বাংলাদেশের উন্নয়ন ও একুশ

 

আজ বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ, রাশিয়ার পক্ষ থেকে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করছি। আমাদের ছোটবেলায় বলতাম শহীদ দিবস বা শোক দিবস। এই শোক একদিন শক্তিতে পরিণত হয় আর সেই শক্তি আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে যার হাত ধরে আসে স্বাধীনতা। আজ এই দিনটি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এতে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দায়িত্ব। বিশ্বের যেখানেই মাতৃভাষার উপর খড়গ নেমে আসে সেখানেই যেন আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ গর্জে ওঠে।


বাহান্নর একুশে আমাদের যাত্রা শুরু। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ আমরা এখানে এসেছি। অনেক ব্যর্থতার মধ্যে গর্ব করার মত অনেক কিছুই আছে। দেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর। এর মূলে কারা? দেশের শ্রমিক, কৃষক, বিদেশে কর্মরত সাধারণ মানুষ আর গার্মেন্টসের নারী কর্মী। আমাদের গর্বের বিষয় কী? পদ্মা সেতু, যা টেকনোলোজির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে। আজ আমরা শত বর্ষ আগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া মসলিন তৈরির টেকনোলোজি পুনরোদ্ধার করেছি। যেখানে প্রথম বিশ্বের ধনী দেশগুলো করোনায় ধরাশায়ী আমরা সেখানে সাধারণ মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করছি। আমরা দেশের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতির মূলে কি? বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ। কোন ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ছি? শিক্ষায়। আমাদের মূল সমস্যা কোথায়? নিরাপত্তায়। খুন, ধর্ষণ আর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও মৌলবাদই যে মূল কারণ তাতে সন্দেহ নেই। মৌলবাদের চাপে আমরা শিক্ষানীতি পরিবর্তন করেছি, মৌলবাদই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের আওয়াজ তুলে সহিংসতা ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আর ব্যর্থতা বার বার প্রমাণ করছে মৌলবাদী শক্তি আমাদের উন্নয়নের সহায়ক নয়, এই শক্তি আমাদের পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ ভোটের রাজনীতির মিথ্যা মোহে সমস্ত রাজনৈতিক দলই মৌলবাদের কাছে মাথা নত করছে। এখন সময় এসেছে আমাদের ভেবে দেখার - আমরা আসলে কে? আমাদের পরিচয় কী? আমরা কি সহজাত ভাষা আর সংস্কৃতির পরিচয় নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই, নাকি ধর্মীয় পরিচয় যা আমাদের সহজাত নয় সেটা নিয়ে পেছন পানে হাঁটতে চাই? যতদিন না আমরা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব আমাদের এক জায়গায় দাঁড়িয়েই কুচকাওয়াজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন এসেছিল ভাষা সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী পরিচয় নিয়েই। সেটার শুরু আটচল্লিশে, বিকাশ বাহান্নয় আর চরম প্রাপ্তি একাত্তরে। এখানেই একুশের গুরুত্ব, এখানেই একুশের মাহাত্ম্য। এজন্যেই আমরা বার বার একুশকে স্মরণ করি, স্মরণ করি একুশের শহীদদের। এজন্যেই আমরা বার বার একুশের কাছে ফিরে যাই পথ দেখার জন্য। 

তাই বর্তমান বাংলাদেশকে বুঝতে হলে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলার মানুষ বাহান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তরে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিল, সেটা বুঝতে হলে আমাদের একুশের ইতিহাস জানতে হবে। আজ বিভিন্ন দল নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন ভাবে একুশের ইতিহাস বিকৃত করছে। মনে রাখতে হবে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত - এরা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ, জীবন দান করলেও, বিভিন্ন দলের নেতা, লেখক, সাংবাদিক, কবি এরা এই আন্দোলনে অনেক অবদান রাখলেও সাফল্যের মূলে ছিলেন সারা দেশের মানুষ। দেশের গ্রামে, গঞ্জে, ছোট্ট শহরে, এমনকি কলে কারখানায় খেটে খাওয়া মানুষ এই আন্দোলনের শামিল হয়েছিল বলে পাক সরকার বাংলাভাষাকে, বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। আজকাল বিভিন্ন মাধ্যমে সেই বড় খেলায় ছোট ছোট মানুষের অংশগ্রহণের খবর পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দলনে অংশগ্রহণকারী সব মানুষকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে ইতিহাসে স্থান দিয়েই আমরা পারব সত্যিকারের ঐতিহাসিক চিত্র তুলে ধরতে। আর যেদিন আমরা নিজেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারব, দেশের মানুষকে সত্যিকারের মর্যাদার আসনে বসাতে পারব, সেদিনই বাংলাদেশ নতুন গতিতে ছুটতে শুরু করবে লাখ শহীদের স্বপ্নে গড়া লিক্ষ্যের দিকে। আর এজন্য আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কে? আমাদের জাতীয়তাবাদের পরিচয় কি ভাষা সংস্কৃতি নাকি ধর্ম?

একুশে ফেব্রুয়ারি অমর হোক।

দুবনা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি