একুশের একুশ

দোস্ত, তোমার মনে আছে এক সময় প্রায় সব বক্তাই তাদের বক্তব্য শুরু করতেন "দেশের এই ক্রান্তি কালে" শব্দগুলো দিয়ে? 

থাকবে না কেন? আলবত মনে আছে। এই ক্রান্তি কালের কোন শুরু বা শেষ ছিল না, কবে এর শুরু সে সম্পর্কে বিভিন্ন দলের মানুষের বিভিন্ন ধারণা থাকলেও এর শেষ কবে হবে সে সম্পর্কে কারোই কোন সঠিক ধারণা ছিল না। 

এখনও কি আমরা সেই ক্রান্তি কাল পেরিয়ে আসি নি?

এখন আমরা ক্রান্তিকাল পেরিয়ে উজ্বল ভবিষ্যতের দিকে হাঁটছি বলে একদল মনে করে, তবে অন্য দলের ধারণা কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে গেলেও সার্বিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছি। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক উন্নতি সেটা শুধু সরকারের সঠিক পদক্ষেপের ফল নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে সামগ্রিক পরিবর্তনের ফল। বিগত প্রায় তিন দশক ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে হয়েছে বিশ্বায়ন আর এটাই এমনকি সব থেকে পিছিয়ে পড়া দেশ বা জাতিকেও কিছুটা হলেও উপরে উঠতে সাহায্য করছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানব জাতি আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শক্তির সমস্যারও অনেকটাই সমাধান করেছে। মানে থিওরেটিক্যালি কোন মানুষ আর ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা যাবার কথা নয়। তবে সেটা হচ্ছে না, কারণ এই অঢেল সম্পদের মালিক অল্প কিছু মানুষ। বাকি প্রায় ৯৯% মানুষ এই সম্পদ শুধু উৎপাদনই করে। সম্পদের সুষম না হলেও সম্মানজনক বন্টন এখনও হচ্ছে না। সমাজতন্ত্রে সম্পদের সমবন্টনের একটা প্রচেষ্টা ছিল, কিন্তু সম্পদের যেখানে অভাব সেখানে বণ্টন সুষম আর অসম খুব বড় ফ্যাক্টর নয়। এত কিছুর পরেও সার্বিক ভাবে মানব জাতির জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। আমাদের দেশেও হয়েছে। 

তার মানে এই উন্নয়নে সরকারের কোনই ভূমিকা ছিল না? 

আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাইছি না। অনুকুল বিশ্ব পরিস্থিতি এই  উন্নতির পালে হাওয়া দিয়েছে। শীতের পর যখন বসন্ত আসে, তখন কিন্তু ধনী গরীব সবার ঘরেই উষ্ণ হাওয়া বয়ে যায়। তোমার মনে আছে শীতে আমরা কাগজ দিয়ে জানালার ছিদ্র বন্ধ করতাম? হ্যাঁ শীত একইভাবে সবার ঘরেই আসত, তবে যে একটু কষ্ট করে ছিদ্রগুলো বন্ধ করত, তার ঘর গরম থাকত, যে সেটা করত না, সে ঠাণ্ডায় কষ্ট পেত। এখানেও তাই। এই উন্নয়নের হাওয়া সব দেশেই এসেছিল, তবে আমাদের দেশের সরকারের সঠিক সময়ে নেওয়া সঠিক পদক্ষেপ এই উন্নয়নকে অন্যদের চেয়ে অনেক গতিশীল করেছে। অনেকে একমত নাও হতে পারে, তবে যেহেতু আমাদের দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম কমবেশি একই রকম তাই এই সময়ে ক্ষমতায় অন্য যে কোন দল থাকলেও ফলাফল যে আকাশ পাতাল তফাৎ হত তা কিন্তু নয়। তবে যেটা হত তা হল এক দল ধনীর পরিবর্তে আরেকদল ধনীর গুদামে উন্নয়নের ফসল উঠত। জনগণ এখন যে ছিটেফোঁটা পায়, তখনও তাই পেত। 


তাহলে সমস্যা কোথায়? দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে, মানুষের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। এটাই কি জাতি হিসেবে আমাদের চাওয়া নয়? 

সেটা নির্ভর করে জাতি বলতে আমরা কী বুঝি তার উপর? যদি আমাদের জাতিসত্তার মূলে থাকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি - তাহলে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের লক্ষ্য হতে পারে না। অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে দরকার শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক বিকাশ।

কিন্তু সেই বিকাশে বাধা কোথায়? আগে আমরা ছিলাম তলাবিহীন ঝুড়ি। সেই সময়েও আমাদের  সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল গতিশীল। এমন কি পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। এখন দেশ স্বাধীন, অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী। তাহলে এখন সমস্যা কিসের?   

শুধু কি পাকিস্তান আমল। বাংলা ভাষার রেনেসাঁ শুরু হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। তাই স্বাধীন না পরাধীন, এটা বড় ফ্যাক্টর নয়। ব্রিটিশ আমলে আমরা ভারতীয় ছিলাম। লড়াই ছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, যদিও শেষের দিকে লড়াইটা ভারতীয় বনাম ব্রিটিশ না হয়ে হিন্দু বনাম মুসলমান হয়েছে আর ব্রিটিশরা বিচারকের আসনে বসে এই লড়াই থেকে ফায়দা লুটেছে। পাকিস্তান আমলে লড়াই ছিল বাঙালি বনাম পশ্চিমা (তখন পশ্চিমা বলতে ইউরোপ আমেরিকা না বুঝিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী বোঝাতো) শোষকদের। কিন্তু স্বাধীনতার পরে দেখা দিল নতুন সমস্যা।  এটাই বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সেটা হল আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, মানে বুঝতে না পারা আমরা কে? আমরা বাঙালি না মুসলমান। মনে রাখতে হবে দুটো পরিচয়ের উৎস ভিন্ন। যদি আমরা নিজেদের বাঙালি ভাবি তাহলে মেনে নিতে হবে আমাদের এই পরিচয়ের মূলে আছে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি যা হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে এই উপত্যাকায়। আর তার ইতিহাস ইসলামের ইতিহাসের চেয়েও পুরানো। এটা আমাদের স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল পরিচয় যা এ অঞ্চলের ভূগোলের সাথে, জলবায়ুর সাথে হারমোনিক বা ঐক্যতানসমন্ধীয়। আর আমরা যদি নিজেদের মুসলমান পরিচয় সামনে নিয়ে আসি সেটা পুরোটাই ধর্মীয় যার উৎপত্তি একেবারে ভিন্ন আর্থ সামাজিক ও ভৌগলিক পরিবেশে। যদি ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ আমাদের সহজাত হয়, ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তা তা নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে পোশাকের কথা। এখন অনেকেই আরব দেশীয় পোশাক পরে। এরা ভাবেও না এই পোশাকের সাথে ধর্মের ততটা সম্পর্ক নেই যতটা আছে আরব দেশীয় আবহাওয়া ও সংস্কৃতির সাথে। "বসন্তের সতেরটি মুহূর্তে" সন্তান প্রসব করার সময় কেট "মামা" বলে চিৎকার করলে জার্মানরা বুঝতে পারে ও আসলে রুশ। কারণ এরকম ক্রান্তি লগ্নে মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলে। আচ্ছা আমাদের দেশে যারা যারা আরবের বা ইউরপীয় পোশাক পরে তারা কী অবসর সময়ে লুঙ্গি বা শাড়ি পরে? নাকি ম্যাক্সি, মিনি, শর্টস, আলখাল্লা এসবের ভিড়ে আমরা ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি?  যাহোক, প্রশ্ন হল এই দুই পরিচয়ের ঐক্য সম্ভব কিনা? এই দুই পরিচয়কে এক করে বাঙালি মুসলমান হওয়ার প্রচেষ্টা দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে। কিন্তু এখানেও মনে হয় ব্যাপারটা তত সহজ নয় যতটা ভাবা হয়। যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই আমরা দেখব বাঙালী জাতি সব সময়ই ছিল বিদ্রোহী, সে কখনোই সহজে কারো অধীনতা মেনে নিতে চায়নি। বার বার বিদ্রোহ করেছে, প্রশ্ন করেছে। সে শুধু বহিঃশক্তিকেই প্রশ্ন করেনি, প্রশ্ন করেছে নিজেকে, প্রশ্ন করেই সময়ের বাঁকে বাঁকে নিজেকে বদলিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। এ কারণেই বার বার হয়েছে সমাজ সংস্কার। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে পারত পক্ষে প্রশ্ন করা ট্যাবু। তারা অন্যের ধর্ম, অন্যের রীতিনীতিকে প্রশ্ন করলেও, অস্বীকার করলেও নিজেকে কখনোই প্রশ্ন করে না, নিজের ধর্মকে, নিজের অনুশাসনকে ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। আর এখানেই শুরু হয় বাঙ্গালির সাথে মুসলমানের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এর বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি সমাজের স্তরে স্তরে। আর এ কারণের স্কুল আর মাদ্রাসা থেকে দুই ভিন্ন ধরণের তরুণরা বেরিয়ে আসে যারা একে অন্যেকে চেনে না, জানে না, বোঝে না। এতে করে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস শুধু বেড়েই চলে।

কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থায় যেখানে সমাজ দ্বিধাবিভক্ত এই ক্রাইসিস থেকে বেরুনোর কোন পথ আছে কি? 

সমস্যা যেখানে থাকে সেখানে সমাধানও থাকে। তবে সমস্যার সমাধান করতে হলে চাই খুব ভালভাবে সমস্যাটা বোঝা আর আন্তরিক ভাবে সমাধানের চেষ্টা করা। আর সে  জন্যে সমস্যাটা বিভিন্ন দিক থেকেই দেখতে হয়, কারণ একমাত্র তাহলেই সেটার একটা তুলনামুলক নিরপেক্ষ চিত্র পাওয়া যাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়  সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশী কমিউনিটির কথা। অন্য দেশের সবাই আমাদের শুধু বাংলাদেশী হিসেবেই দেখত, অথচ আমরা ছিলাম কেউ একমনা, কেউ এস সি, কেউ তাভারিশ আবার কেউ বা নন তাভারিশ। একই কথা বলা যায়  ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে।  অখণ্ড ভারতে আমরা যখন ছিলাম বাঙালি, অহমী, পাঞ্জাবী, মারাঠি, সিন্ধি, তামিল - এই ভূখণ্ডের বাইরে সবাই এদের দেখত ভারতীয় হিসেবে। শুধু তখন কেন, এখনও ইউরোপ আমেরিকায় গেলে সবাই আমাদের ভারতীয় বলেই মনে করে, যদিও ভারতীয় বলতে তারা বর্তমান ভারত না বুঝিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশকেই  বোঝায়। যদি ধর্মের কথাই বলি,  একসময় বাংলার প্রতি গ্রামে গ্রামে নিজ নিজ দেবতা ছিল, ছিল বা আছে বিভিন্ন ধর্মীয় স্রোত, কিন্তু অন্য ধর্মের লোকজন হিন্দু ধর্মের এই এমনকি পরস্পর বিরোধী হাজারো স্রোত দেখতে না পেয়ে সবাইকে নেহায়েত হিন্দু হিসেবেই দেখে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বাইরে থেকে  অন্যেরা যখন কোন কমিউনিটির মধ্যে ঐক্য খুঁজে পাচ্ছে, ভেতরে বসে এই কমিউনিটির সদস্যরা নিজেদের বিভেদকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই অনেক কিছুই নির্ভর করে ঠিক কোন জায়গা থেকে আমরা সেটা দেখছি তার উপর। দূর থেকে দেখলে যাদের ঐক্যটাই চোখে পড়ে, কাছে এলে সেই তাদের মধ্যেই অনেক দ্বন্দ্বও দেখা দেয়। কিন্তু তার দুটো সত্তাই সত্য। মানে চাইলে আমরা আমরা যেমন ধর্ম  বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে বাঙালি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পারি, ঠিক একই ভাবে আমরা ঐক্য না দেখে এই মানুষগুলোকেই ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখতে পারি। 

কিন্তু এ সমস্যা তো আজকের নয়। মনে হয়  অনন্তকাল ধরেই এই ভুমিতে চলে আসছে এটা। এখান থেকে বেরুনোর কি কোন উপায় আছে? 

সমস্যার সমাধান মানে তো সব সময় সেটা উপড়ে ফেলা নয়, অনেক সময় সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেও সমাধানে আসা যায়। তুমি তো আবার ডাক্তার। তোমার ভাষায়ই বলি। ধরা যাক একজন লোক গুরুতর অসুস্থ।  একমাত্র অপারেশনই
 তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে অপারেশন করাও প্রচণ্ড রিস্কি। এক্ষেত্রে কী করা? অন্য ট্রিট্মেন্ট দেওয়া যা রোগের উপশম করে আর একই সাথে ভবিষ্যতে অপারেশনের জন্য রোগীকে প্রস্তুত করা যায়। সমাজেও তাই। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা নতুন নয়। বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বাঙালি মুসলমান নিজেদের মুসলমান পরিচয় সামনে নিয়ে আসে। এতে ব্রিটিশের হাত ছিল আর ছিল তৎকালীন সমাজের শোষণ পীড়ন। ইংরেজ ক্ষমতায় থাকলেও প্রজারা শাসিত আর শোষিত হত স্থানীয় জমিদার দ্বারা। যদিও করের টাকার সিংহভাগ ইংরেজের পকেটেই যেত কিন্তু  সেই টাকাটা জনগণের কাছ থেকে আদায় করত জমিদার আর তার লোকেরা। এটা অনেকটা অফিসের ক্লার্কের মত। মানুষ ঘুষটা তার হাতেই দেয়, তাকেই গালিগালাজ করে। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই ক্লার্ক থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সবাই সেই ঘুষের টাকার ভাগ পায়। সাধারণ মানুষ জমিদারের শ্রেণী চরিত্র দেখত না, তারা দেখত জমিদারের ধর্ম। সঠিক ভাবে বললে তাকে সেভাবে দেখানো হত। অধিকাংশ জমিদার হিন্দু বিধায় অনেক রাজনীতিবিদ এটাকে শোষিতের উপর শোষকের অত্যাচার না বলে মুসলমান প্রজার উপর হিন্দু জমিদারের অত্যাচার বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী"তেও এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে যে বাংলার  জনগণ এমনকি দিল্লির সুলতানের শাসন পর্যন্ত সহজে মেনে নিতে চায় নি, তারাই লাহোর বা করাচীর শাসন স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছে। হয়তো ভেবেছিল যেহেতু ধর্ম এক সেহেতু শোষণ ব্যাপারটাই থাকবে না এই সমীকরণে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে দেখা গেল আমরা আর মুসলমান রইলাম না, হলাম বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচি, কাশ্মীরী ইত্যাদি। ধর্ম যেহেতু বাঙালিকে পাকিস্তানী শাসনের হাত থেকে রেহাই দিল না, বরং ব্রিটিশের চেয়েও নগ্ন উপনিবেশিক শোষণ নেমে এল - বাঙালি ফিরে যেতে চাইল তার সহজাত জাতীয়তাবাদে, ধর্ম নয়, জাতিসত্তা, ভাষা ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এল স্বাধীনতা। বাঙালির লড়াই, সংগ্রাম, তার আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হল বাহাত্তরের সংবিধানে। 

কিন্তু আমরা তো সেই সংবিধান ত্যাগ করেছি। সেখানে ফেরার কি সুযোগ আছে? 

সংবিধান হল একটা আউট লাইন। এর দুটো দিক আছে। প্রথমত সংবিধান জনগণের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে। দ্বিতীয়ত তা একই সাথে দেখায় কোন পথে আমরা যাব। কোন দেশই সব নাগরিককে সংবিধানে বর্ণিত অধিকার দিতে পারে না, কিন্তু জনগণ নিজেদের বঞ্চিত মনে করলে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। প্রচলিত আইনের মধ্যেই নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। তবে যেকোনো গতিশীল সমাজই তার পরিকল্পনা এমন ভাবে করে যে সেখানে পৌঁছুনর জন্য আজীবন চেষ্টা করতে হবে। ধরা যাক একজন ডাক্তার হতে চায়। ডাক্তার মানে যদি তার কাছে শুধু ডিপ্লোমা পাওয়া  আর সেই সাথে ডাক্তারি করার সার্টিফিকেট পাওয়া হয় তাহলে তার স্বপ্ন এখানেই শেষ। কিন্তু ডাক্তার হওয়া মানে যদি মানুষের রোগ সারানো হয়, কিভাবে মানুষের রোগশোক কমানো যায় সেটা হয়, তাহলে কিন্তু তার শিক্ষা সার্টিফিকেট পাওয়ার মধ্য দিয়েই শেষ হবে না, সে আজীবন শিখবে আর প্রতিদিন নিজেকে সে গতকালের চেয়েও ভালো আর অভিজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে আবিষ্কার করবে। সংবিধান তেমনটাই। প্রতিনিয়ত মানুষের নাগরিক অধিকার শুধু নিশ্চিতই করে না, সেই অধিকারের মান উন্নত করার পথ দেখায়। আমি বলছি না এই মুহূর্তেই বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনতে হবে। আসলে ফর্মালি সেটা করা অর্থহীন যদি না মানুষ সেটাকে গ্রহণ করে। সেক্ষেত্রে আমাদের কী করতে হবে? রাজনৈতিক পরিবেশ বদলাতে হবে। মানুষকে বলতে হবে বর্তমানের নয়, বাহাত্তরের সংবিধানই আমাদেরকে জাতি হিসেবে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন বাহাত্তরের সংবিধানের দিকে গেছি, আজও আমাদের একটু একটু করে সেদিকেই অগ্রসর হতে হবে। লক্ষ্য যদি আমরা একবার ঠিক করতে পারি রাজনীতির ধারাও পরিবর্তিত হবে। এই যে আজ আমরা অপরাজনীতির শিকার সেটা  কিন্তু ওই লক্ষ্য থেকে সরে আসার কারণেই।  এর ফলে আমাদের আরও নতুন কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বদলে গেছে আমাদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞা। তবে সেটা মনে হয় আজ আমাদের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। 

যেমন?

আমরা দেশপ্রেম বলতে আজ আর যতটা না দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট বুঝি তার চেয়ে বেশি বুঝি বিদেশ বা শত্রু দেশের প্রতি ঘৃণা। আমাদের দেশে যেমন ভারত বিরোধিতা দেশপ্রেমের সুচক, ভারত বা পাকিস্তানে তেমনি পাকিস্তান বা ভারত বিরোধিতা দেশপ্রেমের সুচক। আমেরিকায় গত চার বছরে রাশিয়া নিয়ে যে কাণ্ড ঘটলো, তাতে মনে হয় সেখানেও দেশপ্রেমের গভীরতা মাপা হয় রুশ বিরোধিতার স্কেলে। এটাই দেশে দেশে মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করছে। এরফলে রাজনীতি এখন মানুষের প্রতি ভালবাসা বা দায়িত্ববোধ না হয়ে হয়েছে ভিন্ন চিন্তার মানুষের প্রতি ঘৃণার অস্ত্র। দেশে দেশে রাজনীতি পরিণত হচ্ছে অপরাজনীতিতে।   

এমনটা কেন হচ্ছে? কোন আইডিয়া?

আমার মনে হয় এটা রাজনীতিকে ডগমায় পরিণত করার ফল। একটা সময় ছিল যখন সাধুসন্তরা ধর্ম প্রচার করত। ফলে সেই প্রচার হত কমবেশি শান্তিপূর্ণ। তাঁরা যে বাধার সম্মুখীন হত না তা নয়, তবে তা রাজনীতির বাইরে ছিল। এরপর ক্ষমতাসীনরা ধর্মকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। অনেক রাজা বাদশাই হয় প্রেরিত পুরুষ। এরপর মানুষ ঈশ্বরের পরিবর্তে মানুষের শক্তিতে আস্থা রাখতে শুরু করে। দেবতা নয়, মানুষ নিজেই মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, এমনকি ফ্যাসিবাদ এই ধারায় বিশ্বাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সমাজতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই ডগমায় পরিণত হয়, এটাও হয় এক ধরণের ধর্ম। সোভিয়েত ইউনিয়নে আমরা সেটা দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশেষ করে নিও লিবারেলদের হাতে গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ এসবও ডগমায় পরিণত হয়েছে, এসব আদর্শও আজ এক ধরণের ধর্মে পরিণত হয়েছে। তাই আমেরিকার মত দেশ মিসাইল দিয়ে দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে নেমেছে, যদিও এটা শুধুই অজুহাত। আসলে লক্ষ্য সেসব দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করা। সেসব দেশে পুতুল সরকার বসানো।  মাস মিডিয়ার জোরে আজকাল সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানানো অনেক সহজ হয়ে গেছে।  সব মিলিয়ে  বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে  ফাইনান্সিয়াল, ট্র্যান্সন্যাশনাল কোম্পানিগুলো হাতে। রাজনীতি যখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায় তখন তা কিরূপ ধারণ করে বাংলাদেশ তার চাক্ষুষ প্রমাণ।

তাহলে কি স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ? 

ব্যর্থ হবে কেন? সব স্বাধীনতাই একটু হলেও পরাধীনতা আনে। আমরা পরাধীন হই স্বাধীনতা লাভের ফলে আমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের কাছে। কিন্তু আমরা সেই দায়িত্ব নিতে ভয় পাই। স্বাধীনতা অনেকের কাছেই নিজেদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নত করার উপায়। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে না পারলে সেটা যে মিথ্যা হয়ে যাবে, তা আমরা অনেকেই বুঝি না। ফলে বদল হয় শুধু মালিকের, সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না, হলেও সাধারণত সেটা হয় নিম্নগামী। আপাত দৃষ্টিতে সেটাকে উন্নতি মনে হলেও সমাজের উপরতলার মানুষের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় সময়ের সাথে বৈষম্য শুধু বেড়েই চলছে। এ সবের পরেও স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ নয়। একাত্তর আমাদের ইতিহাসের স্পাইরালের উচ্চতর বলয়ে নিয়ে গেছে। এখান থেকে শোষণ মুক্ত সমাজ গড়া যতটা সহজ হবে, পরাধীন থাকলে সেটা তত সহজ হত না। কেননা শোষণ মুক্ত সমাজ এটা শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি নয়, মুক্ত চিন্তার চর্চা। আর এর জন্য দরকার শিক্ষা। স্বাধীন দেশে সেই শিক্ষা লাভ করা যত সহজ পরাধীন দেশে তত সহজ নয়। তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি যদিও এখনও পর্যন্ত মানুষকে প্রকৃত স্বাধীন করতে পারেনি, মানুষকে তার স্বপ্নের জায়গায় নিয় যেতে পারেনি। আমরা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে আমরা মুক্ত চিন্তা করতে ভুলে যাচ্ছি, ধর্মীয় অন্ধত্বে ভুগছি। সুনীল গাঙ্গুলী "অর্ধেক জীবনে" এক জায়গায় পূর্ব বঙ্গ থেকে ভারতে যাওয়া উদবাস্তুদের সম্পর্কে  লিখেছেন, আমরা স্বাধীনতা পেলাম কিন্তু জন্মভূমি হারালাম। অনেক সময় আমারও মনে হয়, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদ হারাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। আমিও সেই বিশ্বাস ধারণ করি, মানে সব কিছুর পরেও মানুষকে বিশ্বাস করি। সেই আদিম মানুষ থেকে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানুষ আজ ভিন গ্রহে উপনিবেশ করার কথা ভাবছে। মানুষের এই অগ্রগতি কেউই রোধ করতে পারেনি, পারবেও না, যদি না কেউ গোটা মানব জাতিকেই ধ্বংস করে। আমার বিশ্বাস একদিন এ আঁধার ঘুচবেই। 

যাকগে দোস্ত, অনেক রাত হয়েছে। এইসব প্যাচালে পেট ভরবে না। যাই, একটু ঘুমাই। কাল আবার ক্লিনিকে যেতে হবে।

হ্যাঁ, দোস্ত। আজকাল ঘুমানো আর মাঝে মধ্যে লেখালেখি ছাড়া আমরা আর কীই বা করতে পারি। শুভ রাত্রি! 

দুবনা, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১  






Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি