকে এই এলাকা গ্রেট আর্মেনিয়ার অধীনস্থ রাজ্যে পরিণত হয়, তবে চতুর্থ শতাব্দীতে আর্মেনিয়া কয়েক ভাগে বিভক্ত হলে এই অঞ্চল পারস্যের দখলে চলে যায়। সপ্তম শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত এই এলাকা ছিল আরবদের অধীনে। নবম থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত সেটা পুনরায় সামন্তবাদী আর্মেনিয়ার অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয়। সপ্তদশ শতকের শুরু থেকে অষ্টদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কারাবাখ আর্মেনিয়ার হামসিদের অধীনে ছিল, যারা নিজেরা ছিল সেফেভিদ আর আফশারিদভদের করায়ত্ব। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর্মেনীয় জনগণ নিয়ে নাগোরনি কারাবাখ খানদের অধীনে আসে আর ১৮১৩ সালে গুলিস্তান শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে খান হল মধ্য এশিয়ার তুর্ক-মঙ্গলীয়দের টাইটেল। প্রথমে এ দ্বারা কোন গোষ্ঠী প্রধানকে বোঝানো হত, পরে খান বলতে শাসককেই বোঝানো হয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যে সুলতানকেও খান বলে সম্বোধন করা হত।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯০৫-১৯০৭ আর ১৯১৮ – ১৯২০ সালে এখানে দুই দুইবার আর্মেনীয় ও আজারবাইজানীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। রুশ সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগ নিয়ে সে সময় ককেশাসে তিনটি নতুন রাজ্য জন্ম নেয় – জর্জিয়া, আর্মেনিয়া আর আজারবাইজান। তবে সে সময় এদের আকার বর্তমানের মত ছিল না। আর্মেনীয় প্রধান কারাবাখ আজারবাইজানের সাথে থাকতে অস্বীকার করলে আবার শুরু হয় সংঘর্ষ। তখন বলশেভিকদের মধ্যস্থতায় একটা চুক্তি হয় দুই পক্ষের মধ্যে। এতে করে নাগোরনি কারাবাখ আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে মূলত আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত আরও চারটে এলাকা যোগ করে আজারবাইজানের অধীনে নাগোরনি কারাবাখ অটনোমাস রিপাবলিক গঠন করা হয়। ১৯৩৭ সালে আজারবাইজান আর্মেনীয় ভাষাকে নাগোরনি কারাবাখের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়। কোর্ট কাছারির কাজে ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আর্মেনীয় ভাষায় প্রকাশ করা শুরু হয়। ১৯৬০ এর দশকে আর্থ-সামাজিক উত্তেজনা কখনও কখনও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের রূপ নেয়।
১৯৮০ দশকের মধ্যভাগের আগে পর্যন্ত নাগোরনি কারাবাখের স্ট্যাটাস পরিবর্তন সম্পর্কিত কোন খবর জনসম্মুখে তেমন আসত না আর পরিবর্তনের যেকোনো প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হত।
তবে ১৯৮৫ সালের পর থেকে যখন
পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্তের দমকা হাওয়া চারিদিকে বইতে শুরু করে এসব ঘটনা ধামাচাপা
দিয়ে রাখা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ে। নাগোরনি কারাবাখের আর্মেনিয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ
বাড়তে শুরু করে। তারা এই অটোনমির আর্থসামাজিক পশ্চাৎপদতার জন্য আজারবাইজানের শাসক
গোষ্ঠীকে দায়ী করে। ১৯৮৫-১৯৮৬ সালে শুরু হয় সংঘর্ষ। ১৯৮৭ সালে আর্মেনীয় সম্প্রদায়
এই অঞ্চলকে বাকুর পরিবর্তে এরেভানের অধীনে দেওয়ার জন্য গরবাচেভের কাছে খোলা চিঠি
লেখে। ১৯৮৭ সালের শুরুতে এরেভানে পরিবেশ সংরক্ষণের দাবীতে আয়োজিত অসংখ্য মিটিং-এ বক্তারা নাগোরনি কারাবাখ আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানায় এবং এই
লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকারের প্রতি একাধিক লিখিত আবেদন প্রেরণ
করে। গঠিত হয় কারাবাখ কিমিটি। মস্কোয় পার্টি, প্রশাসন ও বিভিন্ন শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চপদস্থ আর্মেনীয়রা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। গরবাচেভের
সাথে ঘনিষ্ঠ অনেকের নামই সামনে চলে আসে। দাবী ওঠে নাগোরনি কারাবাখে আর্মেনিয়ার
টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচারের আর এখানকার স্কুলে
আর্মেনিয়ার ইতিহাস পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করার।
সোভিয়েত সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ বিদ্যমান জাতীয় ও আঞ্চলিক
সীমানা পুনর্বিন্যাস করে কোন নজীর সৃষ্টি করতে চায়নি বলে এই দাবীকে জাতীয়তাবাদী
দাবী বলে আখ্যায়িত করে এবং তা যেমন সোভিয়েত সমাজের আন্তর্জাতিকতাবাদ তেমনি
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মতামত
ব্যক্ত করে। সোভিয়েত নেতৃত্ব ভয় করেছিল যে চাপের মুখে এ ধরণের দাবী মেনে নিলে সেটা
নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে, যা পরিণামে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের কারণ হতে পারে। এ
থেকেই বোঝা যায়, আপাত দৃষ্টিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আঞ্চলিক ও জাতিগত বন্ধন প্রচণ্ড
দৃঢ় মনে হলেও সেটা ছিল কতটা ভঙ্গুর আর এ ব্যাপারে দেশের নেতৃবৃন্দ খুব ভালভাবেই
অবগত ছিলেন।
আসলে ঐ সময়ে, মানে ১৯৮৭-৮৮ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জাতিগত প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ প্রশ্নগুলো আগে যে ছিল না তা নয়, তবে যেহেতু পেরেস্ত্রইকা প্লাসনস্তের আগে ভিন্ন মত প্রকাশের কোন সুযোগ ছিল না, তাই প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা যেত মানুষের রান্না ঘরে আর আনেকদোতের ভাষায়। গরবাচেভের শাসনের প্রথম দিকে মানুষ নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল। ব্রেঝনেভ
শেষের দিনগুলোয় ছিলেন জীবন্মৃত। এরপর চেরনেঙ্কো, আন্দ্রপভ – এরাও জড়া জীর্ণ। অনেক
দিন পর তারা গরবাচেভের মধ্যে নিজেদের মানুষ খুঁজে পেল, যে দৃঢ় পদক্ষেপে চলতে পারে,
কাগজ ছাড়া কথা বলতে পারে। জনপ্রিয়তার এই পর্যায়ে আসে চেরনোবিলের বিপর্যয়। এসবই
জাতিকে একত্রিত করে। কিন্তু এরপর শুরু হয় কেন্দ্রবিমুখী গতি। প্রিবাল্টিক,
জর্জিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া। এদিকে মধ্য এশিয়া, যেখানে এতদিন পার্টির স্থানীয়
নেতৃবৃন্দ সামন্ত জমিদারদের মত প্রজাতন্ত্র শাসন করতেন, সেখানে পরিবর্তন আনতে
গিয়েও মস্কো জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়। এক কথায় সারা সোভিয়েত ইউনিয়ন
জুড়ে বয়ে যায় জাতীয়তাবাদী বাতাস। ১৯৮৮ সালে আর্মেনিয়ার লেনিনাকানে ভূমিকম্পে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। সোভিয়েত জনগণ আবার সব ভুলে বাড়িয়ে দেয়
সাহায্যের হাত। মনে পড়ে
আমি নিজেও কিছু জামাকাপড় দিয়েছিলাম কমসোমলের ত্রান তহবিলে। মনে হয় এই ভূমিকম্প
অন্য খেলাও খেলে। যেকোনো দুর্যোগে সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে থেকে আরও বেশি দাবি
করে, সরকার যাই করুক না কেন, সব সময় অসন্তোষ প্রকাশ করে। আর্মেনিয়ার উপর নেমে আসা
এই বিপদ আর্মেনিয়ানদের শুধু দুর্যোগের বিরুদ্ধেই ঐক্যবদ্ধ করে না আজারবাইজানের
বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ করে। আচ্ছা, ১৯৭০ সালে উপকূলীয় ঝড় যা হাজার হাজার প্রাণ বিনষ্ট
করে সেটা কি পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণা আরও তীব্রতর করেছিল,
স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও কাছে নিয়ে এসেছিল?
১৯৮৭ সালে উত্তেজনা চরমে ওঠে। নাগোরনি কারাবাখ থেকে আজারবাইজানীরা পালাতে শুরু করে। উদ্বাস্তু শিবির গড়ে উঠতে থাকে বাকুর উপকণ্ঠে। তবে আর্মেনিয়ার মতে সেটা শুরু হয় ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এ সময়ই ঘটে প্রথম সংঘর্ষ, প্রথম রক্তপাত। ১৯৮৯ সালের ১২ জানুয়ারি নাগোরনি কারাবাখে মস্কোর সরাসরি শাসন আরোপ করা হয়, জারী করা হয় জরুরী অবস্থা।
১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান বর্ডারে শুরু হয় সশস্ত্র সংঘর্ষ। ১৯৯১ সালের ১৭ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকিয়ে রাখার পক্ষে রেফারেন্ডাম
অনুষ্ঠিত
হয়। আজারবাইজানের শাসক গোষ্ঠী এতে সমর্থন জানালেও আর্মেনিয়ার শাসকেরা সেখানে রেফারেন্ডাম বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। শুধু নাগোরনি কারাবাখ নয় আবখাজিয়া, দক্ষিণ অসেতিয়া, প্রিদনেস্ত্রভ, আজারিয়া – এরকম বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরি হয়
যুদ্ধাবস্থা। সে সময় মস্কোর নিজের অবস্থায়ই টালমাটাল। এছাড়া অনেক রাজ্যেই ক্ষমতায়
সোভিয়েত বিরোধী, পশ্চিমা বিশ্বের মদদ পুষ্ট সরকার। এমতাবস্থায় ১৯৯৩ সালে জাতি সংঘ
নাগোরনি কারাবাখের উপর চারটে রেজুলেশন গ্রহণ করে যার কোনটাই আর্মেনিয়া কর্তৃক
পালিত হয় না। ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় ওএসসিই (ইউরোপিয়ান
নিরাপত্তা সংস্থা) গ্রুপ, যাদের উপর ন্যস্ত করা হয় এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব।
রাশিয়া, ফ্রান্স ও আমেরিকার নেতৃত্বে এ গ্রুপ সাময়িক ভাবে হলেও দু পক্ষকে আলোচনার
টেবিলে বসাতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে যেটা কাজ করেছে সেটা আজারবাইজানে আলিয়েভের আর
আর্মেনিয়ায় রুশপন্থীদের ক্ষমতায় আসা। যেহেতু দু পক্ষই রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক
রাখতে আগ্রহী – তাই ছোটোখাটো সমস্যার পরেও এক ধরণের যুদ্ধবিরতি বজায় ছিল।
আজারবাইজানে আলিয়েভ বংশের ক্ষমতা মোটামুটি শক্ত ভিত্তির উপরে থাকলেও আর্মেনিয়ায়
সেটা ছিল না। বেশ কয়েকবার ক্ষমতা বদল হয়েছে, তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত
মস্কোপন্থীরাই সরকার গঠন করেছে। আর্মেনিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ান সেক্ষেত্রে ভিন্ন শিবিরের। ক্ষমতায় এসেই তিনি
মস্কোর সাথে সম্পর্ক শীতল করতে শুরু করেন, যদিও পরবর্তীতে সে পথ ত্যাগ করতে বাধ্য
হন বা আপাতত বন্ধ করেন। প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর উপর আমেরিকা বা ইউরোপ
সব সময়ই বিশেষ দৃষ্টি রেখেছে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে রাখার নীতি থেকে। অনেকের ধারণা আর্মেনিয়ার ক্ষেত্রে ইরান
ফ্যাক্টর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। পূব দিক থেকে আফগানিস্তান, পশ্চিমে ইরাক,
তুরস্ক, দক্ষিণে সৌদি আরব, কাতার, কিন্তু উত্তর একেবারেই ফাঁকা। আমেরিকার তাই
আর্মেনিয়াকে খুবই দরকার ইরানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যে। এদিকে তুরস্ক নিজের
স্বার্থে আজারবাইজানকে উস্কে দিয়েছে। রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার সম্পর্কের শীতলতা
আজারবাইজানকে সাহস যুগিয়েছে। এদিকে হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সিগ্ন্যাল পেয়ে (হতে
পারে বেলারুশ আর নাভালনি কেন্দ্রিক ঘটনাবলীর ঘোলা জলে) পাশিনিয়ান নাগোরনি কারাবাখকে আর্মেনিয়ায় অভিন্ন অংশ বলে দাবী করেন। যার ফল আজকের এই অচলাবস্থা। দু
পক্ষই পরস্পরকে অগ্রহণযোগ্য শর্ত দিচ্ছে। তুরস্ক আর পাকিস্তান দুই প্রতিবেশির এই
আঞ্চলিক দ্বন্দ্বকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। সিরিয়ায় লড়াইরত ইসলামিক
স্টেটের সন্ত্রাসীরা আসছে এই যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধ করতে। তবে ভাবার
কারণ নেই এরা আলিয়েভকে পছন্দ করে।
এদের পরবর্তী আঘাত যদি আলিয়েভের উপর হয়, অবাক হবার কিছু থাকবে না। এছাড়া তুরস্ক
সুন্নী শাসিত, আজারবাইজান শিয়া প্রধান। অবস্থাদৃষ্টে
মনে হয় এ সমস্যার আশু সমাধান নেই। বলা যায় এটা ককেসারের কাশ্মীর। সাধারণ মানুষ
অন্যদের হাতে জিম্মি। এক সময় সুযোগ ছিল লাইন অফ কন্ট্রোলকে আন্তর্জাতিক সীমানা
হিসেবে মেনে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি করা যাতে উভয় অঞ্চলের
কাশ্মীরীরা অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। তাতে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ তো বটেই দুই
দেশের মানুষও লাভবান হত। সামরিক ব্যয় কমত। গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটত। আচ্ছা পাকিস্তানে
কি কম মুসলমান মানবেতর জীবন যাপন করছে বা ভারতে কি কম হিন্দু অনাহারে, অচিকিৎসায়
মরছে? নিজের দেশের নাগরিকদের যখন মানবিক অধিকারের গ্যারান্টি দিতে পারছ না, কী
দরকার এই শত্রুতা জিইয়ে রেখে? তুরস্কের সবাই কি ভালো আছে? কুর্দিরা কি মুসলমান নয়?
যত দিন না দেশে দেশে সাধারণ মানুষ বুঝবে ধর্মের নামে, জাতির নামে প্রতিবেশিদের
সাথে শত্রুতা বজায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলো আসলে তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খায়,
তাদের উপর শোষণের চাকাটা আরও জোরেশোরে ঘোরায় ততদিন এটা চলতেই থাকবে।
বর্তমানে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে কোথায় এর শেষ সেটা মনে হয় কেউই জানে না। তুরস্ক যুদ্ধের পক্ষে উস্কানি দিয়েই চলছে। ভালদাই ক্লাবের ডাইরেক্টর, “গ্লোবাল পলিটিক্সে
রাশিয়া” জার্নালের সম্পাদক ফিওদর লুকিয়ানভের মতে তুরস্কের মূল কাজ হচ্ছে একদিকে রাশিয়া আর আর্মেনিয়া, অন্যদিকে তুরস্ক আর আজারবাইজান এ ভাবে সমস্ত ঘটনাকে উপস্থাপন করা। ঘটনা এভাবে গড়ালে আজারবাইজানের উপর রাশিয়ার প্রভাব কমবে যা কোন মতেই করতে দেওয়া যাবে না। যদিও বাইরে থেকে মনে হতে পারে রাশিয়া খুব ঢিলেঢালা ভাবে এ সমস্যা নিয়ে সামনে এগুচ্ছে, লুকিয়ানভের বিশ্বাস লোক চক্ষুর আড়ালে ভেতরে ভেতরে অনেক কিছুই হচ্ছে। সেরগেই কুরগিনিয়ানের
মতে আর্মেনিয়া বর্তমান রাজনীতি না বদলালে চিরদিনের জন্য কারাবাখ হারাবে, কেননা পাশিনিয়ান
যদি ভাবেন আমেরিকা তাঁর পাশে দাঁড়াবে আর আর্মেনিয়াকে ন্যাটোতে নেবে সেটা হবে ভুল ধারণা।
কেননা সেক্ষেত্রে আজারবাইজান ন্যাটোতে যোগ দেবে আর পশ্চিমা বিশ্ব সেক্ষেত্রে আজারবাইজানের
আঞ্চলিক অখণ্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষেই বলবে। আলেক্সাদর কারাগানভ আক্টিভ ডিপ্লম্যাসির
পক্ষে এবং কোন অবস্থাতেই সেখানে রুশ শান্তি রক্ষা বাহিনী পাঠানোর বিপক্ষে। ইয়েভগেনি
সাতানভস্কির মতে ইউক্রাইন আর বেলারুশের পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধ রাশিয়ার
অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। করোনাসহ বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় মানুষ এমনিতেই কোণঠাসা,
এর উপর আবার দক্ষিণে এ ঘটনা রুশদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। তবে যুদ্ধ কোন সমাধান
নয়। এক কথায় যেসব রাজনৈতিক ভাষ্যকার রাশিয়ার রাজনীতিতে কিছুটা হলেও প্রভাব রাখে তাঁরা
আজ দ্বিধাবিভক্ত। উল্লেখ করা যেতে পারে সরকারি হিসেব অনুযায়ী রাশিয়ায় প্রায় ২০ লাখ
আজারবাইজানী ও ২০ লাখের বেশি আর্মেনিয়ান বসবাস করে। তাদের একটা বিরাট অংশ বিভিন্ন ব্যবসায়ের
সাথে জড়িত। অনেকেই রাশিয়ার বরেণ্য বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, গায়ক, সমাজের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।
এর মধ্যে অনেকেই কেউ বা বাকুর পক্ষে কেউ বা এরেভানের পক্ষে কথা বলছে। সব মিলিয়ে অবস্থা
দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে রুশ সমাজেও উত্তেজনা বাড়বে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে
রুশ টেলিভিশনে নাগোরনি কারাবাখের কনফ্লিক্ট নিয়ে আলোচনার সময়
উত্তেজিত না হওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে।
রাশিয়া আর পশ্চিমা বিশ্ব আলচনার আহ্বান জানিয়েছে দু পক্ষকেই। এর মধ্যে দুই ধাপ আলোচনা হয়েছে মস্কোও পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ে। যুদ্ধ বিরতিতে রাজী হলেও বাস্তবে সেটা ঘটেনি। ফলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে মাঠে নামতে হয়েছে। অনেক টালবাহানার পরে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ আর আর্মেনিয়ার প্রধান মন্ত্রী পাশিনিয়ান রাজী হয়েছেন মস্কোয় আলোচনায় বসতে। আশা করা যেতে পারে সাময়িকভাবে হলেও যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হবে। কিন্তু যেকোনো সাময়িক সমাধান মানে সমস্যাটা জিইয়ে রাখা। আজ হোক কাল হোক সেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে আর তখন যদি পুতিন বা শইগুর মত অথরেটিভ কেউ না থাকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ অকারণে মারা যাবে। এটাই হয়ে আসছে দেশে দেশে। রুশরা বলে সব যুদ্ধই শেষ হয় শান্তি দিয়ে। কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য সব শান্তিই শেষ হয় যুদ্ধ দিয়ে। রাজনীতিবিদদের কাজ এই শান্তির সময়টা যতদূর সম্ভব প্রলম্বিত করা আর আইডিয়ালে আর কখনই
যাতে যুদ্ধাবস্থা তৈরি না হয় সে ব্যবস্থা করা। আনুষ্ঠানিক ভাবে নাগোরনি কারাবাখ আজারবাইজানের টেরিটোরি। বাস্তবে
সেটা আর্মেনিয়ার দখলে। সেখানে আর্মেনিয়ানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এসব ফ্যাক্টর মাথায় রেখেই
সমাধান খুঁজতে হবে। নাগোরনি কারাবাখ যদি স্বাধীন হয় সেটা হবে আর্মেনীয়দের দ্বারা শাসিত
দেশ। তা হবে গণতান্ত্রিক ভাবেই। সেটা কি স্থানীয় আজারবাইজানীরা মেনে নেবে? না নিলে
আবার রক্তক্ষয়, আবার দুই দেশের যুদ্ধ। তবে কি আজারবাইজান আর আরমেনিয়ায়র মধ্যে দেশ ভাগ
করে দেওয়া? ভ্লাদিমির ঝিরিনভস্কি অন্তত সে কথাই বলছেন। এখানেও সমস্যা – কারণ সেই ভারত বিভাগের মতই জনগণকে স্থানান্তরিত করতে হবে, নইলে সৃষ্টি হবে ছিটমহল। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে হয়তো এরকম কোন সিদ্ধান্তই নিতে হবে। আর সেটা হতে হবে নাগোরনি কারাবাখের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সম্মতিতে, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক, ইরানসহ আন্তর্জাতিক কমিউনিটির মধ্যস্থতায়।
দুবনা, ২০ অক্টোবর ২০২০
Comments
Post a Comment