করোনার দিনকাল

করোনা আবার নতুন করে হানা দিয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। রাশিয়াও বাদ পড়েনি। ইদানিং কালে করোনার প্রকোপ প্রথম ধাক্কাকেও ছাড়িয়ে গেছে। যদিও রাশিয়া অনেক আগেই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে আর এ নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে, তারপরের এখনও পর্যন্ত গণ হারে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়নি। টেস্টের তৃতীয় পর্যায় হিসেবে এখন চলছে ভলেন্টিয়ারদের টিকা দেওয়ার পালা। প্রায় ৫০ হাজার লোককে এ পর্যায়ে টিকা দেওয়া হচ্ছে। যতদূর জানি খুব শীগগিরই এই পর্যায় শেষ হবে। শুরু হবে গণ হারে টিকা দেওয়া। তবে সেটাও ভলেন্টিয়ারি ভাবে, মানে শুধু তাদেরই টিকা দেওয়া হবে যারা নিজে থেকে সেটা চাইবে।

বিগত কিছুদিন যাবত প্রতিদিন করোনা পজিটিভ ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেটা প্রথম ধাপের দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের দেড় গুনের বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন কেন এমন হল? প্রশাসন অনেক আগেই বলেছিল গ্রীষ্মের ছুটির পরে অবস্থা খারাপ হবে। তাহলে হঠাৎ কেন সব হাত ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে?   

মনে রাখতে হবে রাশিয়া শীতের দেশ। তাই গ্রীষ্মে সবাই চেষ্টা করে দক্ষিণ দিকে মানে কৃষ্ণ সাগর এলাকায় যেতে। এটা অবশ্য ছিল সোভিয়েত আমলে একমাত্র অপশন। বর্তমানে এদেশের লোকজন বেশির ভাগ যায় তুরস্ক, ইসরাইল, মিশর, মরক্কো, গ্রীস, মন্টে নিগ্রো, স্পেন, ক্যারিবিয়া, থাইল্যাণ্ড সহ বিভিন্ন দেশে। কিন্তু করোনা কারণে বিদেশে যাতায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবার লোকজন রেস্ট নিয়েছে মূলত রাশিয়ায়
আমি নিজে যাইনি। বন্ধুরা গেছে। মেয়েও ঘুরে এলো। টিভিতে দেখেও বুঝলাম মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সান বাথ করা যায় না। এমন কি যখন কোন কাজে মস্কো যাই, তখনও দেখি, বিশেষ করে পিক আওয়ারে মেট্রোতে মানুষের ভিড়। সবাই যে মাস্ক পরে তা নয়। কারও মাস্ক পকেটে, কারও কান থেকে ঝুলছে। আসলে মাস্ক যে এতো ভাবে পরা যায় করোনা না এলে সেটা জানাই হত না।

আমার যে কারণগুলো এর পেছনে কাজ করে বা করছে বলে মনে হয় সেটা এরকম। প্রথমত কিছু কারণ আছে সাইকোলজিক্যাল। আমার মনে আছে একাত্তরের কথা। প্রথম দিকে ভয়অজানার ভয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়। একটা সময় পরে ভয় কেটে যায়, যুদ্ধ পরিস্থিতি অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন সেই ভয় বুকে নিয়েই আমরা বাজারে যেতাম, এমন কি এক সময় সুতার ব্যবসাও চলতে থাকে পুরোদমে। তবে কি ভয় কেটে গেছিল? না। বেঁচে থাকার জন্য ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। কাজ করতে হবে। শুধু আমাদের দেশে কেন, সব জায়গায়ই এমনটা হয়। বিভিন্ন দেশে, যেখানে এই মুহূর্তে যুদ্ধ চলছে, সেখানেও তো জীবন থেমে নেই। সবাই বেরুচ্ছে, বাজার ঘাট করছে। এটাই তো জীবন। তাই প্রায় আট মাস করোনার সঙ্গে বসবাসের পর মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে এতে। দ্বিতীয় কারণ হল গ্রীষ্ম। এখানে বলতে গেলে সামারের কয়েক মাস সূর্যের দেখা মেলে। তাই স্কুল কলেজ বন্ধ। মানুষ সুযোগ পেলেই চলে যায় আলোর আদর গায়ে মাখাতে। করোনার প্রথম ঢেউ আসে বসন্তে। সে সময় বড় বড় শহরগুলোতে করোনা ছড়ায়। বড় শহর মানেই ফুটন্ত কেটলি, যেখানে জীবন কিলবিল করছে। চাইলেই সেটা বন্ধ করা যায় না। আর সে কারণেই প্রথম ধাক্কাটা লেগেছিল মস্কোর উপর। সাথে আরও বেশ কিছু বড় শহর ছিল। এরপর মস্কো থেকে লোকজন এলাকায় ফিরতে শুরু করলে সেটা সারা রাশিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ে, তবে প্রকোপ ততটা ছিল না। কিন্তু গ্রীষ্মে সারা দেশ রাস্তায় নামে। শীতে পাখিরা যেমন চলে যায় আফ্রিকা বা এশিয়ার দেশে দেশে গ্রীষ্মে এদেশের মানুষ চলে যায় কৃষ্ণ সাগর বা অন্য কোন গরম এলাকায়। আর সেটা যায় ছোট বড় সব শহর বা গ্রামের মানুষ, যায় স্কুলের ছেলেমেয়েরা। সেপ্টেম্বর এরা যখন ফিরতে শুরু করেদেখা দেয় নতুন ঢেউ, করোনার ঢেউ।

বড় শহরগুলো ইতিমধ্যে কমবেশি প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও ছোট শহর, প্রত্যন্ত এলাকার সুযোগ কম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর এসব এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে না পড়লেও অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অনেক জায়গা থেকে লোকজন চলে যায় শহরের দিকে জীবিকার সন্ধানে। সোভিয়েত আমলে চাইলেই কেউ কোথাও যেতে পারত না, সবাইকে সরকার নিজের ইচ্ছেমত বিভিন্ন এলাকায় কাজে পাঠাত। সেখানে তার পাসপোর্টে সীল দেওয়া থাকত। ফলে চাইলেও অন্য কোন জায়গায় কাজ পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। নতুন রাশিয়ায় সেই ব্যবস্থা, মানে স্থায়ী ঠিকানার প্রথা থাকলেও যে কেউ যে কোন জায়গায় কাজ করতে পারে সাময়িক রজিস্ট্রেশন নিয়ে। ফলে গ্রাম বা ছোট শহরের কর্মক্ষম মানুষ চলে যায় বড় শহরের অধিক আয়ের খোঁজে। পেছনে থাকে বয়স্ক মানুষ। অনেক গ্রামে ছাত্রের অভাবে স্কুল বন্ধ করতে হয়, পর্যাপ্ত রুগীর অভাবে হাসপাতাল। আর যেহেতু এখানে জনপদগুলো একে অপরের থেকে অনেক দূরে (অনেক সময় সেটা ১০০ কিলোমিটার হতে পারে) তাই অর্থনৈতিক যুক্তিযুক্ততা খুঁজতে গেলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রথম প্রধান প্রায়রিটি তো মানুষ নয়, অর্থনীতি। এর ফলে দেখা যাচ্ছে অনেক এলাকায়ই এই ধাক্কা সামলাতে পারছে না। বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতাল রুগী দিয়ে ভর্তি। এমন কি কোন কোন জায়গায় রুগীদের বলা হচ্ছে বাসা থেকে পোর্টেবল খাট নিয়ে আসতে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রচুর টাকা এলাকায় বরাদ্দ করার পরেও অনেক এলাকায় সে টাকা খরচ করা হয়নি, ভেবেছে এভাবেই উতরে যাবে। সব মিলে অবস্থা ভয়াবহ না হলেও আশান্বিত নয়। এর মধ্যে সরকার ছোট মধ্য ব্যবসায়ীদের জন্য ট্যাক্স ভ্যাকেশন বছরের শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। পিটার দ্য গ্রেট বলতেন, রাশিয়ার দুটো মিত্র, আর্মি নৌবাহিনী। এখন অবশ্য এর সাথে বিমান বাহিনী, স্পেস ফোর্স এসব যোগ হয়েছে। এখনও ডাক্তারদের পাশাপাশি আর্মিই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে করোনা প্রতিরোধে। আর্মি ডাক্তার তো আছেই, সাথে সাথে তারা দ্রুত গতিতে তৈরি করছে বিভিন্ন হাসপাতাল, যেসব করোনা পরবর্তী কালেও মানুষকে চিকিৎসা দেবে। দুটো ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে, তৃতীয়টা আসার পথে। তাছাড়া করোনা চিকিৎসার জন্য ওষুধ এসেছে। এমন কি বাড়িতে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে তাদেরকেও এসব ওষুধ বিনে পয়সায় সাপ্লাই দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। দোকানে এসব ওষুধের দাম প্রায় ২০০ ডলার। যতদূর জানি আমাদের বাংলাদেশীদের কেউ কেউ সেই ওষুধ বিনে পয়সায় পেয়েছে এবং করনামুক্ত হয়েছে। 

তবে এখনও গণহারে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়নি। তৃতীয় পর্যায়ে এরা ৪০ হাজার ভলেন্টিয়ার চেয়েছিল। সেটা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আশা করা যাচ্ছে মাসের শেষের দিকে তৃতীয় পর্যায়ের ফলাফল পাওয়া যাবে। বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন সাপ্লাই করা হচ্ছে। ওপর থেকে সিগ্ন্যাল পেলেই শুরু হবে গণ হারে টিকা দেওয়া। কয়েকদিন আগে আমাদের ইন্সটিটিউট থেকে মেইল পেলাম। ওরা আমাদের জন্য ভ্যাকসিন আনবে কেন্দ্রীয় ভাবে। তাই নাম চাইছে কারা নিতে আগ্রহী তাদের। আমাদের ল্যাবে ব্যাপারে এখনও কিছু বলেনি। নিজও দোদুল্যমানতার মধ্যে আছি। আমাদের অনেকেই তাই। এর কারণ হয়তো একদিকে একমাত্র বিজ্ঞানই যে সমস্যার সমাধান দিতে পারে সেটা আমরা বুঝি, অন্য দিকে বুঝি স্ট্যাটিস্টিক্সের জন্য ৫০ হাজার তেমন বড় সংখ্যা নয়। লাখ দশেক টেস্টের  পর রেজাল্ট অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য হত। তবুও ডাক এলে সাড়া দেব বলেই মনে করছি। এরমধ্যে মস্কো আবার ধীরে ধীরে লকডাউনে যাচ্ছে। কখনই পুরোপুরি লকডাউন ছিল না, রেস্ট্রিকশন ছিল। আজ মানে ১৩ নভেম্বর শুক্রবার থেকে স্কুল কলেজের সব ক্লাস অনলাইনে শুরু হয়েছে। আমাদের ইনস্টিটিউট বন্ধ করেনি, তবে বলেছে পারলে না আসতে। এর মধ্যে আমাদের ল্যাবেই বেশ কয়েকজন পজিটিভ। নিজে কাজে আসছি। আসলে এখন ল্যাবে লোকজন নেই বললেই চলে, তাছাড়া আমি কারও সাথে তেমন মিশি না কখনই। সোজা অফিসে আসি, কাজ শেষে বাসায় চলে যাই। রাস্তা ঘাটে লোক তেমন নেই। তাই সামাজিক দূরত্ব ভাঙার জন্য চেষ্টাই করতে হয়।  সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা আর ছাউনায় যাওয়া বাদ দিয়েছি যদিও পিঠের যে ব্যথাতাতে না যাওয়াটা আরও বেশি কষ্টের। ফটো ক্লাবে যাই। আর মাঝে মধ্যে বনে বা নদীর ধারে। সব মিলিয়ে জীবন চলছে কখনও সামুকের গতিতে, কখনও খরগোশের মত লাফিয়ে লাফিয়ে। 
যদিও করোনার পজিটিভের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে, তবে কোন প্যানিক নেই, আগেও ছিল না। মনে আছে প্রথম দিকে ইউরোপ, আমেরিকা এমন কি বাংলাদেশে করোনা রুগী দেখলে লোকজন তাঁদের এড়িয়ে যেত। এখানে তেমনটা কখনই ছিল না, এখন তো একেবারেই নেই। করোনা আর দশটা রোগের মতই
আম জনতা হয়ে গেছে। শত হলেও এক সময় সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল, করোনা তাই ধীরে ধীরে প্রলেতারিয়েতে পরিণত হচ্ছে। তবে লোকজন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক, কম বেশি সবাই মাস্ক ব্যবহার করছে। ট্রান্সপোর্টে, দোকানে তো বটেই, অনেকে রাস্তাঘাটেও মাস্ক পরে চলছে। এখনও পর্যন্ত মাস্ক আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই করোনা কন্ট্রোলের প্রধান অস্ত্র।  এরা আশা করছে এ মাসের শেষ দিকেই করোনা পজিটিভ বৃদ্ধির হার ম্যাক্সিমামে পৌঁছুবে। এখন শুধুই ভ্যাকসিনের অপেক্ষা, মানে কবে আমাদের মত লোকেদের কাছে ভ্যাকসিন এসে পৌঁছুবে। এখনও পর্যন্ত বলছে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বিনামূল্যে।      

 

দুবনা, ১৩ নভেম্বর ২০২০  

এখানে  মস্কো রেজিওন, মস্কো, রাশিয়া আর বিশ্বে করোনা বিস্তারের বিস্তারিত গ্রাফিক      


https://yandex.ru/covid19/stat?utm_source=main_notif&geoId=213

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা