বানান বিভ্রাট


আমরা আজকাল প্রায়ই বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলি, বলি দিন দিন বাংলা ভাষা শিক্ষার মানের অবনতির কথা। কিন্তু আদৌ কি আমাদের শিক্ষা, বিশেষ করে ভাষা শিক্ষার মান উন্নত ছিল? শহরের বা আরও সঠিক করে বললে বড় বড় শহরের নামকরা স্কুলের কথা বলতে পারব না, তবে গ্রাম এলাকায় সেটা যে খুব উন্নত মানের ছিল না তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি। যদিও আমি যে স্কুলে পড়াশুনা করেছি সেই তরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আর বানিয়াজুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষকগন সত্যই খুব ভাল ছিলেন। কিন্তু সমস্যা তো শুধু শিক্ষকে নয়, সমস্যা শিক্ষা ব্যবস্থায়। রাশিয়ায় নিজে ভাষা না শিখলে আর পরে এখানে থেকে যাওয়ায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াশুনা করতে না দেখলে হয়তো এসব লিখতাম না। এখানে উচ্চারণের দিকে খুবই মনোযোগ দেওয়া হয়, কেননা প্রচুর শব্দ আছে উচ্চারণে একটু এদিক সেদিক হলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বোঝাতে পারে। প্রতিটি শব্দ একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্ট্রেচ দিতে হয়, এর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন বর্ণ, বিশেষ করে স্বরবর্ণের উচ্চারণ কেমন হবে। বাংলায় তেমন সমস্যা খুব বেশি নয়, তবে আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে চিনি (খাবার) আর চিনি (চেনা), বিশ (কুড়ি) আর বিষ ইত্যাদি। উচ্চারণের তারতম্য থেকে আমরা বুঝতে পারি কোন বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। আমারা যে ছোটবেলায় এসব শিখতাম না তা নয়, তবে এদেশে যে রকম সিস্টেম্যাটিক ওয়েতে এসব শেখানো হয়, আমাদের দেশে সেরকম হয় না। অন্তত আমাদের শেখানো হয়নি। বানান শেখানোর একমাত্র উপায় ছিল মুখস্ত আর বেত। ঠিক জানি না, বর্তমানে অবস্থার উন্নতি নাকি অবনতি ঘটেছে। তবে সব দেখে মনে হয় উন্নতি ঘটেনি। যদিও এখন বিভিন্ন বই পাওয়া যায়, যারা ইচ্ছুক তারা নিজেরা শেখেন, কিন্তু সেসব মনে হয় পাঠ্য বই হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। তাছাড়া আগে আমরা কী পড়তাম? বই। সেসব সাধারণত ছিল কবি, লেখকদের লেখা, ছিল পাঠ্য বই, ছিল সংবাদপত্র আর বিভিন্ন জার্নাল। এসব লেখা প্রুফ সহ বিভিন্ন কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে যেত। তাই লেখায় কোন ভুল থাকলে সেটা লেখকের অজ্ঞতা হিসেবে না দেখে প্রুফ রিডারের ভুল বা টিপো হিসেবে দেখা হত। কিন্তু বর্তমানে আমরা সবাই লেখক। এদের অনেকেই বানান জানলেও সময় মত বিভিন্ন অপশনগুলো থেকে যে ঠিক শব্দটা বাছতে হবে সেটা মনে রাখেন না, ফলে বানান জানা থাকার পরেও ভুল করেন। তবে বেশির ভাগই বানানটা জানেন না, এ নিয়ে ভাবেন না। তাদের জন্য লেখাটাই বড়, ভুল শুদ্ধ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। সামাজিক মাধ্যমের আগের যুগে স্কুলের মাস্টার মশাই আর হাতে গনা দু' চার জন লোক যাদের সাথে তারা চিঠিপত্র আদান প্রদান করত এর বাইরে কারোই এসব লেখা পড়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হত না। সামাজিক মাধ্যমের যুগে যেমন অনেক অপ্রিয় সত্য কথা আর কার্পেটের নীচে আর গোপন করে রাখা যাচ্ছে না, তেমনই গোপন রাখা জাছে না ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের অজ্ঞতা। এটা শুধু বাংলার ক্ষেত্রেই নয়, অনেকেই মুক্তহস্তে ভুলভাল ইংরেজিও লিখে যাচ্ছেন। ফলে আমরা হুট করেই সবাই যেন অশিক্ষিত হয়ে গেছি। তাছাড়া সময়ে সময়ে কর্তৃপক্ষের বানান বিধি পরিবর্তনও এতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। তবে এমনও হতে পারে ডিজিটাল যুগ আর শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি দুটোই এজন্যে দায়ী।

দুবনা, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি