মূল্যায়ন

 


করোনা কালে যেহেতু অনেক সময় ঘরে থাকা হয়, তাই প্রায়ই বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রাম দেখি। এদের একটা রাশিয়া ১ এ বরিস করচেবনিকভের মানুষের ভাগ্য। এখানে ও বিভিন্ন জনপ্রিয় মানুষদের ডেকে তাঁদের জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। করে সেটা খুব অন্তরঙ্গ পরিবেশে। সেদিন এমন এক প্রোগ্রামে ও এক ফিল্ম ডাইরেক্টরকে জিজ্ঞেস করল ভিসোতস্কির সাথে এত বন্ধুত্বের পরেও ও কেন তাকে নিয়ে ছবি করল না। উত্তর, "তখন বোকা ছিলাম।"

ওটা শুনে আমার মনে পড়ল এক বন্ধুর কথা যে ভিসোতস্কির গান পছন্দ করত না। আমরা একই বছরে মস্কো এসেছি। বিভিন্ন বিষয়ে ওর আগ্রহ। তাই ওর কথা মনে পড়ল। এটা আশ্চর্যের কিছু নয়। বরং ভাবলাম আমরা কেন তখন ভিসোতস্কিকে খুব একটা পছন্দ করতাম না যদিও সোভিয়েত জনগণের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। যেহেতু সোভিয়েত সরকার বা পার্টির সাথে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না তাই সরকারি ভাবে তাঁর গানের রেকর্ড খুব একটা বের হত না। বন্ধুরা বাসায় তাঁর গান ক্যাসেটে ধারণ করে সেসব প্রচার করত আর মানুষ প্রচণ্ড রিস্ক নিয়ে হলেও সেসব কিনত। তিনি তাগানকা থিয়েটারে অভিনয় করতেন, অভিনয় করতেন বিভিন্ন সিনেমায় - ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা। তারপরেও আমাদের অনেকেরই কেন তাঁর গান ভালো লাগত না?

এখনকার কথা বলতে পারব না, তবে আমরা যখন দেশ থেকে আসি তখন গানের প্রধান বিষয় ছিল সুর। যার কণ্ঠ যত সুরেলা তারাই তত ভালো গায়ক। এটা আমাদের দেশে শুধু নয়, এ দেশেও ছিল। সেক্ষেত্রে ভিসোতস্কির স্বর ছিল বেশ কর্কশ, গায়কি ছিল শ্লোগানের মত। যেন চিৎকার করে নিজের সব প্রতিবাদের কথা তিনি জানাচ্ছেন বিশ্বকে। ছাত্র জীবনের প্রথম দিকে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে খারাপ ছিলাম না। আমাদের স্টাইপেণ্ড ছিল প্রায় ১০০ রুবল - একার সংসার। সেটা অনেক সোভিয়েত পরিবারের গড় আয়ের চেয়ে বেশি। তাই খেয়েপরে ভালই চলত। সোভিয়েত দেশের সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা সম্পর্কে আমাদের ধারণা তেমন ছিল না। কোন কোন সোভিয়েত বন্ধুর অসন্তোষ দেখে ভাবতাম তোমরা যদি তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে আসতে, বুঝতে কত ধানে কত চাল। পরে যখন এ দেশে থেকে গেলাম, এ দেশের মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা হল, যখন জানতে পারলাম ছোটখাটো শহরে বা গ্রামে গঞ্জে মানুষ কতখানি বঞ্চনার মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছে তখন অন্য ভাবে দেখতে শুরু করলাম এ দেশকে। তখন কেউ চাকরি ছাড়া ছিল না, সবার কম বেশি আয় ছিল, মাথা গোঁজার ঠাই ছিল, কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ছিল ভীষণ অভাব। মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হত সাধারণ জিনিসপত্রের জন্য। ১৯৮৩ সালে আমরা মস্কো শহরেও কিছু কিছু জিনিসের অভাব অনুভব করেছি, আর ১৯৮৭ - ১৯৮৮ থেকে প্রায় সবই উধাও। দুবনায় অনেক বন্ধুদের মুখে শুনি তাদের মস্কো পর্যন্ত যেতে হত সাধারণ জিনিসের খোঁজে। মাংস, কালবাসা এসব জিনিস মানুষ মস্কো থেকে কিনে আনত বলে অনেক ট্রেনের নামই ছিল কালবাসা ট্রেন। তখন একটা জোক ছিল "সোভিয়েত ইউনিয়ন আতলিচনায়া স্ত্রানা" ("সোভিয়েত ইউনিয়ন এক্সিলেন্ট দেশ") এর প্রেক্ষিতে অনেকে বলত "সোভিয়েত ইউনিয়ন আতলিচনায়া স্ত্রানা আত দ্রুগিখ" ("সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্য সব দেশের চেয়ে এক্সেপশনাল")। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেকের কাছেই স্বপ্নের দেশ হলেও অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নের দেশও। ভিসোতস্কি এসব কথাই তাঁর গানে বলতেন, এসব বলতেন স্যাটিরিস্টরা। এসব ছিল মানুষের মনের কথা, মানুষের মনের গভীরে জমে থাকা প্রতিবাদ। তাই হেরে গলায় ভিসোতস্কির গান ছিল এত জনপ্রিয়।

সমস্যা আসলে সব কিছুর সরলীকরণে, সব কিছুকে সাদা কালো এই দুই রঙে দেখায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার সব কিছুকে দু রঙে দেখার অভ্যেস এখন অনেক দেশেই সংক্রামিত হয়েছে - সেটাই আসলে একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল সেখান থেকে উধাও হচ্ছে মানবিক উপকরণ।

দুবনা, ০৫ জুন ২০২১ 
 

 


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা