কাজ ও আনন্দ

 


অনেক দিন থেকেই আমি বিশ্বাস করি কাজ থেকে পাওয়া আনন্দই আসল, আর ফলাফল, তা সে বেতন হোক আর যাই হোক সেটা বোনাস। তার মানে এই নয় একজন ছাত্র পাশ করার জন্য পড়বে না। কথা হল পরীক্ষার নম্বরটাই যেন লক্ষ্য না হয়, পড়াশুনার আসল লক্ষ্যে যেন হয় জ্ঞান অর্জন করা। একই ভাবে চাকরির ক্ষেত্রেও বেতনই যেন শেষ কথা না হয়, আসল হয় কাজটা সুষ্ঠু ভাবে করার আনন্দ। আমরা যখন কাজ করে আনন্দ পাই, তখন কাজটা সত্যিকার অর্থেই ঠিকঠাক ভাবে করা হয়। সেটা না হলে হয়তো বেতন আসে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায়, কিন্তু কাজ হয় না, জ্ঞান অর্জন হয় না।

জীবনে অনেক লোককে দেখেছি এই সহজ সত্যটুকু উপলব্ধি করতে না পেরে কষ্ট পেয়েছেন। ফেসবুকেও এরকম ইতিহাস কম নয়। অনেক বাবা মা সন্তানদের নিয়ে কষ্ট পান। অনেকে আবার অন্যের বাবা মার কষ্ট নিয়ে গল্প লেখে। কিন্তু কোন বাবা মা যদি সন্তানকে মানুষ করার আনন্দ থেকেই ওদের বড় করেন, ওরা বড় হয়ে এক সময় দেখাশুনা করবে এটা না ভেবে শুধু মাত্র নিজের আনন্দ থেকেই সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেন তাহলে তাঁদের কখনই এমন অসুখী হতে হবে না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের মনে হবে না তারা অমানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে।

আবার অনেককে দেখি, যারা নিজেদের নেতা ভাবেন, নেতা হিসেবে অনেক কিছুই করেছেন - মনঃক্ষুণ্ণ হচ্ছেন। তারা কিন্তু প্রথমত নিজের জন্য পথ খোঁজেন, কিন্তু যখনই পাঁচ দশ জন মানুষকে নিজের পথে আনতে পারেন, এরা নিজেদের কাঁধে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। নেন যতটা না অন্যদের জন্য তারচেয়ে বেশি নিজের চোখে, সমাজের চোখে নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য। এক সময় তারা ভাবতে শুরু করেন নিজের জন্য নয় অন্যের জন্য পথ খোঁজা, অন্যের ভাগ্য নির্ধারণ করাই তার মিশন। কিন্তু সেটা তার নিজের ভাবনা। সবাই যে সেভাবেই ভাববে তা নয়। ফলে তারা মনে আঘাত পান। না, কেউ তাদের আঘাত করে না, এরা ভেবে নেন তাদের কাজের প্রতিদান স্বরূপ অন্যেরা তাদের মত চলতে, বলতে বাধ্য। আর যখনই কেউ নিজের মত করে ভাবে, অন্য ভাবে ভাবে শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা। অন্যদের প্রতি দোষারোপ। কাজের আনন্দ নয়, নেতা হবার আনন্দই এ সময় তাকে চালিত করে, এটাকেই সে আল্টিমেট প্রাইজ বলে মনে করে। আর এখানে বাঁধা এলে, এখানে বিদ্রোহ এলে তারা নিজেদের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেন। এটা অনেকটা পাড়ার গুণ্ডার মত। তার একটাই কাজ সবাইকে নিজের তাবেদার করা। এমনকি অতি সামান্য একজন লোকও যদি তাকে অমান্য করে, সে সেটা মেনে নিতে পারে না, মশা মারতে কামান দাগে। কেন? আসলে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ - এসব বড়ই সংক্রামক। সে জানে একবার যদি কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় তখন একের পর এক মানুষ তার প্রতিবাদ করবে। প্রথম প্রতিবাদ তাই যতই ছোট্ট হোক, তাকে দমাতে না পারলে প্রতিবাদের বন্যা বয়ে যাবে আর সেই বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তার স্বপ্ন, তার ক্ষমতা।

আমাদের মূল সমস্যা আসলে আমাদের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণের অপারগতা থেকে। আমরা প্রায়ই নিজেদের ক্ষমতা বা সামর্থ্যের চেয়ে বড় আকাঙ্খার বোঝা কাঁধে তুলে নেই আর যখনই নিজের বেহিসেবের কারণে আশাটা দুরাশায় পরিণত হয় - আমরা হতাশায় ভুগি, খুঁজি কার ঘাড়ে নিজের ব্যর্থতার বোঝাটা চাপিয়ে দেওয়া যায়। সময় মত নিজেকে না বোঝাই এক সময় বিশাল বোঝা হয়ে আমাদের ক্রমাগত মাটিতে মিশিয়ে দেয়।

সব দেখে আমার মনে হয় মানুষ যদি নিজের কাজ করার প্রক্রিয়া থেকে আনন্দ পায় তাহলে তার হতাশা কমবে, ব্যর্থতায় সে নিরাশ হবে না আর সাফল্য তাকে পরম তৃপ্তি দেবে।

দুবনা, ১১ জুন ২০২১





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা