বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ও করণীয়
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানকে আলাদা ভাবে দেখার উপায়
নেই, একে দেখতে হবে বিশ্বের সামগ্রিক পরিবেশের ভিত্তিতেই| আর সারা বিশ্বে
জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য অনেক কিছুই দায়ী| সেটা একদিকে যেমন ইন্ফর্মেসনের সহজ
লভ্যতা আর তার সত্যতা যাচাইয়ের প্রতি দায়িত্বহীনতা, অন্যদিকে বিভিন্ন গোষ্ঠির,
বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী এইসব তথ্য ম্যানিপুলেট করা|
অর্থাৎ নিজেদের প্রয়োজনে কোনো একটা সংবাদ তৈরী করে গুজব রটানো, তারপর নিয়ন্ত্রিত
সংবাদ মাধ্যম ব্যবহার করে সেই রটনাকে মানুষের চোখে ঘটনায় পরিনত করা| এটা দেখা গেছে
ইরাক আক্রমনের আগে কলিন পাওযেলের টেস্ট-টিউব নাড়ানোর ঘটনা থেকে ইউক্রেনের আকাশে মালোশিয়ার
বিমান ধ্বংসের মধ্য দিয়ে| আমাদের দেশেও আজকাল ফেসবুকে কেউ ইসলাম ধর্ম বা নবীজীকে
নিয়ে কটু মন্তব্য করেছে রটিয়ে একাধিকবার আক্রমন করা হয়েছে ব্লগার বা সংখ্যালঘুদের
উপর| এ ছাড়াও আছে বিচার ব্যবস্থার অবনতি। আগে যদি কাউকে অভিযুক্ত করা হতো আর তার পর সে অভিযোগ প্রমান করা হতো, এখন আন্তর্জাতিক প্রায় সব ব্যাপারেই দোষী সাব্যস্ত করা হয় আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই প্রমান করতে হয় সে দায়ী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের এই বিচারহীনতার রাজনীতিও দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, আর এটাও অনেক সময় জন্ম দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদের।
আমার মনে হয় বর্তমান অবস্থা বুঝার
জন্য আমাদের একটু পেছন দিকে ফিরে যেতে হবে, খুব সম্ভব ১৯৭৯ সালে, যখন সোভিয়েত
ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়| যে অজুহাতেই পাঠানো হোক না কেন, পশ্চিমা বিশ্ব ও
সৌদি আরব এটাকে খুব ভালো ভাবেই কাজে লাগিয়েছে, আর এই যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ
হিসেবে ব্যবহার করেছে| এই আফগান যুদ্ধের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে তালেবান আর
আল-কায়েদা| এদিক থেকে দেখতে গেলে সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো, বিশেষ করে যে সমস্ত
সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামকে ব্যবহার করছে নিজেদের আদর্শ হিসেবে, তারা সবাই
সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি| একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে এসব সংগঠনগুলো সক্রিয় মূলতঃ সে
সব দেশেই যে দেশের সরকার আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের কথায় ওঠ-বস করে না বা করতো
না, তা সে আফগানিস্তান হোক, ইরাক, লিবিয়া বা সিরিয়া হোক| বাংলাদেশেও এসব দলের
সন্ত্রাসী তত্পরতা তখই বাড়ে যখন সরকার কোনো কোনো প্রশ্নে পশ্চিমা ও আরব বিশ্বের
সাথে দ্বিমত প্রকাশ করার সাহস দেখায়|
তালেবান আর আল-কায়েদার জন্মের সাথে
যে সিআইএ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এ নিয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ নেই| ইদানিং
কালে এরকম খবর পাওয়া যাচ্ছে যে আইএস বা দায়েশও ইসরাইল আর আমেরিকার তৈরী| আমেরিকা পারতপক্ষে
এটা তাদের ইরাক নীতির ফল হিসেবে স্বীকার করলেও, এটা যে সরাসরি সিআইএ আর মাসাদের
তৈরী এটা স্বীকার করে নি| তবে যদি একটু খেয়াল করি, তবে দেখা যাবে এইসব সংগঠনের
কাজকর্মে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব, ইউরোপ আর এশিয়া| আর লাভের কড়ি গুনছে আমেরিকা
আর কিছুটা হলেও ইসরাইল| তাই আমাদের দেশের সন্ত্রাসী দলগুলো যতই দেশীয় হোক না কেন,
এদের মাধ্যমেও যে বিদেশী শক্তি তাদের কায়েমী স্বার্থ আদায় করছে, এটা বলার অপেক্ষা
রাখেনা|
এর বাইরেও যেসব ব্যাপার জঙ্গীবাদ
উত্থানের জন্য দায়ী, (i) সেটা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, (ii) পশ্চাদপদ শিক্ষা ব্যবস্থা, (iii) ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, (iv) দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একতার অভাব আর (v) সবার উপর দেশের থেকে দলের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেবার
প্রবণতা| তাই দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে এসব বিষয়েই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে|
এখানে উল্ল্যেখ করা দরকার, ১৯৪৭ সনে
যখন ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয় তখন পরিস্থিতি ছিলো ভিন্ন|
পাকিস্তানের জন্ম দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে যেখানে দেশের মূলমন্ত্র ছিলো
সাম্প্রদায়িকতা – হিন্দু-মুসলমানের বৈরিতা| ভারত দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে না হলেও
দ্বিজাতি তত্বকে মেনে নিয়ে জন্ম নেয়| ১৯৪০ এর দশকে শেখ মুজিবসহ অনেক নেতারাই এই
দ্বিজাতি তত্বকে গ্রহণ করলেও পাকিস্তান জন্মের কিছু কাল পরেই তা থেকে সরে আসেন, আর
৫২ র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে প্রতিটি আন্দোলনই হয় বাঙ্গালী
জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে, যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আমরা সবাই
বাঙ্গালী – এই স্লোগান হয় অন্যতম প্রধান| একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এই ঐক্যের
ভিত্তিতেই হয়| আর তারই বহিঃপ্রকাশ ১৯৭২ এর সংবিধান – যেখানে চার মূলনীতি ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও
সমাজতন্ত্র| যদি দ্বিজাতি তত্ব ছিলো জিন্নাহর মস্তিষ্ক প্রসুত, তবে ১৯৭২ এর
সংবিধান ছিলো বাংলার মানুষের দীর্ঘ ২৪ বছর লড়াইয়ের ফসল, ৩০ লক্ষ প্রাণ আর দুই লক্ষ
মা-বনের ইজ্জত্বের বিনিময়ে অর্জিত ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরীক্ষিত নীতিমালার এক
সফল সমন্বয়|
শুধু পাকিস্তান আমলেই নয়, স্বাধীন
বাংলাদেশের ইতিহাসেও বাংলার মানুষ বার বার
প্রমান দিয়েছে ১৯৭২ এর সংবিধানের প্রতি তার অঙ্গীকারের| ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে
সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয় তাতে প্রথমেই যেটা করা হয়, তা
হলো ধর্মকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরিয়ে আনা| ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ইসলাম পায়
রাষ্ট্র ধর্মের সম্মান – আর এর মধ্য দিয়ে অস্বীকার করা হয় মুক্তিযুদ্ধের পথকে,
শহীদদের রক্তের প্রতি জাতির অঙ্গীকারকে| ১৯৯১ এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুধু
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনই ছিলো না, এটা ছিলো বাংলাদেশকে এই বিপথ থেকে সরিয়ে আনার
আন্দোলন| এর পর বাংলার মানুষ আবারও রাস্তায় নামে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে
বাংলা আবারও উত্তাল হয়ে ওঠে, মানুষ আবার ত্যাগ করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি| আর এসব
ঘটনা বার বার প্রমান করে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলা মায়ের দুই
যমজ সন্তান – একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটা চলতে পারে না, কৃত্রিমভাবে চালাতে গেলে বার
বার হোচট খায় দেশ, ব্যাহত হয় দেশের অগ্রগতি| তাই একদিকে যেমন স্বাধীনতার পক্ষের
মূল রাজনৈতিক দলগুলো জনগনের ধর্মভীরুতার, আর সে কারণে ভোট হারানোর ভয়ে রাষ্ট্র
ধর্ম সম্পর্কে মুখে কুলুপ এটে থাকেন, অন্যদিকে দ্বিজাতি তত্বে বিশ্বাসী রাজনৈতিক
দলগুলো তথা ধর্ম ব্যবসায়ীরা সরকারের ও জনগনের এই ধর্মভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে
একের পর এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে| দেশকে যদি এই ধর্মীয় রাজনীতির থেকে বের
করে আনতে হয়, দেশ ও জাতিকে যদি এই জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হয় ১৯৭২ এর
সংবিধানে ফিরে যাবার কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করি|
বিগত দিনগুলোতে একের পর এক ধর্মীয়
সংখ্যালঘু, মুক্তমনা ব্লগার, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, এলজিবিটি সোসাইটির সমর্থকসহ
অনেকেই নিহত হলো সন্ত্রাসীদের হাতে| ১ জুলাই
হলি আর্টিজান আক্রমণে নিহত হয় বেশ কিছু বিদেশী, যারা দেশের বিভিন্ন
উন্নয়নমূলক কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এছাড়া আক্রান্ত হয় শিয়া সম্প্রদায়, এমনকি ঈদের দিন ঈদগাহ মাঠেও সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালাতে পিছ পা
হয়নি। এ ঘটনা
আবারো প্রমান করে যে ধর্মের নামে করলেও এসব আক্রমণের মূল উদ্যেশ্য দেশকে, দেশের আর্থ -সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভোটের রাজনৈতিক অংকের মারপ্যাঁচে এসব ঘটনা
অনেকক্ষেত্রেই বিচারের আওতায় আসছেনা। অন্যদিকে সরকারি ও বিরোধীদলের অনেক স্থানীয় নেতাকর্মী জড়িত থাকায়
সাধারণ মানুষের পক্ষে বিচার আশা করা ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। ফলে বাস্তুভিটা হারাচ্ছে শত শত হিন্দু
পরিবার, বাধ্য হচ্ছে দেশত্যাগে। আর এদের সাথে সাথে চলে যাচ্ছে হাজার বছরের
সংস্কৃতি। যে ভাষা, যে সংস্কৃতির জন্য এতো প্রাণ
হলো বলিদান, সেই ভাষা, সেই সংস্কৃতি আজ আরব্য সংস্কৃতির কাছে ক্রমশই পরাজিত হচ্ছে।
হলি আর্টিজানের ঘটনা প্রমান করছে, শুধু মাদ্রাসায়
পড়াশুনা করা অল্প শিক্ষিতরাই নয়, দেশের প্রথম সারির বিদ্যাপাঠগুলোর
অনেক শিক্ষার্থী, সমাজের উচ্চশ্রেণীর অনেক সন্তান আজ তালেবান, ইসলামিক রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মৌলবাদী ইসলামিক চিন্তাধারা দিয়ে
প্রভাবিত এবং এই চিন্তার বাস্তবায়নে তারা যে কোনো অমানবিক কাজ করতে প্রস্তুত।
সন্ত্রাসীরা ধর্মের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ
করেছে। বাংলাদেশ
সরকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। বরং যে হারে দেশের তরুণ সমাজ মৌলবাদী ভাবাদর্শে দীক্ষিত হচ্ছে, তাতে মনে হয় প্রোপাগান্ডা যুদ্ধেও হেরে যাচ্ছে তারা। বর্তমানে সারা বিশ্বে জিহাদের পক্ষে ইসলামের
নামে যে প্রোপাগান্ডা চলছে,
ধর্মের নামে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কর্মকান্ডকে যেভাবে
ব্যবহার করা হচ্ছে, তাকে রুখতে হলে পাল্টা প্রোপাগান্ডা দরকার – এই প্রোপাগান্ডা ইসলাম বিরোধী নয়, সেটা হবে ইসলামকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে। সরকারী প্রচার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের
বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ইসলামিক চিন্তাবিদদের এই কাজের শরিক করতে হবে। এটা আসলে বহুমুখী সমস্যা, সমাধানও হতে হবে বহুমুখী। সবই সম্ভব যদি তার পেছনে রাজনৈতিক বলিষ্ঠতা
থাকে। বুঝতে হবে
জঙ্গিবাদ ইসলামের তথা বাংলাদেশের শত্রু, জঙ্গিবাদ ইসলাম তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলও সাম্রাজ্যবাদী
শক্তির হাতিযার, জঙ্গি ইসলামকে
দমানো মানে ইসলাম বিরোধিতা নয়, এর মানে ইসলামকে তথা বাংলাদেশকে অশুভ শক্তির হাত থেকে মুক্ত
করা।
আরো একটা জিনিষ
আমাদের মনে রাখা দরকার, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। ১৯৯১ এ সোভিয়েত
ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পরে পশ্চিমা বিশ্ব আর রাশিয়ার মধ্যে যে মধুমাস চলছিল তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছর পশ্চিমা দুনিয়া উঠে পরে লেগেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে, এমবার্গো, সাবোটাজ, এমনকি অলিম্পিকে অংশগ্রহণ থেকে খেলোয়াড়দের বঞ্চিত করা আরো কত কি। এই অবস্থায় রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের উত্তরোত্তর সম্পর্ক উন্নয়ন, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি পশ্চিমা দুনিয়া ভালো চোখে দেখছে না এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। তাই বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা যে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একান্ত কাম্য সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা ছাড়া একের পর এক ঘটে যাওয়া টার্গেট কিলিংগুলো প্রমান করে এসব ঘটনা সুপরিকল্পিত। যারা এসব কাজ করছে আর পেছন থেকে কলকব্জা নাড়ছে তারা উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য ছাড়া ঠান্ডা মাথায় একের পর এক হত্যাকান্ড চালানো কতটা সম্ভব সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। তাই বাংলাদেশের প্রশাসনের বাংলাদেশে আল-কায়েদা বা দায়েশ নেই বলে আনন্দিত না হয়ে বরং গভীরভাবে
ব্যাপারটা ভেবে দেখা দরকার আর ঠিক কোন কোন বিদেশী শক্তি দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে সেটাও অধিক গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান করে দেখা দরকার।
এছাড়া যে জিনিসটা আমাদের অগ্রগতি, তা সে যে প্রশ্নেই হোক না কেন, ব্যাহত করে তা হলো রাজনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এন্টাগোনিসম। আমরা পাকিস্তান বিরোধী হই, ভারত বিরোধী হই, আমেরিকা বা রাশিয়া বিরোধী হই আর এ নিয়ে অনবরত একে অন্যের সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হই। স্বাধীনতার পর ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে, শৈশব কৈশোর পার করে দেশ আজ পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তাই দেশের মানুষের, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যবহারও
বয়স্ক মানুষের ব্যবহারের মতো হওয়া
উচিৎ।
বিভিন্ন দেশের মতো আমাদেরও
বলতে শিখতে হবে, দেশ হিসেবে আমাদের বন্ধু বা শত্রু নেই, আছে জাতীয় স্বার্থ, দেশের মানুষের স্বার্থ। আর যদি এই মন্ত্র মেনে আমরা, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সামনের দিকে এগুতে পারি, শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়, আরো অনেক পশ্চাৎপদটতাই বিদায় নেবে সোনার বাংলা থেকে।
তবে এই সংগ্রামে একবার নামলে আর পিছু ফেরার উপায় নেই। আর সে জন্যে যদি ভোটের
হিসেবে কিছুটা গোলমাল হয় সেটা মেনে নিয়েই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে পরে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ ও সেক্ষেত্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া। ওই দিন সরকার দেখিয়েছে, চাইলে অনেক বড় বিপদের মোকাবিলা তারা বলিষ্ঠ ভাবেই করতে পারে। সরকার একই রকম দৃঢ়তা দেখিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে। আর দেশের মানুষ শাহবাগে জড়িত হয়ে এইসব কাজের প্রতি জানিয়েছে তাদের অকুন্ঠ সমর্থন। আমার বিশ্বাস, সরকার যদি একই ভাবে সন্ত্রাসদমনে নামে, ধর্মের নামে
যারা দেশে সাম্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে নামে, জনগণের সমর্থন তাদের পেছনে অবশ্যই থাকবে। সেটা শুধু আন্দোলোনেই নয়, ভোটেও। মানুষ কখনোই কোনো প্রশ্নেই দোদুল্যমানতা পছন্দ করে না, তারা চায় দৃঢ়তা যেটা দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষা করে। বাংলাদেশের মানুষ বার বার রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়, আর রাজনৈতিক দলগুলো দূরদর্শিতার অভাবে হারিয়ে ফেলেছে বিজয়ের ফল। তাই আজ যদি আমরা জঙ্গীবাদের, সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন করতে না পারি, ইতিহাস আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে জঙ্গীবাদ
ও সাম্প্রদায়িকতা একে অন্যের পরিপূরক, একটাকে রেখে অন্যটা জয় করা যায় না, যাবে না। তা যদি যেত, তাহলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হতো না, বাংলাদেশের জন্ম হতো না। ধর্মনিরপেক্ষতা - এটা কোনো গাল ভরা বুলি নয়, এটা বাংলাদেশের সঞ্জীবনী মন্ত্র, বাংলাদেশের অস্তিত্বের জীয়ন কাঠি। বাহাত্তরের সংবিধান - সন্ত্রাসহীন বাংলাদেশের একমাত্র ওষুধ।
আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করলাম। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেলাম, অথচ পাকিস্তানের কালা-কানুন
থেকে রেহাই পেলাম না। ১৯৬৫ তে পাকিস্তানের তৈরী শত্রু সম্পত্তি আইন যাকে পরে অর্পিত
সম্পত্তি আইন নাম দিয়ে বাংলাদেশের বুকে বৈধতা দেয়া হয়, আজও লাখ লাখ মানুষকে ভূমিহীন করছে, দেশ ছাড়া করছে। আশ্চর্যের ব্যাপার শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণয়নের
তিন যুগ আগে যে মাস্টারদা সূর্য্য সেন মারা যান, তার সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত
হয় ২০০১ এ, আর বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন
যে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, তার সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত হয় সত্তরের দশকে পাক
হানাদার বাহিনীর হাতে তার বর্বরোচিত মৃত্যুর পরে। আজও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের
লোভে এই আইনকে কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল। আর এর জন্য বিভিন্ন সন্ত্রাসী পদ্ধতির আশ্রয় নিজেও
পিছ পা হচ্ছে না তারা। তাই অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রত্যাহার - সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আন্দোলনের
অন্যতম শর্ত হয় উচিৎ।
তাই আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি দেশের সামনে এই যে চ্যালেঞ্জ
ছুড়েছে মৌলবাদীরা, তাকে হালকা
চোখে না দেখতে, কেউ যাতে ধর্মকে তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে সমাজে ধর্মীয়
বিষবাষ্প ছড়াতে না পারে তার জন্য প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ
করতে, আর ভবিষ্যতে
যাতে মৌলবাদের কালোহাত বাংলাদেশের গলা টিপে ধরতে না পারে, তার জন্য
শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজাতে আর সংবিধানে প্রদত্ত ধর্মনিরপেক্ষতা অন্ততঃ রাষ্ট্রীয়ভাবে
বাস্তবায়িত করতে। যতদিন পর্যন্ত
দেশের কোনো গোষ্ঠির প্রতি অবিচারের, কোনো গোষ্ঠির অধিকারের প্রতি ন্যুনতম অসমতা
থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সম্ভাবনা থাকবে কোনো না কোনো গোষ্ঠির এই সুযোগ ব্যবহার করার,
দেশের অগ্রগতি রোধ করার| বাংলাদেশের মানুষ একাধিক বার প্রমান করেছে, যে কোন ন্যায়
যুদ্ধে, অধিকার আদায়ের যুদ্ধে তারা পিছ পা নন| এখন দরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের
দলগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা| দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পথ দেখতে ও দেখাতে পারলে জয়
আমাদের হবেই|
দুবনা, ২৩ - ২৫ আগস্ট ২০১৬
Comments
Post a Comment