মূর্তি বিহীন ভাবমূর্তি

দেশে এখন একটা বিতর্ক চলছে - মূর্তি আর ভাস্কর্য নিয়ে। বলা হচ্ছে ভাস্কর্য যখন পূজা করা হয় তখন সেটা মূর্তি বা প্রতিমায় পরিণত হয়। যেহেতু ইসলাম পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করে না তাই মূর্তি পূজা ইসলামের পরিপন্থী। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী তাদের জন্য মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ হলেও অন্য অনেক ধর্মের লোকদের জন্য সেটা সত্য নয়। একজন ডায়াবেটিকসের রুগীর জন্য মিষ্টি খাওয়া নিষিদ্ধ, তাই বলে তো পরিবারের সবাইকে মিষ্টি থেকে বঞ্চিত করা তো ঠিক হবে না। হতেও তো পারে পরিবারের অন্য কারও জন্য মিষ্টি না খাওয়াটাই ক্ষতিকর। তাই মূর্তি আর ভাস্কর্যের বিতর্কটাই বিতর্কিত। দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আছে কি নেই সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে দেশের সরকার থেকে শুরু করে অনেকেই বলেন আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। অনেকে আরেকটু এগিয়ে বলেন আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ধর্মনিরপেক্ষতা - এটা ধর্মহীনতা নয়। নিরপেক্ষতা মানে কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কোন ধর্মকে প্রাধান্য না দিয়ে সমস্ত ধর্মের লোকেরা যাতে সুষ্ঠুভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে সেই অধিকার নিশ্চিত করা। তাই যখনই মূর্তি আর ভাস্কর্য এক কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন আসে, মূর্তি পূজায় বিশ্বাসীদের স্বাধীন ভাবে ধর্ম পালন করার অধিকার থাকবে কি না সেটা আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। সরকার যদি জনগণের এক অংশের চাপের মুখে অন্য আরেক অংশের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় সেই সরকার জনগণের প্রতিনিধি হয় কিভাবে, গণতান্ত্রিক হয় কিভাবে? মনে রাখতে হবে সরকার যে দলেরই হোক না কেন, নির্বাচিত হলে সে সবার প্রতিনিধি, সবার সরকার। দেশের সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব তার। সেটা না করতে পারলে সরকারের সাংবিধানিক বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অন্যদিকে সরকার যদি মনেই করে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় মূর্তি আর ভাস্কর্য নিয়ে বিবাদটা চালিয়ে যেতেই হবে, তাহলে তো আরও অনেক ব্যাপার নিয়েই তার আগে কথা বলা উচিৎ। যেমন দেশের প্রধান প্রধান পদে কোন নারী থাকতে পারবেন কি না। ইসলাম কি নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়াকে সঠিক মনে করে? যতদূর জানি করে না। কিন্তু দেশে দেশে তারা ক্ষমতায় আছেন যার অর্থ হল প্রয়োজনে এসব বিধি অগ্রাহ্য করা যায়, অগ্রাহ্য করা হয়। আপনারা যদি ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের হিসেব কষে কিছু কিছু বিধি লঙ্ঘন করতে পারেন, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে সেটা পারেন না কেন? কেন বলতে পারেন না, রাষ্ট্র রাষ্ট্রের আইনে চলবে, ধর্মের নিয়মে নয়। যে ধর্মেরই হোক না কেন, কেউ যদি রাষ্ট্রের আইন অমান্য করে তাকে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। রাষ্ট্র যখন তার নীতিতে ছাড় দিতে শুরু করে তখন সেটা রাষ্ট্র থাকে না। সেই প্রমাণ পাওয়ার জন্য খুব বেশি দূরে যেতে হবে না।


যদিও অনেকের ধারণা আমাদের দেশের মূল সমস্যা করাপশন, আমার কিন্তু মনে হয় আমাদের মূল সমস্যা আসলে আইনের সিলেক্টিভ প্রয়োগ। খারাপ আইনের সঠিক প্রয়োগ ততটা ক্ষতি করে না যতটা করে ভালো আইনের সিলেক্টিভ প্রয়োগ। এমনিতে তো আর আইনের দেবীকে প্রাচীন গ্রীসে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়নি! হয়েছে তিনি যাতে পক্ষপাত দুষ্ট না হন। ধরুন সাতান্ন ধারা। হয়তো সেটা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা হলে দেশে ধর্মীয় উত্তেজনা, করাপশন এসব কমত। কিন্তু আমরা কী দেখি? বাস্তবে ৫৭ ধারা প্রয়োগ করা হয় ব্লগার আর সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে। অথচ অনেক ধর্ম ব্যবসায়ী বড় বড় জনসভা থেকে ব্লগার আর সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন কি ফেক আইডি করে ফাঁসানো হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর ভিন্নমতাবলম্বীদের। দুঃখজনক হলেও সত্য এটা এখন বাংলাদেশের প্রাইভেট ব্র্যান্ড নয়। কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও আমরা এসব দেখেছি। করাপশন আর যৌন হয়রানির জন্য অনেককে হেরাজ করা হলেও বাইডেনের ব্যাপারে কী মিডিয়া, কী মিটু আন্দোলন সবাই ছিল নিশ্চুপ যেমনটা আমাদের সরকার ঘাপ্টি মেরে বসে থাকে হেফাজতের ব্যাপারে। জানি না সেটা আমেরিকার রাজনীতিতে পরবর্তীতে কোন প্রভাব ফেলবে কি না, কিন্তু একবার নজির তৈরি করা হলে সেটা বার বার ফিরে আসে। আইনের সিলেক্টিভ ব্যবহার - এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা। দুর্বলকে সবাই বিশেষ করে যাদের কিছুটা হলেও শক্তি আছে, নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে, করতে চাইবে তাতে আর নতুন কী আছে। তাই আমার বিশ্বাস মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থক্য না খুঁজে যাতে প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় সেদিকেই নজর দেওয়া দরকার।

দুবনা, ২৬ নভেম্বর ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা