পূজার সকাল বিকাল
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার পূজা এল বাঙ্গালীর দ্বারে। পূজা মানেই ছোটবেলা, পূজা মানেই দিনের পর দিন বসে বসে দেখা কিভাবে একটু একটু করে চোখের সামনে গড়ে উঠছে প্রতিমা। আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির দুর্গা পূজা হত রামার ভিটায়। রামা মনে হয় রাম চন্দ্র বসাক। পাকিস্তান ছেঁড়ে ভারতে চলে গেছে ভাগ্যের সন্ধানে। আমরা সেই বাড়িটা কিনে রেখেছি। সে সময় আশেপাশের কোন হিন্দু পরিবার দেশ ছাড়লে আমরা সাধারণত সেই বাড়ি কিনে রাখতাম। ওসব বাড়ি হয় পড়ে থাকত, নয়তো পাড়ার গরীব পরিবার, বিশেষ করে রাজবংশীরা সেখানে ঘর তুলে থাকত।
এরকম আরেকটা বাড়ি ছিল রং খোলা মানে আমাদের পুরনো বাড়ির সাথে। সেটাও আমি জন্মের পর থেকেই মানে পঞ্চাশ বছরের বেশি হল আমাদের বাড়ির
অংশ। গ্রামের লোকেরা এটাকে আমাদের বাড়ি বললেও আমরা নিজেরা ওকে রইত্যার বাড়ি বলেই
ডাকি পুরনো মালিক রতি সাহার নামানুসারে। এখনও আমাদের এরকম কিছু জায়গায় এসব পরিবার বাস
করছে।
রামার বাড়ি ছিল অন্য পাড়ায়, খালের ওপারে। মূলত পুজায়
যাতে বাড়ির মহিলারা যেতে পারে সে জন্যে খালের উপর ছিল কাঠের সাঁকো, আমাদের খরচেই। তখন
ঋতু আসত নিয়ম করে। বর্ষায় খাল বিল জলে ভরে যেত। আমরা ঐ সাঁকো থেকে লাফিয়ে পড়তাম খালে।
বাড়ির চার চার খানা নৌকা ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকত ঘাটে। তারপর একদিন বদু ভাই, আরশেদ ভাই,
নালু ভাই, হজরত ভাই, সালাম ভাইসহ বাড়ির রাখালেরা লেগে যেত সাঁকো মেরামতের কাজে। ওটাই
জানান দিত পূজা আসছে। তারপর নৌকা করে ওরা নিয়ে আসত এঁটেল মাটি, আসত শন, গুদাম থেকে
বেরুত পাট। বাড়ির বাঁশ ঝাড় থেকে দেখে দেখে কাটা হত বাঁশ। বানান হত কাঠাম। বাড়ির রাখালেরা
যারা এতদিন রঙের কাজ করত, এখন মনের আনন্দে মাটি আর পাটের কুচি মিশিয়ে মশলা তৈরির কাজে লেগে যেত। ইতিমধ্যে পাশের গ্রাম থেকে আসত দেউরি
মানে কুমার। অতি যত্নে শন দিয়ে তৈরি করত দেবতার কঙ্কাল। এরপর ধীরে ধীরে তার উপর পড়ত
মাটির মশলার প্রলেপ। পরে বড় হয়ে দেশ বিদেশের
লোক কথা পড়েছি জেনেছি কিভাবে ঈশ্বর মাটি দিয়ে মানুষ তৈরি করেছেন। এসব পড়ে মনে হত মূর্তি
তৈরির কথা, চোখের সামনে ভেসে উঠত মাটি দিয়ে মানুষের ঈশ্বর তৈরি করার দৃশ্য। ধীরে ধীরে
কুমারদের হাতে গড়ে উঠত প্রতিমা। একসময় মাথা
লাগান হত। তখন আমার মনে পড়ত গনেশের মাথা লাগানোর গল্প। শনির কোপে গনেশের মৃত্যু হলে তাঁকে বাঁচানোর জন্য চারিদিকে
দেবতাদের পাঠানো হয় মাথা নিয়ে আসার জন্য। শর্ত একটাই, যার মাথা আনবে সে যেন উত্তর দিকে
মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সেজন্যে ছোটবেলায় মা আমাদের কখনোই উত্তর দিকে মাথা দিয়ে ঘুমুতে
দিতেন না। কে জানে হয়তো ভাবতেন তাহলে কোন দেবতা গনেশের শরীরে আবার অস্ত্রোপচার করে
তাঁর হাতির মাথাটা সরিয়ে আমাদের কারও মাথা বসিয়ে দেবে। এরপর শুরু হত পোশাক পড়ানোর কাজ।
তারপর গা ভরে যেত বিভিন্ন গয়নাগাটিতে। এসব কাজ শেষে এঁটেল মাটির গোলা দিয়ে করা হত প্লাস্টার।
এবার দেবদেবীরা রং গ্রহনে প্রস্তুত। আমাদের শুরু হত নানা জল্পনা কল্পনা, শুরু হত উপদেশ
দেওয়া কাকে কোন রং মানাবে। ফ্যাশন জিনিসটা তখনও ছিল, ঠিক এখনকার মতই। তবে কল্পনা ছিল
সীমিত। তারপর একদিন দেবীর চোখ ফোটানো হত আর সেই সাথে বন্ধ হয়ে যেত আমাদের মণ্ডপে ঢোকার
অধিকার। পুরোহিত প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেন মাটির মূর্তিতে। তখন থেকে সেখানকার হর্তাকর্তা হতেন পুরোহিত আর বাড়ির মহিলারা যারা উপবাস
থাকতেন। পাশের গ্রামের ঋষি পাড়া থেকে আসত ঢুলী তার
ঢাক নিয়ে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন আসত, তবে তাদের মধ্যে একজন ছিল খুবই নামকরা, সে
শুধু বাজাতই না, নাচতও। চেহারা ঠিক ভেসে উঠছে চোখের
সামনে, নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এমন প্রায়ই হয়, অনেকের নাম মনে আসে
কিন্তু মুখ মনে করতে পারি না, আবার অনেক সময় নামহীন কত মুখ যে ভেসে ওঠে মনের কোণায়! আর আসত মাইক। সেসব দিনে মাইক বাজত কালে ভদ্রে, বিয়েতে, পুজায় আর মিলাদে।
মাঝে মধ্যে কোন খেলাধুলার আয়োজন থাকলেও মাইক বাজানো হত। তখন এখনকার মত এত বেশি
গানের ভান্ডার ছিল না। ঘুরেফিরে কয়েকটা রেকর্ডই বাজানো হত। বিসর্জনের দিন বিভিন্ন গানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাজত «গাঙ্গে ঢেউ খেলে যায় কন্যা মাছ ধরিতে আয় জাল ফেলিতে যাইয়া কন্যা ডুবিস না»
যুদ্ধের পর এক সময় রামার ভিটা বিক্রি হয়ে গেল।
পূজা বন্ধ হল। এরপর অবশ্য সত্তরের দশকের শেষ আর আশির দশকের শুরুতে বাড়িতে কয়েকবার
কাত্যায়নী পূজা হয়েছে। বাসন্তী পুজার মত এটাও দুর্গা পূজা, তবে হয় আশ্বিনের অকাল
বোধনের মাস দেড় দুই পরে। ছোটবেলায় পূজায় আনন্দের
সাথে ভক্তিও মিশ্রিত ছিল, দেবদেবীদের উপর আস্থা আর বিশ্বাস ছিল। সময়ের সাথে সাথে তাঁদের দুর্বলতা, মানুষের কাছে তাঁদের অসহায়ত্ব
চোখে পড়তে শুরু করে। যুক্তির সাথে তর্কে বিপর্যস্ত হয়ে ভক্তি পিছু হটতে শুরু করে।
যুক্তির আলো যতই তীব্র হয় ভক্তির অন্ধকার ততই ম্লান হয়ে আসে। দেশের শেষ দিনগুলোতে
পূজা গেলেও সেটা মূলত ছিল আড্ডার আগ্রহ থেকে।
১৯৮৩ সালে মস্কো এলে পুজার সাথে একরকম স্থায়ী
ভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ১৪ সপ্তাহ দেশে ছিলাম (১৯৮৩
সেপ্টেম্বরের পর এখন পর্যন্ত ওটাই আমার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দেশে থাকা)। তখন শেষ বারের
মত দেশে পূজা দেখি। সেবার মায়ের সাথে ধামরাই গিয়েছিলাম প্রতিমা দর্শনে। মস্কো ফিরে
এসে শুনি এখানেও পূজা শুরু হয়েছে। মস্কোর পুজার প্রতি অন্য ধরণের আগ্রহ ছিল, তাই অপেক্ষা ছিল বছর ঘোরার। ১৯৯০ সালে প্রথম মস্কোর পূজায় যাই। মেট্রো সাবলভস্কায়ার পাশে ছোট্ট একটা ক্লাবে সে
পূজা। অনাড়ম্বর, ঘরোয়া পূজা। মস্কোয় আরও তিন বছর ছিলাম, মনে হয় পূজা দেখতে
গিয়েছিও, তবে তেমন কিছুই মনে নেই। এরপর ১৯৯৫ সালে পূজা হয় তখনকার প্রোগ্রেস সিনেমা
হলে, আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে। ১৯৯৬ সালে মস্কো থেকে সবাই দুবনা চলে এলে
পরবর্তী ১৩ বছর যোগাযোগ তেমন ছিল না বললেই চলে। মাঝে ২০০০ সালে গেছিলাম পূজা দেখতে
গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারক্লাবে। তবে ২০১০ সাল থেকে আবার নিয়মিত পূজা
দেখতে যাই। ছেলেমেয়রা মস্কো থাকে বলে অজুহাত খুঁজি ওদিকে যাওয়ার। তবে এখন যাই মূলত
বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। মস্কোর পূজা আমার কাছে অধুনালুপ্ত মস্কো মেলার মত মনে
হয়। ছাত্র জীবনে আমরা অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে সারা দিন ব্যাপী মস্কো
মেলার আয়োজন করতাম। পূজায় এখন সেই আমেজটাই পাই। দেখা হয় ভারতীয় বন্ধুদের সাথে।
বিশ্বরূপ, সুমিত, স্মিতা, দেবস্মিতা, রিঙ্কু, রথীন কাকু সহ অনেকের দেখা এখানেই
মেলে। সাথে আছে বাংলাদেশের বন্ধুরা। তাই জীবনে পূজা আবার ফিরে এসেছে নতুন আঙ্গিকে।
তবে কেন যেন পুজার কথা মনে হলেই শৈশব আর কৈশরের দিনগুলোর কথাই বেশি মনে হয়। বয়সের
কারণে কি? কে জানে? সেভার জন্ম দুবনায়,
প্রথম ৬ বছর এখানেই কাটে। ও দুবনা এলে বেড়াতে যাই ওর ছোটবেলায় যেসব জায়গায় ঘুরতাম
সেখানে, কিন্তু ওর তেমন উৎসাহ তাতে লক্ষ্য করি না। হয়তো এখনও পেছনে ফিরে তাকানোর
বয়স হয়নি। জীবন তো অনেকটা সিনুসইডের মত। প্রথম অর্ধেক ও উপরের দিকে ওঠে, সামনে শুধুই ভবিষ্যতের ভাবনা। তারপর শুরু হয় নীচে নামার পালা, ধীরে ধীরে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনের কথা।
এখন অবশ্য পূজা শুধু আনন্দই আনে না ভয়ও নিয়ে আসে। আমরা ভয় পাই সাম্প্রদায়িকতার, ভয় পাই মাটির মূর্তির ছিন্ন মস্তকের ধুলায় গড়াগড়ির দৃশ্য দেখার। তবে সেটা কি শুধু আমাদের দেশেই। বিগত কয়েক বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রিস্টমাসের অনুষ্ঠান খর্ব করা হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে পাছে আরব বিশ্ব থেকে আসা মুসলিম শরণার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। ভাবখানা এই যেন পৃথিবীর অন্য কারও কোনই অনুভূতি নেই। লিবারেল ডেমোক্র্যাসির এই সিলেকটিভ ছাড় দেওয়ার নীতিই কি দেশে দেশে উগ্রবাদকে উস্কে দেওয়ার জন্য দায়ী নয়? গত কয়েকদিন হল ফেসবুকে একটা সার্কুলার ঘুরছে উত্তরার কোন ক্লাবে পূজা সংক্রান্ত ব্যাপারে। পূজা সরকার অনুমোদিত একটা উৎসব। এখানে সরকারি ছুটি আছে। দেশের জনগণের একটা বিরাট অংশের মৌলিক অধিকার এই পূজার সাথে জড়িত। এর পরেও যদি কেউ প্রকাশ্যে এসব
চ্যালেঞ্জ করে, সরকারকে আল্টিমেটাম দেয় – এটা শুধু হিন্দুদের নয়, রাষ্ট্রের
অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। কিন্তু বাংলাদেশ তো আজ আর সোনার বাংলা নয়, উত্তপ্ত মরুভূমি আর রাষ্ট্র সেই মরুভূমির বালুতে মাথা লুকিয়ে বসে থাকা উট পাখি। দেশই যখন হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতি পদে পদে যেখানে দেশের স্বাধীনতার মূল চেতনার অঙ্গহানি ঘটছে তখন প্রতিমার শিরচ্ছেদ সেটা কি কোন ঘটনা?
বরাবরের মতই এবারও প্রতিমা নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। ছোটবেলায় কাকার মুখে রামায়নের গল্প শুনে মনে হত তাড়কা রাক্ষসী বোধ হয় আমাদের গাব গাছেই বাস করে। পরে রামায়ণ মহাভারত পড়ে কল্পনায় দেখতাম বিভিন্ন দেবদেবী কিভাবে আমাদের খালে বিলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আসলে তখন মনেই হত না এরা আমাদের বাইরের কেউ। তাই আধুনিক যুগে যখন দেবীকে কখনও কাঙ্গালিনীর বেশে কখনও বা নার্সের রূপে প্রকাশ করতে দেশি মোটেই অবাক হই না। ছোট বেলায় ধর্ম বইয়ে পড়েছি ঈশ্বর নিরাকার এজন্যে নয় যে তাঁর আকার নেই, তিনি নিরাকার কারণ যে যেমন ভাবে তাঁকে পেতে চায় তিনি তার কাছে সেই রূপেই দেখা দেন। উদাহরণ দেওয়া হত জলের। জল যে পাত্রে রাখা হয় সেই রূপই ধারণ করে। হিন্দু ধর্মের প্রচুর দোষ ত্রুটি যা অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে এর একটা বড় শক্তি হল প্রত্যেককে নিজের মত করে ঈশ্বরকে দেখার সুযোগ দেয়। যেকোনো ধরণের রিজিডিটি সিস্টেমকে সুশৃঙ্খল করে বটে, তবে ফ্লেক্সিবিলিটি যেকোনো সিস্টেমকে করে দীর্ঘজীবী, যুগোপযোগী। তাই এসব এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া এটাকে যদি অধর্মও মনে করেন তা নিয়ে আপনার কিছু করার নেই। গীতাতেই তো আছে যখন ধরণী অধর্মে ভরে যায় তিনি নিজেই আবির্ভূত হন ধর্ম রক্ষায়। ঈশ্বরে যদি বিশ্বাসই করেন ধর্ম রক্ষার ভার তাঁর উপরেই ছেড়ে দিন।
সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
দুবনা, ২৩ অক্টোবর ২০২০
Comments
Post a Comment