একজন জামাল নজরুল ইসলাম
  
আজ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের জন্মদিন। 
অনেকেই লিখছেন তাঁকে নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে আমি নিজেও লিখেছি, তাই আজ আর লিখতে
 চাইছিলাম না। কেননা আমাদের পরিচয় ক্ষণিকের। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম 
বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমোলজির উপর  নিজের কাজকর্ম নিয়ে কিছু বলার আগ্রহ প্রকাশ 
করলে অধ্যাপক ইসলাম তাতে সাড়া দেন। সেই সুবাদে আমাদের আলাপ, যদিও সেই ১৯৯০ 
এর দশক থেকেই তাঁর বেশ কিছু কাজকর্মের সাথে আমি  পরিচিত ছিলাম। 
এখানে
 অনেক লেখকই যে কথাটার উপর জোর দেন, তা হল ক্যামব্রিজে লাখ টাকা বেতনের 
অফার ত্যাগ করে মাত্র তিন হাজার টাকার বেতনে চট্টগ্রামে জয়েন করা। যেন 
টাকার অংকটাই আসল। সত্যিকারের যারা গবেষক, তারা কাজ করেন কাজ করার আনন্দে। 
টাকাটা বাঁচার জন্য দরকার, তবে সেটাই সব নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে 
পদার্থবিদরা, বিশেষ করে যারা সাফল্যের সাথে শিক্ষকতা বা গবেষণা করছেন, তারা
 যথেষ্ট মেধাবী। তাই টাকাটাকে তাঁরা জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে 
মনে করলে খুব সম্ভবত ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিঙের মত সেসব পেশাতেই যেতেন 
যেখানে অর্থ উপার্জন বেশি হয়। সেটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের 
সর্বত্রই। তাই প্রফেসর ইসলামের সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বেতনের কথাটা সামনে আনা
 কতটা ঠিক সেটা ভাবা দরকার। আসল প্রশ্ন টাকা নয়, আসল কথা তিনি ক্যামব্রিজ 
থেকে চিটাগাং আসলেন। এর অর্থ হল তিনি পদার্থবিদ হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ারকে 
বিপদের সম্মুখীন করলেন। বলতেই পারেন জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ
 বসু, সি ভি রমন এরা তো দেশে থেকেই কাজ করেছেন। সেটা ঠিক। কিন্তু সময় বদলে 
গেছে, বদলে গেছে বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের আটিচুড। প্রফেসর আব্দুস সালাম যদি 
ইউরোপে না থেকে পাকিস্তানে থাকতেন তাহলে কি খ্যাতির এই শীর্ষে উঠতে পারতেন?
 প্রশ্ন সাপেক্ষ। ব্যাপারটা এই নয় যে নিজ দেশে থাকলে তাঁর মেধার ঘাটতি হত। 
কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁকে এতো বেশি ব্যুরক্র্যাসির, এতো বেশি ঈর্ষা, 
সমালচনার সম্মুখীন হতে হত যে গবেষণার কাজ ব্যহত হত। আমি জানি না প্রফেসর 
ইসলামকে এ রকম সমস্যা ফেস করতে হয়েছে কিনা, তবে এটা ঠিক ক্যামব্রিজে তাঁর 
কাজের পরিবেশ হত সম্পূর্ণ ভিন্ন আর তাতে করে বিজ্ঞান অনেক বেশি লাভবান হত। 
মনে রাখা দরকার বিজ্ঞানী বিশ্ব নাগরিক, তাঁর দেশ নেই, আছে সত্যকে জানার 
আগ্রহ আর সেজন্য অক্লান্ত সাধনা। প্রফেসর ইসলামের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, 
বিশেষ করে চট্টগ্রামে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার সেন্টার প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের
 বিজ্ঞান গবেষণায় একটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে, তবে সেটা নির্ভর করে তাঁর 
ছাত্রছাত্রীরা দেশে বিজ্ঞান গবেষনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কতটুকু আগ্রহী ও 
সক্রিয়। নিজের ক্যারিয়ার বিপদের সম্মুখীন করে উনি দেশে ফিরেছিলেন, তাঁর 
দেখানো পথে দেশে গবেষণাকে জনপ্রিয় করে তুলেই তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা
 জানানো যাবে। আমি এ ব্যাপারে সন্দিহান। কারণ আমার এখনও মনে আছে সেমিনার 
শেষে একটা লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি কথা বলেছিলাম আনাইসোট্রপিক 
কসমোলোজিতে স্পাইনর ফিল্ডের ভূমিকা নিয়ে। ওই লাঞ্চের সময় এক ছাত্রী প্রফেসর
 ইসলামকে বলল, "স্যার, উনি যা বললেন, সেসব তো কোরআনেই লেখা আছে, তাই না?" 
আমি বুঝি সে সময়ে চট্টগ্রামের পরিবেশ। প্রফেসর ইসলাম আর আমি মুখোমুখি বসে 
খাচ্ছিলাম। উনি আমার দিকে একটু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ।"  
আসলে এই পরিবেশে, এরকম ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশি দূর অগ্রসর হতে 
পারেন না। আমার এই ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করার জন্যই মনে হয় তখন প্রফেসর গনেশ
 রায়ের টেলিফোন এল। "ছাত্র লীগ আর শিবিরে বন্ধুক যুদ্ধ শুরু হয়েছে, একজন 
মারা গেছে। তুমি স্যারকে বলে যত দ্রুত সম্ভব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে 
বেরিয়ে আস।" তবুও আমার বিশ্বাস প্রফেসর ইসলাম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে 
গেছেন, একদিন কেউ সেটাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশে বিজ্ঞান আর গবেষণাকে সামনের 
দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। 
দুবনা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১        

Comments
Post a Comment