নির্বাচনের যোগ বিয়োগ
আর মাত্র কয়েক দিন পরে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফেসবুকে বন্ধুরা এ নিয়ে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিচ্ছে। আমি আদার ব্যাপারী, এসব জাহাজের খবর রাখা আমার জন্য কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন আসতেই পারে। তবে সমস্যা হল আমেরিকা বলতে গেলে ঈশ্বরের মতই সর্বভূতে বিদ্যমান। তার কলেবর, বিশেষ করে জাতীয় স্বার্থ আকাশের মতই অন্তহীন। এতই বড় যে আমার কিচেন, আমার বেডরুম কোন কিছুই তার জাতীয় স্বার্থের বাইরে নয়। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ একবার বলেছিলেন, রাশিয়া আগের জায়গাতেই আছে, কিন্তু আমেরিকা আমাদের বাড়ির পাশে সামরিক ঘাটি গেড়ে অভিযোগ তুলছে যে রাশিয়া নাকি তার দোর গোরায় হাজির হয়েছে। আমারও সেই অবস্থা। আমি ভাবি আর নাই ভাবি, আমেরিকা আমাকে ভাবায়।
আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে এদেশের টিভিতেও
অনেক কথাই বলা হয়। তবে গত নির্বাচন নিয়ে যতটা উত্তেজনা ছিল, এখন সেটা নেই বলেই মনে
হয়। ওবামা প্রশাসন শেষের দিকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার উপর। ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ক্লিনটন আগ্রাসী ভাষায় রাশিয়া তথা পুতিনকে আক্রমণ
করেন। ফলে এমন কি যারা রিপাবলিকান পার্টি বিরোধী তারাও প্রকাশ্যে বা মনে মনে ট্রাম্পের
জয় চেয়েছে। তাদের ধারণা ছিল দু দেশের সম্পর্ক তাহলে উন্নতির দিকে যাবে। তবে ট্রাম্পের
নিজের কারণেই হোক আর ডেমোক্র্যাটিক পার্টিসহ লিবেরাল মিডিয়ার কারণেই হোক, বিগত চার
বছরে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক ঐতিহাসিক মিনিমামে পৌঁছেছে। এমন কি ট্রাম্প নিজে পর্যন্ত
বলেছেন যে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট
তা করেননি। তাই এবার ট্রাম্পের প্রতি আগের মোহ নেই। তবে বাইডেনের ছেলের সাথে ইউক্রাইনের
ব্যবসায়িক সম্পর্ক যে রাশিয়ার জন্য ভালো হবে না সেটাও তারা বোঝে। যদি গত নির্বাচনে
দুই ডেভিলের মধ্যে তুলনামূলক
কম ডেভিলকে চয়েজ করার অপশন
ছিল, এবার শয়তানিতে কেউ কারও চেয়ে কম নয় – তাই কোন চয়েজই সুখের নয়। রুশদের জন্যে এ যেন ফাঁসি আর ইলেকট্রিক চেয়ারের মধ্যে
চয়েজ।
একটা সময় ছিল যখন এ দেশের মানুষ ভাবত ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতায় থাকলে সেটা রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ভালো। তার একটা কারণ ছিল আদর্শগত। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেমন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হত, রাজনীতি ছিল সব কিছুর পরেও স্যোশাল ওরিয়েন্টেড, ডেমোক্র্যাট পার্টিও সে কথাই বলে। যদিও বাস্তবে ডেমোক্র্যাট কেনেডির সময়েই এসেছে ক্যারিবিয়ান ক্রাইসিস, ক্লিনটনের সময় যুগোস্লাভিয়ায় বোমাবর্ষণ, তারপরেও সোভিয়েত আর রুশ সমাজে তাদের প্রতি সিম্প্যাথি অনেক বেশি ছিল সেদিন পর্যন্তও। ওবামা আমলে শুরুটা ভালো হলেও একের পর এক অ্যান্টি রাশিয়ান পদক্ষেপ সমস্ত স্বপ্নের গুড়ে বালি দেয়।
তবে যেহেতু বিগত সময়ে দু দেশের সম্পর্ক যারপর নাই খারাপ হয়েছে এখন রাশিয়ার জন্য কোন দল ক্ষমতায় আসবে সেটা তেমন কোন গুরুত্ব রাখে বলে মনে হয় না। কয়েকদিন আগে এক ইন্টারভিউতে পুতিন বলেন, বর্তমান প্রশাসনের আমলে রুশ মার্কিন সম্পর্ক যতটা শীতল হয়েছে সেটা আগে কখনও হয়নি। তবে এটাও ঠিক অনেক দিন পরে এই প্রশাসন কোন যুদ্ধ শুরু করেনি। আবার তারা বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে, START III ভাগ্য এখন ঝুলছে। অন্যদিকে প্রার্থী বাইডেন এই
চুক্তি নবায়নের পক্ষে বলেছেন। পুতিনের এই কথা বাইডেনের পক্ষে ওকালতি কিনা জানি না,
তবে মনে হয় ক্রেমলিন দু দেশের সম্পর্কের বর্তমান অচলাবস্থায় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। লাভরভ
কয়েকদিন আগে এও বলেছেন যদি ইউরোপ কথা বলতে না চায় তাহলে ভাবতে হবে আমাদেরও তাদের সাথে
কথা বলার দরকার আছে কি না। এমতাবস্থায় কী বাইডেন কী ট্রাম্প – যেই প্রেসিডেন্ট হক না কেন, দু দেশের সম্পর্কে উনিশ বিশ হবে বলে মনে হয় না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করার এক পর্যায়ে নতুন করে গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হই। বঙ্গবন্ধু
থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতাকে দেখার সুযোগ এসেছে, কিন্তু কখনই
দেখতে যাওয়ার আগ্রহ অনুভব করিনি। রোনাল্ড রিগ্যান একমাত্র রাজনীতিবিদ যাকে দেখার জন্য
লেনিনস্কি প্রস্পেক্টে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এটা রিগ্যানের জন্য নয়, তখন মনে হয়েছিল মার্কিন
গণতন্ত্র বিশ্বের জন্য বেটার অপশন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আশা ছিল আদর্শগত
মতানৈক্য যেহেতু অনেকটাই দূর হল, এবার হয়তো আমেরিকা আর রাশিয়া হাতে হাত রেখে কাজ করবে,
বিশ্বের সার্বিক উন্নতির জন্য মাঠে নামবে। কিন্তু বাস্তব দাঁড়ালো অন্য রকম। বরং রাশিয়াকে
কিভাবে কোণঠাসা করা যায়, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতই রাশিয়াকেও
মুছে দেওয়া যায় সেই খেলায় মেতে উঠল পশ্চিমা বিশ্ব। ওয়ারশ জোট পতনের পর ন্যাটোর উপস্থিতি কী খুবই
প্রয়োজনীয় ছিল? এমন কি মৌখিক আশ্বাস দেওয়ার পরেও ন্যাটো জোট সম্প্রসারিত করে রাশিয়ার
দোর গোরায় আনা হয়েছে। আর এ সবের কারণেই ২০০৭ সালের পর থেকে শুরু হয়েছে নতুন স্নায়ু
যুদ্ধ। গণতন্ত্র, সমানাধিকার – এসব শুধুই বিশ্বাসীদের (পড়ুন বোকাদের) জন্য। ধর্ম ব্যবসায়ীরা
যেমন পরলোকের কথা বলে ইহ লোকে মানুষকে ভেড়া বানিয়ে রাখে, গণতন্ত্রের ব্যবসায়ীরাও তেমনই
গণতন্ত্রের কথা বলে, সমানাধিকারের কথা বলে কোটি কোটি মানুষকে ধোঁকা দেয়। বেশ আগে বাইডেনের
এক ইন্টার্ভিউ দেখেছিলাম, যেখানে তিনি কিভাবে পারাসেঙ্কোকে দিয়ে ইউক্রাইনের এটর্নি
জেনেরেলকে সরালেন সে নিয়ে দম্ভ করছিলেন। এদেশে প্রায়ই বিভিন্ন খুনীদের উপর ডকুমেন্টারি
ফিল্ম করে। তাদের একজন চিকাতিলো। এই লোক জীবনে প্রচুর নারীকে ধর্ষণের পর খুন করেছে,
কিন্তু বাড়িতে সে ছিল অমায়িক স্বামী, পিতা। আমেরিকার বিগত দিনের শাসকেরা যারা ইরাক,
লিবিয়া, সিরিয়া সহ বিভিন্ন দেশে হয় নিজেরা অথবা অন্যদের হাত দিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা
করেছেন দেশে তারা গণতন্ত্রের মানসপুত্র।
অবাক লাগে যখন শিক্ষিত, চিন্তাশীল মানুষ এদের পেছনে দাঁড়ায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের
নেতাদের আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির করালেও আমেরিকা নিজে কিন্তু এই আদালত মানে না। অর্থাৎ
সে নিজেকে সব সময়েই আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার
বলার অধিকার কতটুকু সেটাও ভেবে
দেখা দরকার।
নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ায় ভোটের ব্যালটে এক প্রার্থীর নাম ছিল – “সবার বিরুদ্ধে”,
মানে যদি কারও কোন প্রার্থী পছন্দ না হয় তবে সে চাইলে এই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিজের
মতামত জানাতে পারত। যদি কোথাও এই প্রার্থী প্রথম স্থান অধিকার করত তখন নতুন করে নির্বাচন হত। এর ফলে ভ্লাদিভস্তকে
এক সময় অচলাবস্তার সৃষ্টি হয়, বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেও সেই শহরের মেয়র নির্বাচন করা
যায়নি। পরে ব্যালট পেপার থেকে সেই প্রার্থীর নাম কেটে দেওয়া হয়। এই প্রথম মনে হচ্ছে
বর্তমান পরিস্থিতিতে এ রকম একটা অপশন থাকা দরকার ছিল। আমি অন্তত সবার বিরুদ্ধেই ভোট
দিতাম।
কেন? বর্তমান প্রার্থীদের কেউই কি
ভোট পাওয়ার যোগ্য নন? দেশে যখন নির্বাচন হয়, ভোট দিতে না পারলেও আমি কোন কোন দলের পক্ষে
বলি। এর আগে যখন মেয়র নির্বাচন হল বলেছিলাম রতনকে ভোট দিতে। জানতাম জিতবে না, তবুও
আমার মনে হয়েছিল আপাত দৃষ্টিতে ভোট নষ্ট হলেও সেটা হবে ভোটারের সচেতন নির্বাচন, সে
একজন সৎ লোককে ভোট দেবে। হতে পারে প্রার্থী তালিকায় সৎ প্রার্থী আছে, আমি তাঁদের জানি
না, চিনি না। তাই আমার চয়েজ সবার বিপক্ষে ভোট দেওয়া।
কিন্তু তাতে লাভ কী? যদি ট্রাম্প আরও চার বছর থাকে অবস্থা তো আরও খারাপ হবে।
হয়তো। কিন্তু সেটা কি একা আমার সমস্যা? এটা তো আমরা সবাই জানতাম। তাহলে কেন একজন সৎ
প্রার্থী দিতে পারলাম না? আজ বার বার কথা উঠছে রুশ হস্তক্ষেপের। কিন্তু আমেরিকা তো
ঘোষণা দিয়েই বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। ইউক্রাইনে তারা ৫ বিলিয়ন
ডলার খরচ করেছে বলে নিজেরাই ঘোষণা করেছে। রাশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার নামে ঘোষণা দিয়েই অনেক অর্থ ব্যয় করা হয় সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য। যদি আমেরিকার নির্বাচনে প্রভাব ফেলার জন্য অন্য
কাউকে দোষী করা হয় তাহলে নিজেরা কেন অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করাটা দোষের মনে
করে না? আসল সমস্যা হল অনেক কিছুই
নির্ভর করে আমরা কোত্থেকে কোন
কিছু দেখছি তার উপর। দূর থেকে
কোন কিছুকে দেখলে আমরা শুধু সেই বস্তু
বা সমাজ দেখি না দেখি ব্যাকগ্রাউন্ড,
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। ফলে ইচ্ছে অনিচ্ছায় ভাবতে হয় উল্লেখিত বস্তু এই পরিবেশের সাথে
কতটুকু খাপ খাচ্ছে সে কথা। কিন্তু আমরা যখন সেটা খুব কাছ থেকে দেখি, অন্য ধরণের দোষ গুণ আমাদের চোখে পড়ে। দূর থেকে দেখলে যা সুন্দর মনে হয়, কাছে এসে সেটা ততটা ভালো নাও
লাগতে পারে, আবার উল্টোটাও হতে পারে। আমরা নিজেদের যত নিরপেক্ষই মনে করিনা না কেন,
আমাদের দৃষ্টি সব সময়ই সাবজেক্টিভ, কেননা জীবনের অভিজ্ঞতা, পড়াশুনা, বেড়ে ওঠার পরিবেশ
সব কিছুই আমাদের জীবনের উপর এক ধরণের ছাপ রেখে যায়। এটাকে বলা যায় চশমা বা ঠুলি যা প্রতিটি লোক পরে থাকে আর সেই চশমার ভেতর দিয়েই পৃথিবীটা
দেখে। তাই আমি যখন বাইরের কোন দেশে বসে আমেরিকার নির্বাচনের কথা বলব, তখন আমেরিকার
সাথে সেই দেশের সম্পর্ক, বহির্বিশ্বের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের আচরণ এসব বিবেচনায় নিয়েই বলব। এই একই আমি যদি সে দেশে থাকতাম আমার বিশ্লেষণ হত অন্য
রকম, আমার ব্যক্তিগত ভালমন্দের বিচারে, আমার চাকরি, ব্যবসা, কলিগ – এক কথায় মার্কিন
বাস্তবতায় আমার অবস্থানের প্রেক্ষিতে। আমি কিন্তু তখন কে প্রেসিডেন্ট হলে রাশিয়া, বাংলাদেশ
বা অন্য দেশের মানুষের ভালো বা মন্দ হবে সেটা ভাবব না। ইরাকে, সিরিয়ায়,
আফগানিস্তানে বা ইউক্রাইনে যখন লোক মরে সে নিয়ে আমি এখন যেমন ভাবি, তখন তেমন ভাবব না। তখন আমাকে কষ্ট দেবে এখন যাদের হত্যাকারী বলছি তাদের মানে মার্কিন সৈন্যদের মৃত্যু। আমি এটা বলছি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, রেস্ট অফ
দ্য ওয়ার্ল্ডের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে। কিন্তু আমি জানি এমন কি মার্কিন নাগরিক
হলেও আমি আমার মতই ভাবতাম, অন্য দশ জনের মত করে নয়। তার কারণ আমার বিশ্লেষণের বাটখারা
অন্য, যা গণিতের লজিক মেনে চলার চেষ্টা করে। তবে সব কিছুর পরেও আমি ফেসবুকে এই নির্বাচন
নিয়ে লেখালেখি বিশেষ করে বন্ধুদের স্ট্যাটাস খুব এঞ্জয় করছি। নির্বাচন শুধু প্রার্থীদের
জন্য নয় মানুষের জন্যও এক ধরণের লিটমাস পেপার। এখানেই চেনা যায় মানুষটা প্রকৃত কেমন।
কেমন বলতে আমি বলছি সে সত্যিকার বিজ্ঞান মনস্ক কি না। বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের একমাত্র
না হলেও প্রধান কাজ প্রশ্ন করা, প্রশ্ন করে তার উত্তর খোঁজা। প্রশ্ন কাকে করবে? সবার
আগে নিজেকে? তারপর পরিপার্শ্বের সবাইকে। প্রশ্ন করেই সে চাইবে সত্যটা জানতে। আর এই
প্রশ্ন করার ব্যাপারে তাকে অবশ্যই হতে হবে যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ। পক্ষপাতদুষ্ট প্রশ্ন
করে কখনও সত্য জানা যায় না। মহান লক্ষ্যে পৌঁছুন যায় না। আজ আমরা যারা হিলারি ক্লিনটনের
পরাজয়ে রাশিয়ার হাত দেখি তাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিৎ, এটা কীভাবে সম্ভব যে রাশিয়ার
মত একটা দেশ আমেরিকার মত দেশের নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে পারে। অনেক আগে খুব সম্ভবত
২০১২ সালে যখন শেখ হাসিনা মস্কো আসেন, প্রেসিডেন্ট (সাবেক অক্টোবর) হোটেলে বসে গল্প প্রসঙ্গে একজন জিজ্ঞেস করল
আচ্ছা তুমি যে এত আওয়ামী লীগ বিরোধী
স্ট্যাটাস দাও সেটা কিন্তু আনফরচুনেট।
আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখি না, সরকারি দলের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করি। আনফরচুনেটলি
আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। আমি কী করব বল?
না লিখলেই তো হয়।
বা রে, তুমি চুরি করবে তাতে দোষ নেই। আমি তোমাকে চোর বললেই যত ঝামেলা। সব দোষ আমার।
আসলে, যারা রাশিয়ার কাঁধে দোষ চাপাতে চান তাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিৎ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
হিসেবে হিলারি ইমেইল নিয়ে যা করেছেন সেটা ঠিক ছিল কি না? এখানেও আমেরিকা অনেকটা বাংলাদেশের মতই। দেশেও যেমন সব ব্যাপারেই ভারতের কার্ড ব্যবহার করা হয়, আমেরিকায়ও তেমনি কারণে অকারণে রাশিয়ার কার্ড ব্যবহার করা হয়। তাই এমন কি রাশিয়া যদি কিছু নাও করে তার অশরীরী উপস্থিতি সেখানে থাকবেই, সিআইএ, পেন্টাগন, পার্টি এলিট – এরা রাশিয়ার জুজুর ভয় দেখাবেই। এটা অনেকটাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার সুবিধাজনক ব্ল্যাক হোল। এমন কি রাশিয়া যদি কিছু করেও সেটা তো সর্বোপরি মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরই ব্যর্থতা। তাহলে প্রশ্নটা কি তাদেরই করা উচিৎ নয়? আরও একটা কথা। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা যারা রাশিয়ার কারসাজি
বলেন, তারা কি ভেবে দেখেছেন কেন এমন হল? আড়াই শ বছর হতে চলল আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে।
প্রচণ্ড শক্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক ভিত্তির উপরে যে দেশ দাঁড়িয়ে কী করে রাশিয়ার মত একটা
দেশ সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমন প্রভাব ফেলতে পারে? আপনাদের কি মনে হয় না বিগত
কয়েক দশকের কাজকর্মে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট শ্রেনীর উপর বিরক্ত হয়েই এক ধরণের প্রতিবাদী
ভোটে ট্রাম্প জিতে গেছেন? যতদূর মনে আছে এমন কী রিপাব্লিকান পার্টিও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা
করেছে ট্রাম্পকে নমিনেশন না দিতে। দুই দলের এলিটদের বিরোধীতার পরেও তিনি জিতেছেন আমেরিকান
জনগণের একটা বিরাট অংশ দেশের বর্তমান রাজনীতিতে হাতশাগ্রস্থ বলেই। আর সেটাই যদি হয়
ভাবতে হবে নিজেদের রাজনীতি বদলানোর কথা। সংবাদ মাধ্যমকে বলা হয় চতুর্থ শক্তি। তাদের
মূল কাজ ছিল জনগণকে সঠিক সংবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে শাসক শ্রেনীকে সংযত থাকতে বাধ্য করা।
আর আজ? তারাই বলতে গেলে দেশের, সমাজের হর্তাকর্তা। গত নির্বাচনে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী
ছিলেন নিঃসন্দেহে বার্নি স্যাণ্ডারর্স। তাঁকে কি অন্যায় ভাবে প্রাইমারিজে হারিয়ে দেওয়া
হয়নি হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে আসার জন্য? এ প্রশ্ন কে করবে? রাশিয়ার দিকে আঙ্গুল তোলার
আগে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বসদের জিজ্ঞেস করা দরকার কেন তাঁরা সমস্ত জরীপে স্যাণ্ডারর্স
ভালো অবস্থানে থাকার পরেও তাঁকে মনোনয়ন দিল না? সেটা না করে রুশ, চীন, এক্স, ওয়াই,
জেড – এসব অজুহাত খোঁজা অন্ধ বিশ্বাসের পরিচয়, অবৈজ্ঞানিক। এদিকে বাইডেনের সততা নিয়ে
প্রশ্ন উঠেছে। ইউক্রাইনে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি নিজের ছেলেকে উচ্চপদে নিয়োগ
দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে আর এ নিয়ে তদন্ত শুরু হলে সে দেশের এটর্নি জেনারেলকে পদত্যাগে
বাধ্য করেছেন। এটা তো নতুন কথা নয়। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে ইউক্রাইনের পার্লামেন্ট
রাদায় বাইডেনের গ্যাংস্টার সুলভ আচরণ যেটা কোন সভ্য শিক্ষিত মানুষ করবে না। যে দেশ
নিজেকে গণতন্ত্রের রক্ষক মনে করে সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টের এ ব্যবহার দুঃখজনক। আজ
যদি এসব ঘটনা বাংলাদেশে ঘটত আমরা নিজেরাই এর বিরুদ্ধে মহাভারত রচনা করে ফেলতাম। তাহলে
এখন কেন প্রশ্ন করি না? আমার তো বর্তমানে আমেরিকার দুই দলের দ্বন্দ্বকে আওয়ামী লীগ
আর বিএনপির লড়াই বলে মনে হয়। এবারও স্যাণ্ডারর্সকে উপেক্ষা করা হল। কেন? তিনি নাকি
স্যোসালিস্ট। তার মানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হর্তাকর্তাদের কাছে স্যাণ্ডারর্সের চেয়ে
ট্রাম্প বেশি গ্রহণযোগ্য। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না ট্রাম্প তাদেরই একজন? শুনেছি তিনি
এক সময় ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে চাঁদা দিতেন। দুই দলের অনেকের সাথেই বিভিন্ন সময়ে তাঁর
অন্তরঙ্গ ছবি দেখা যায়। আমার বিশ্বাস যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে না দাঁড়াতেন, প্রেসিডেন্ট
না হতেন এখনও পর্যন্ত তাঁদের একজন হয়ে, তাঁদের বন্ধু হয়ে দিন কাটাতেন। তার মানে এটা
আমেরিকার আপার ক্লাসের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব – আমাদের মত মানুষ তাঁদের সেই যুদ্ধের শিকার
মাত্র। আমার বন্ধুদের অনেকেই স্যাণ্ডারর্সের সমর্থক। আপনাদের যখন স্যাণ্ডারর্সের পরিবর্তে
বাইডেনকে খাওয়ান হল, সেটা কি আপনাদের অনুভুতিকে সম্মান দেখিয়ে করা হল। নাকি বাংলাদেশে
যেমন অনেকেই বলে যদি না খারাপ আওয়ামী লীগকে ভোট দাও শাসক হিসেবে পাবে জঘন্য বিএনপিকে।
আমরা কি সারা জীবন এই ভয় পেয়েই কাটিয়ে দেব? আমরা কি নিজেরাই নিজেদের এই দুই দলের চক্রে,
চক্রান্তে বন্দী করে রাখছি না? আমাদের একটাই সময় নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর, সেটা নির্বাচনে,
ব্যালট বাক্সে। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট, পার্টি বস আর অর্থনীতির মহারথীরা কী করছে? আমাদের
এই ট্রাম্প বিরোধী সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে তাদের কুইনানিন আমাদের মুখে পুরে দিচ্ছে।
আমরা গিলছি বা বলা যায় আমরা আমাদের এসব অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়াতে দিচ্ছি। আমাদের গণতান্ত্রিক
অধিকার অগণতান্ত্রিক ভাবে হরণ করা হচ্ছে গণতন্ত্রের নাম সংকীর্তন করে। অথচ আমরা নীরব।
দেশে আমরা প্রায়ই তৃতীয় শক্তির কথা বলি। আমার বিশ্বাস আমেরিকায়ও এখন তৃতীয় শক্তির দরকার।
বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি বা বাম জোট এই তৃতীয় শক্তির কাজ করেছে,
ক্ষমতায় যেতে না পারলেও ক্ষমতাসীনদের দৌড়ের উপর রাখে। তৃতীয় শক্তি না থাকায় দুই দল
ধরেই নেয় তারা যা খুশি তাই করতে পারে। এ যেন সেমিফাইনাল বিহীন ফাইনাল, যেমনই খেল না
কেন, ফাইনালে তোমার টিকেট কনফার্ম। কোনমতে গোল করে জিতলেই হল। আমেরিকা নিঃসন্দেহে প্রায়
সব ক্ষেত্রেই অনেক এগিয়ে থাকা দেশ। এবার কভিড ১৯ এ প্রায় সোয়া দুই লাখ মানুষের মৃত্যু
আবারও বলে সেখানে সব কিছু ততটা স্মুথ নয় যতটা ধারণা করা হয়। যদি কেউ ভাবেন শুধুমাত্র
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট বলেই এত মৃত্যু তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
আমেরিকার সিস্টেম খুব শক্ত। প্রেসিডেন্ট একটা ভালো কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের
মত। তিনি কিছু কিছু যাকে বলে কসমেটিক পরিবর্তন আনতে পারেন, সিস্টেম থামিয়ে দিতে পারেন
না। তাই এত মৃত্যুর কারণ হয় স্বাস্থ্য খাতের অসুস্থতা অথবা দুই দলের রেষারেষি যেমন
আমাদের দেশে হয়, যখন রাজনৈতিক দলগুলো দেশের চেয়ে দলকে বড় মনে করে এমন কি মানুষ পুড়িয়ে
মারতেও দ্বিধা করে না। যতদিন দেশের মানুষ নিজের দলের ব্যর্থতাকে অন্য দল বা অন্য দেশের
হস্তক্ষেপ মনে করবে, যতদিন না তৃতীয় শক্তি গড়ে নিজেদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা তৈরি না
করবে ততদিন এভাবেই চলবে। মনোপলি সব ক্ষেত্রেই খারাপ। মুদ্রার কোন পিঠ নিলেন তাতে কিছুই
এসে যায় না, যদি পিঠ দুটো একই মুদ্রার হয়। প্রগতিশীল, বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের উচিৎ নিজেদের
এসব প্রশ্ন করা। ভোটে যেই জিতুক সেটা যেন তাদের অন্ধ না করে, সেটা যেন তাদের সঠিক প্রশ্ন
করা থেকে বিরত না করে। অনেক দিন থেকেই আমেরিকা যে অবস্থানে আছে তাতে দেশে দেশে বিপ্লব
রপ্তানি না করেই সে রাজার হালে থাকতে পারত, সারা বিশ্বের জন্য উদাহরণ হতে পারত। পুরানো
আমেরিকান সিনেমায় ওয়াইল্ড ওয়েস্টের অনেক রোমহর্ষক ঘটনা দেখেছি। সেখানে জোর যার মুল্লুক
তার – এটাই ছিল জীবন দর্শন। বর্তমান আমেরিকার সমাজ সেখান থেকে অনেক দূরে এগিয়েছে। সমাজ
আজ অর্থে, বিত্তে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে বিশ্বসেরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার
ব্যবহার সেই আগের মতই, এখানে সে আগের মতই পাড়ার মাস্তান – হয় বাহু বলে না হয় ঘুষ দিয়ে
অন্যদের উপর ছড়ি ঘোরায়। এখানেই মনে হয় আমেরিকান গণতন্ত্রের বড় ব্যর্থতা। একমাত্র আমেরিকার
জনগণই পারে তার মাস্তানি বন্ধ করাতে, আমেরিকাকে সত্যিকারের বিশ্বসেরা দেশে পরিণত করতে।
আমরা কথায় কথায় পাকিস্তানকে আর্মি শাসিত রাষ্ট্র বলি। আমার কেন যেন মনে হয় আমেরিকা
নিজেও সেদিক থেকে খুব পিছিয়ে নেই। সে কি পুলিশি রাষ্ট্র নয়? সে আজ পেন্টাগন আর ওয়াল
স্ট্রিটের হাতে জিম্মি। আমি জানি আমার এ বিশ্লেষণ দূর থেকে দেখে, দূর থেকে শুনে করা।
আপনারা যে এর সাথে একমত হবেন না সেটাই স্বাভাবিক। আমি সেটা চাইছিও না। যেটা চাই তা
হল আপনারা শুধুমাত্র সংবাদ মাধ্যমের প্রোপ্যাগান্ডায় বিশ্বাস না করে প্রশ্ন করুন, দুই
দলের বসদের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে অপ্রিয় প্রশ্ন করে সত্য জানুন। দেশটা আপনার।
শুধুমাত্র আধুনিক যন্ত্রপাতি, বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার ব্যবহার করলেই আধুনিক হওয়া
যায় না, সে জন্যে দরকার প্রশ্ন করা, নিরপেক্ষ প্রশ্ন করে সত্য জানা বা জানার ক্ষেত্রে
কিছুটা হলেও এগিয়ে যাওয়া। তা না করলে মানুষের জানাটা জ্ঞান নয়, পণ্য – বালুতে মাথা গুঁজে আরও কিছুদিন
ভালো থাকার ব্যর্থ চেষ্টা। বিজ্ঞানের নামে অন্ধ বিশ্বাসের বাম্পার ফলন।
অনেক বন্ধুরা সে দেশ সম্পর্কে গর্ব
করে বলেন সেখানে “স্কাই ইজ দ্য লিমিট।” খুব ভালো। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেই লিমিটটা
টাকাপয়সার অংকে মাপে। খুব ভালো হয় যদি সেটা টাকাপয়সা না হয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য
এসব হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ কয়েক বছর এদেশে ছিলাম। অনেক ভুল ত্রুটি, অনেক দুর্বলতা
ছিল সে দেশের, তবুও সেখানে ছিল সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, আমেরিকার মত উন্নত না
হলেও ছিল বিনামূল্যে সবার জন্য চিকিৎসা, স্কুলের পড়াশুনার বাইরেও নাম মাত্র খরচে শিশু
কিশোরদের জন্য গানবাজনা, খেলাধুলার বিভিন্ন ব্যবস্থা। ছিল ভিন্ন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে
কড়াকড়ি, সংবাদপত্রে একপেশে খবর। আজ যখন ইউরোপ বা আমেরিকার দিকে তাকাই মনে হয় সোভিয়েত
ইউনিয়ন থেকে সব খারাপ জিনিসগুলোই তারা বেছে বেছে
আমদানি করেছে, ঠিক যেমনটা রাশিয়া আমদানি করেছে পুঁজিবাদের খারাপ দিকগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন
দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব রপ্তানি করত, এখন আমেরিকা দেশে দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব
রপ্তানি করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি আফগানিস্তানে সৈন্য না পাঠাতো, দেশে দেশে বিপ্লবের
জন্য অর্থ ব্যয় না করত কে জানে সে আজ কোথায়
থাকত? সারা পৃথিবীতে আগুন লাগিয়ে নিজে ভালো থাকা খুব কঠিন। আগে যখন আমেরিকা সাত সমুদ্র
তের নদীর পাড়ে ছিল, তখন হয়তো এটা সম্ভব ছিল। আজ ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে এটা বলতে
গেলে অসম্ভব। আজ পৃথিবীতে অনেক সমস্যা যা কোন দেশ একক ভাবে সমাধান করতে পারবে না। দেশগুলোর
হাতে হাত রেখে কাজ করার গুরুত্ব আজ যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। সময় এসেছে আমেরিকার
জনগণের সেটা বোঝার। একটা চুটকি আছে আমেরিকা সম্পর্কে। আমেরিকায় কখনও বিপ্লব হবে না
তার কারণ আমেরিকায় আমেরিকান দূতাবাস নেই। কিন্তু এখন আমেরিকার রাস্তায় (শুধু এখন কেন, ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী আন্দোলনের
সময়ও দেখেছি, তবে তাদের পেছনে দুই বড় দলের কেউ ছিল না বলে আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট
হয়, ঠিক যেমনটা ঘটে বাংলাদেশে) যা দেখি তাতে সেটা ইউক্রাইন বা আরব বসন্তের সময় মিশরের
রাস্তা থেকে খুব একটা ভিন্ন মনে হয় না। একটা
নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোন ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়। এসব গণিতের নিয়ম মেনে
চলে। যদি এসব ঘটনা কোন ক্রিটিক্যাল পয়েন্ট অতিক্রম করে যায় সেটা আর কন্ট্রোলে থাকে
না। পাকিস্তানের কথা চিন্তা করুন? এক সময় জিয়াউল হক তথা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী
নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন মৌলবাদী দল গঠন করেছিল। আজ এরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায়
হিতে বিপরীত হয়েছে। আল কায়েদা, আই এস এস – এ সবই আমেরিকার তৈরি। যতদিন নিয়ন্ত্রণে ছিল
আমেরিকার স্বার্থে কাজ করেছে। এখন? আমার ব্যক্তিগত মতামত – প্রেসিডেন্ট যেই হোক, আমেরিকার
সামনে – কী আভ্যন্তরীণ অঙ্গনে, কী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমস্যার যে পাহাড়, সেটা সমাধান কেউই করতে পারবে
না। তবে আমেরিকার জনগণ, বিশেষ করে শিক্ষিত এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ যদি প্রশাসনকে কঠিন
প্রশ্ন করতে থাকে, বর্তমান রাজনৈতিক এলিটদের প্রতি তাদের অনাস্থা প্রকাশ করে শুধু মাত্র
তখনই তারা মানুষের দিকে মুখ ফেরাবে, গণমুখী রাজনীতি শুরু করবে। তখন দেশ শুধু বিলিয়নিয়ারদের
হবে না, সাধারণ মানুষেরও হবে। সেটা হলে শুধু আমেরিকাই নয় সারা বিশ্বই লাভবান হবে। সেই
সাথে আমিও। ভোট দিন। তবে ভোট যাকেই দেন না কেন, যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন – প্রশ্ন করতে
ভুলবেন না, হিস্যা চাইতে ভুলবেন না। সারা বিশ্ব আজ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
বারাক ওবামা যখন ক্ষমতায় আসেন অনেকে
তাঁকে মেসিয়াহ বলে মনে করেছিল। আমি ভেবেছিলাম তিনি হবেন আমেরিকান গরবাচেভ। না দেশ ভাঙ্গার
জন্য নয়, দেশে বেশ কিছু পজিটিভ পরিবর্তন এনে। ১৯৮৫ সালে গরবাচেভ ক্ষমতায় এলে যে আশার
আলো দেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ, একই ঘটনা ঘটে সারা বিশ্বে বারাক ওবামার বিজয়ে।
ওবামাকেয়ার সহ কিছু কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেও তিনি মার্কিন এলিটদের নির্দেশিত পথেই
চলেছেন, অন্তত বিদেশ নীতিতে। ট্রাম্পকে আমার মনে হয়েছে ইয়েলৎসিনের মত। কী বাহ্যিক ভাবে
কী চলনে বলনে। ইয়েলৎসিন যেমন সব কিছুই করেছেন গরবাচেভকে আন্ডারএস্টিমেট করতে, ট্রাম্পও
ঠিক সেটাই করে যাচ্ছেন বারাক ওবামা নিয়ে। সৃষ্টির চেয়ে ধ্বংসেই যেন তাঁর বেশি আনন্দ।
আর এর মধ্য দিয়ে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টি দুটো আন্টাগনাস্টিক পার্টিতে পরিণত
হয়েছে। সেই সুযোগে বিভিন্ন রকম র্যাডিক্যাল গ্রুপ আইন তুলে নিচ্ছে নিজেদের হাতে। পুলিশ
হারিয়েছে শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীর মর্যাদা। প্রশ্ন হল যো বাইডেন যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত
হনও পুলিশ কি তার আগের মর্যাদা ফিরে পাবে, র্যাডিক্যাল গ্রুপগুলো কি শান্ত ছেলের মত
ঘরে ফিরবে? দুই দল কি একে অন্যকে জনতার চোখে হেয় করতে গিয়ে রাষ্ট্রকেই হেয় করছে না?
দিন দিন যেভাবে প্রশ্নের পাহাড় জমা হচ্ছে কেউ কি কোনদিন তার উত্তর দিতে সক্ষম হবে?
অনেক আগে বাংলাদেশ নামে এক দেশে জিয়াউর রহমান নামে এক রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি বলেছিলেন
“আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট।” এর চল্লিশ বছর পরেও সরকার বদলিয়েছে ঠিকই, কিন্তু
সুস্থ্য রাজনীতি করাও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে, হচ্ছে। আমেরিকা কি একই পথে চলছে না?
যারা আমেরিকায় থাকেন তারা ভালো বলতে পারবেন, তবে নেটে আর টিভিতে দেখে মনে হয় মার্কিন
সমাজ আজ যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি র্যাডিক্যাল, পরস্পারিক অসহিষ্ণুতার মাত্রা চরমে।
এমন অবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক দেশ ছোটোখাটো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে,
হচ্ছে। আমেরিকা কি পারবে সেই গতানুগতিকতা ভাংতে, বিশেষ করে যেখানে প্রায় সেন্ট পারসেন্ট
জনতা সশস্ত্র। জানি না পৃথিবীর দেশে দেশে যাদের প্রগতিশীল শক্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়
তেমন শক্তি আমেরিকায় আছে কি না। প্রেসিডেন্ট যেই হোক এরকম এক শক্তি তৈরি করাই হবে মার্কিন
মেহনতী জনতা ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম প্রধান কাজ। দেশে যেমন আর কোন ভাবেই
আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে প্রগতির পথে, মানে যে পথে ধনীরাই শুধু আরও ধনী হবে না অপেক্ষাকৃত
গরীবের অবস্থারও উন্নতি হবে, আনা যাবে না, আমেরিকার দুই প্রধান দলকেও আর সে পথে ফেরান
যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। অনেক আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম, বাঙ্গালীরা পৃথিবীর একচ্ছত্র অধীশ্বর। কারণ আর সব দেশের মানুষ মঙ্গল সহ বিভিন্ন গ্রহে পাড়ি জমিয়েছে। এখন মনে হয় আমেরিকা রাজনৈতিক ভাবে হলেও ধীরে ধীরে বাংলাদেশে পরিণত হচ্ছে। সত্য হতে চলছে সেই পুরনো তত্ত্ব, «আজ বাংলা যা ভাবে বাকি বিশ্ব সেটা ভাবে আগামীকাল।»
কোথায় যেন পড়েছিলাম বিংশ শতকের শুরুতে
আমেরিকা আর আর্জেন্টিনায় প্রায় একই রকম আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিদ্যমান ছিল। আর্জেন্টিনার
রাজনৈতিক অস্থিরতা সে দেশকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসে, অন্য দিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
আমেরিকাকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে রূপান্তরিত করে। একবিংশ শতাব্দী আমেরিকার জন্য তেমন
সুখকর হয়নি। শুরু হয় নাইন ইলিভেনের ভয়ঙ্কর ঘটনা দিয়ে। তারপর একে একে অন্তহীন যুদ্ধের
পালা, যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভাবা গিয়েছিল যুদ্ধকে টাটা বলা যায়। এরপর আসে
ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী আন্দোলন। বুশ জুনিয়র যখন নির্বাচিত হন তখন কোন কিছুই স্মুথ হয়নি।
আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। সেই প্রথম জানলাম পপুলার ভোটে জয়ী হলেই প্রেসিডেন্ট
হওয়া যায় না। এই ব্যবস্থা যে গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থার সাথে যায় না সেটা মনে হয় অলস
ছাড়া সবাই বলেছে। তারপরেও নির্বাচনী আইনে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। হিলারি ক্লিনটন একই
ভাবে হেরে যান ট্রাম্পের কাছে। আমেরিকা সব সময়ই উদাহরণ সৃষ্টি করেছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা
হস্তান্তরের মাধ্যমে। হিলারি সেই নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিলেও মনে নেননি। ফলে বিগত চার
বছর আমেরিকার জনগণের এক বিরাট অংশের কাছে ট্রাম্প ছিলেন বহিরাগত। এসব কারণে ট্রাম্পকে
অনেক ক্ষেত্রেই ইয়েলৎসিনের মত মনে হলেও তাঁর সময়টা আমাকে গরবাচভের সময়ের কথা মনে করিয়ে
দেয়। পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্ত সোভিয়েত সমাজের দীর্ঘ দিনের বিশ্বাসগুলো ভেঙ্গে ফেলে।
প্রিবাল্টিক, ককেসাসের প্রজাতন্ত্রগুলোয় দেখা দেয় বিদ্রোহ। ট্রাম্পের বিজয় ছিল এতটাই
অপ্রত্যাশিত যে তা দশকের পর দশক ধরে যে সামাজিক সম্পর্ক, যে চেতনা বিরাজ করছিল আমেরিকায়
সেটাকে প্রচণ্ড আঘাত করে। এরপর আসে মিটু, আসে বিএলএম মুভমেন্ট। এখন প্রায়ই বলা হয় পোস্টকরোনা
পৃথিবী হবে একেবারেই অন্যরকম, সে আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। আমার মনে হয় একই কথা
বলা চলে আমেরিকার বর্তমান অবস্থাতেও। নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, আমেরিকা আর আগের মত হবে না। এর মধ্যেই
বিভিন্ন পরিবর্তন শুরু হয়েছে। হলিউডে অস্কারের ব্যাপারে বিভিন্ন কথাবার্তা বলা হচ্ছে,
আফ্রো-আমেরিকানদের কোটার কথা বলা হচ্ছে। এটা আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট টিমের কথা
মনে করিয়ে দেয়। অবশ্যই পিছিয়ে পড়া কমিউনিটিকে সামনে নেওয়া প্রতিটি দেশেরই কর্তব্য,
কিন্তু তার সাফল্য নির্ভর করে সেই পরিবর্তনের নেতৃত্ব কে দেবেন তার উপর। একজন নেলসন
ম্যাণ্ডেলা যা করতে পারেন একজন রবার্ট মুগাবে সেটা পারেন না। আজকাল সারা বিশ্বে ম্যাণ্ডেলাদের
খুব অভাব। তবে আমার কেন যেন মনে হয় ট্রাম্প আর বাইডেনের দ্বন্দ্ব যতটা না ডেমোক্র্যাসির
ভ্যালু নিয়ে তার চেয়ে বেশি ফাইনান্সিয়াল আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালের। পুঁজিবাদের
বিজয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালের হাত ধরে হলেও আজ ফাইনান্সিয়াল
ক্যাপিটাল বিশ্বের হর্তাকর্তা। এখন কনটেন্টের থেকে উপস্থাপনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন
ইয়ং জেনারেশন এমন কি আমরা নিজেরা পর্যন্ত ভাতের চেয়ে নেটকে বেশি গুরুত্ব দিই। ভার্চুয়াল
লাইফ রিয়াল লাইফের জায়গা দখল করে নিয়েছে। মিডিয়ার কল্যাণে আজ একদিকে যেমন মেধাহীন মানুষ
সুপার পপুলার হতে পারে একই ভাবে মেধাবী মানুষকে আস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া যায়। সেটা হরহামেশাই
ঘটছে। তাই সচেতন মানুষকে আজকাল আরও বেশি করে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। দেশে একটা কথা
চালু আছে “আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু সে একাই জেতে কিন্তু আওয়ামী লীগ হারলে হারে বাংলাদেশ।”
আমেরিকার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য, তবে আরও বড় স্কেলে। “আমেরিকা জিতলে সে শুধু একাই
জেতে কিন্তু আমেরিকা হারলে হারে সারা বিশ্ব।” এই নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, সেটা
হবে সাময়িক স্টেশন। ফাইনাল গন্তব্যে পৌঁছতে হলে আরও অনেক পথ যেতে হবে, অনেক পরিবর্তন
আনতে হবে নিজেদের ভাবনায়। আর সে জন্যে অনবরত প্রশ্ন করতে হবে। অন্ধত্বকে ত্যাগ করতে
হবে। নিজেকে দলের এমন কি দেশেরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। অজানার পথে এই যাত্রা হবে অন্তহীন
কিন্তু রোমাঞ্চকর। পায়েখালি – লেট আস গো।
দুবনা, ২৮ অক্টোবর ২০২০
Comments
Post a Comment