ইতিহাসের ইতিহাস

আমার বিভিন্ন রকমের হবির একটা হল ইতিহাস। কোন দেশ বা জাতির ইতিহাস পড়তে বরাবরই পছন্দ করি। কিন্তু কথা হল ইতিহাস কি? সেটা কি শুধুই রাজা বাদশাদের ইতিহাস নাকি সাধারণ মানুষের ইতিহাস? রাজ বাদশহদের ইতিহাস যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস, রাজ্য জয়ের ইতিহাস, তাঁদের আরাম আয়েশের ইতিহাস, প্রজাদের উপর নির্যাতনের ইতিহাস। সাধারণ মানুষের ইতিহাস কী? সেটা তাদের দুঃখ কষ্টের ইতিহাস, রাজাদের রোষ অগ্রাহ্য করে বেঁচে থাকার ইতিহাস, আর এই বেঁচে থাকতে গিয়ে তারা যে লোক সাহিত্য, সংস্কৃতি আর কল্প কাহিনীর জন্ম দেয় সেই ইতিহাস।  

ইতিহাস যারা লেখে তারা সেটা করে কোন শ্রেণীর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। ফলে কোন ইতিহাসই পূর্নাঙ্গ নয়। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে ইতিহাস পাঠ করে কোন পাঠক বা গবেষক কোন সমাজের মোটামুটি চলনসই ও নিরপেক্ষ একটা চিত্র পেতে পারেন। এখানে দরকার বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের সঠিক ব্যবহার, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কোন তথ্য সত্য আর কোনটা মিথ্যা সেটা বোঝার ক্ষমতা। তাই কোন সমাজের কোন এক বিশেষ সময়ের পূর্ণ চিত্র পেতে হলে একদিকে যেমন অফিসিয়াল ইতিহাস জানা দরকার, অন্যদিকে তেমনি দরকার সেই সময়ের বিভিন্ন লোক কাহিনী জানা, সেই সময়ের সাহিত্য সংস্কৃতি জানা, কেননা সাধারণ মানুষ তাদের ভাগ্যের কথা এসব লোক কাহিনীর মাধ্যমেই ব্যক্ত করে বা করতে পারে। তবে এটাও ঠিক, এমনকি ইতিহাস বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখতে পারেন আর এজন্য যে তাঁকে সব সময় ইতিহাসের সাহায্য নিতে হবে তা নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলে যেতে পারে লেভ গুমিলেভের তত্ত্বের কথা যেখানে তিনি বিশেষ করে রুশ দেশে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণের উপর ভিত্তি করে গড়া প্যাসনারী তত্ত্বের দ্বারা বর্ণনা করেছেন। তার লেখা পড়ে এতটাই মুগ্ধ হই যে আমাদের দেশে কেউ এভাবে ইতিহাসের উপর কাজ করেছেন কিনা সে ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি। ঠিক এত বড় স্কেলে না হলেও অতুল সুর নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার বিভিন্ন রীতিনীতি, আচার আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন। এ ছাড়া সাহিত্যও হতে পারে কোন সমাজের সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন। লেনিন এ কারণেই তলস্তয়কে রুশ বিপ্লবের আয়না হিসেবে দেখেছেন। শৈল্পিক আবরণ আর আভরন থাকা সত্বেও তলস্তয়ের "যুদ্ধ ও শান্তি" নেপলিয়নের সমসাময়িক রুশ সমাজ এবং ফ্রান্স ও রাশিয়ার যুদ্ধের বর্ণনা দেয়, যেমন পুশকিনের  "ক্যাপ্টেন দুহিতা" পুগাচেভের সময়ের রাশিয়ার সামাজিক ও ঐতিহাসিক ছবি আঁকে। 

কোন জাতির বিশেষ সময়ের ইতিহাস জানা যায় সেই সময়ের নেতাদের বিভিন্ন লেখা পড়ে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারত যখন তোলপাড় তখনকার  ইতিহাস আমাদের বলে সেই সময় লেখা বিভিন্ন আত্মজীবনী, সামাজিক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেকের লেখা একদিকে সে সময়ের সামাজিক বিশেষ করে হিন্দু সমাজের অবস্থার বর্ণনা দেয়। অন্য দিকে নেহ্রুর বিশ্ব ইতিহাস, ভারত আবিষ্কার আর আত্মজীবনী আমাদের শুধু সেই সময়ের ভারতের কথাই নয় বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়। একইভাবে গাঁধির Autobiography, সুভাষ বোসের The Indian Pilgrim, Struggle for India, মৌলানা আজাদের India wins freedom, রুদ্রাংশু মুখার্জির Nehru and Bose: Parallel Lives, যশবন্ত সিংহের Jinnah: India-Partition-Independence, আবুল হাশিমের আত্মজীবনী সহ অসংখ্য বই সেই সময়ের ভারতের রাজনীতির ঘরের খবর আমাদের জানায়। রামচন্দ্র গুহ, রমিলা থাপার, শশী থাহ্রুরসহ অনেকের লেখাই বিভিন্ন সময়ে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। 

আগেই বলেছি ইতিহাস বই বা যারা ইতিহাস তৈরি করেন তাঁদের আত্মজীবনী ছাড়াও ইতিহাস ভিত্তিক অনেক গল্প, উপন্যাস  কোন দেশ বা জাতির একটা নির্দিষ্ট সময়ের আর্থ সামাজিক ইতিহাস বর্ণনা করে। এসব বইয়ের কন্টেন্ট কতটুকু ঐতিহাসিক সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে শিল্পীর বা লেখকের দায়িত্ব এক্ষেত্রে তো কোন ঘটনার ওয়ান টু ওয়ান করেসপন্ডেন্স নয়, বরং এই সব ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপন্যাসের প্লট হিসেবে ব্যবহার করে কোন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট দেশ বা জাতির সামাজিক পরিস্থিতি বর্ণনা করা। এটা আমরা দেখেছি তলস্তয়ের রচনায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ ধরণের গল্প উপন্যাস আমরা দেখতে পাই। বাংলা ভাষাও ব্যাতিক্রম নয়।  

বই পড়ার অভ্যেস ছোটবেলা থেকেই। মস্কো আসার পর প্রথম বইয়ের অভাব অনুভব করি। তখনও রুশ ভাষায় বই পড়ার মত ভাষা জ্ঞান বা সাহস ছিল না। গ্রামের স্কুলে পড়ার ফলে ইংরেজিও ছিল নড়বড়ে। তাই গল্পের বই পড়ার মূল ভাষা ছিল বাংলা। আর মস্কোয় বাংলা বইয়ের অভাব। কেউ কোন বই পেলে হাতে হাতে তা ঘুরত। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে ইংরেজি আর রুশ ভাষায় গল্পের বই পড়ার অভ্যেস গড়ে ওঠে আর তা এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। 

মস্কোর ছাত্র জীবনেই হাতে আসে সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের সেই সময় আর পূর্ব পশ্চিম। সেই সময় থেকে জানতে পারি বাংলার রেনেসাঁর কথা, পূর্ব পশ্চিম মহাশ্বেতা দেবীর চুরাশির মা'র মতই স্বাধীন ভারতে নক্সাল বাড়ি আন্দোলনের কথা আমাদের জানায়। আমার দুই দাদা এই আন্দোলনের সাথে জড়িত বিধায় নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই অনেক কিছু জানা ছিল। হাজার চুরাশির মা আর পূর্ব পশ্চিম বই দুটো পড়ে আবার নতুন করে সেসব অনুভব করি। এবার করোনার কল্যাণে হাসপাতালে থাকার সময় সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের প্রথম আলো পড়ার সুযোগ আসে। নিজের অজান্তেই ফিরে যাই ছাত্র জীবনে। মনে পড়ে অন্যান্য উপন্যাসের কথা।  

যেসব প্রথিতযশা মানুষ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন, যারা বাঙালি সমাজকে কুসংস্কারের  অন্ধকার থেকে আধুনিকতার আলোয় নিয়ে এসেছেন আবার পরে দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য রাজনীতিতে আমুল পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে গল্পচ্ছলে হলেও আমরা জানতে পারি সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের সেই সময়, প্রথম আলো আর পূর্বপশ্চিমের মত উপন্যাসে। এসব বই বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের জাগরণের কথা আমাদের জানায়, আমাদের জানায় সেই সময়ের বিভিন্ন স্রোতের কথা, জানায় স্বাধীন ভারতে নক্সাল আন্দোলনের কথা। তবে এটা ঠিক এসব বইয়ে বাংলার মুসলিম সমাজের উত্থানের বিষয়টা বলতে গেলে একেবারেই আসেনি। তার মানে এই নয় যে বাংলার মুসলিম সমাজে পরিবর্তন ঘটেনি। ঘটেছে। অনেকটাই ঘটেছে। আর এই পরিবর্তনের ফল প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম, এরপর ভাষা আন্দোলন আর সবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী ও তার পরবর্তী সময়ের তখনকার মুসলিম এলিট শ্রেণীর মনোভাব সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। এসব বিষয়ে লেখার অভাব নেই, তবুও মনে হয় আজ যখন বিভিন্ন মহল থেকে ইতিহাস বিকৃত করার প্রচেষ্টা চলছে তখন বিগত শতাব্দীর তিরিশ বা চল্লিশের দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত না হলেও অন্তত সত্তর বা আশি দশক পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার ভিত্তিতে  "সেই সময়" বা "প্রথম আলো"র মত  যেকোনো শক্তিশালী উপন্যাস কিছুটা হলেও শুধু ইতিহাসের বিকৃতি রোধ করতেই পারত না, তরুনদের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারত। আমাদের সৌভাগ্য যে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেকেই এখনও জীবিত। জীবিত আছেন সেই সমস্ত মানুষেরা যারা পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে রাজনীতিকে পথ দেখিয়েছেন। অনেক বুদ্ধিজীবি শহীদ হলেও তাঁদের ছেলেমেয়েরা এখনও জীবিত। তাঁদের স্মৃতি, বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতি কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত উত্তাল সময়ের একটা নিরপেক্ষ ছবি আঁকা এখনও সম্ভব।  আমাদের অনেক বন্ধুই বর্তমানে নামকরা সহিত্যিক, সাংবাদিক। আমার বিশ্বাস তাঁরা যদি বিভিন্ন দলিলপত্রের ভিত্তিতে, একই সাথে ১৯৪০ থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তাঁদের সাক্ষাৎকার, স্মৃতিকথা ইত্যাদির ভিত্তিতে কোন ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেন সেটা শুধু তাঁদের জন্যই না, দেশের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হবে। বন্ধুরা ভেবে দেখতে পারেন।  


দুবনা, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 









Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি