একুশের আহ্বান

অনেক আগে, যখন খুব খ-উ-ব ছোট ছিলাম, যখন নিজে ঠিক পড়তে পারতাম না, মা শোনাতো শাস্ত্রের গল্প, লক্ষীর পাঁচালী আর রূপকথা পরে নিজের বই পড়া শুরু হয় ছোটদের রামায়ন আর মহাভারত দিয়ে এরপর আসে রুশদেশের উপকথা, স্তিভেনশন, ডিকেন্স, টোয়েন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, চেখভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আরও কত নাম তখন লেখক মানেই ছিল অতীত, ধরাছোঁয়ার বাইরের কেউ, স্বর্গলোকের অধিবাসী এমন কি যেসব লেখক জীবিত ছিলেন, তারাও যেন ছিলেন ভিন জগতের মানুষ
ঠিক মনে নেই কবে, তবে স্কুলের মাঝদিকে পড়ি দ্বিজেন শর্মার ডারউইনের উপর বইটা এরও অনেক পরে, মস্কো আসার আগ দিয়ে হাতে পাই আবু জাফর শামসুদ্দিনের একটা বই, যেখানে উনি মস্কোয় দ্বিজেন শর্মার সাথে আড্ডার কথা উল্লেখ করেছেন সে কি উত্তেজনা মাত্র কয়েক দিন পর মস্কো যাবো, একজন সত্যিকারের লেখকের সাথে দেখা হবে

মস্কো আসি ১৯৮৩ তে দ্বিজেন কাকুর (তখন সবার দেখাদেখি দাদা বলতাম, সমাজতন্ত্রের সৈনিক ছিলাম, সবাই ছিল কমরেড, কেউ ভাই, কেউ-বা দাদা) সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলেও কথা হয় অনেক পরে আর ঘনিষ্টতা হয় সোভিয়েত দেশ ভেঙ্গে যাবার পরে ১৯৯২ এ তখন আমরা একসাথে মস্কোর বাংলাদেশ দুতাবাসের স্কুলে কাজ করতাম, সময় পেলেই চলে যেতাম তাদের বাসায় তারপরেও লেখরা যে অন্য জগতের মানুষ এই ধারনা আমার একেবারে উধাও হয়ে যায়নি
যদিও আমাদের ছাত্র জীবনে আলোময় বিশ্বাস, মেহেদী ইকবাল লিখতেন, প্রায়ই পড়ে শুনাতেন তাদের লেখা – তাদের ঠিক লেখক বা কবি মনে হত না বলে না গাঁয়ের বামুন ভিক্ষে পায় না

একের পর এক অনেকেই দেশে ফিরতে শুরু করলো আলোময় বিশ্বাস, মেহেদী ইকবালসহ অনেকের বই এল বাজারে এরপর জাহীদ রেজা নুর, মশিউল আলম – যারা মস্কো বা রাশিয়ায় এসেছে আমার চেয়েও বেশ কয়েক বছর পরে এর পরে জানলাম আমাদের স্কুলের আবুল হাসান বই প্রকাশ করেছেন আর সবশেষে জগত জ্যোতি বসাক, যে আমার হাত ধরে খেলাঘরে এসেছে হঠাৎ যেন লেখক সমাজ তাদের স্বর্গধাম ছেড়ে মর্ত্যে চলে এলেন দেখালাম – এরাও তো আমার মতই রক্ত মাংসের মানুষ

এখন ফেব্রুয়ারী, ভাষার মাস, গর্বের মাস, গৌরবের মাস, বইয়ের মাস এক মাস জুড়ে বই, লেখক আর পাঠকদের কোলাহলে ভরে উঠে বইমেলা পাঠকেরা পায় নতুন বই, লেখকেরা নতুন করে লেখার উদ্দীপনা প্রতি বছর কত যে পরিচিত মানুষ নতুন নতুন বই নিয়ে আসে বই মেলায়! আমরা যেমন ঈদ, পুজা বা নববর্ষের  জন্য সারাটা বছর অপেক্ষা করি, ঠিক তেমনি অপেক্ষা করি বইমেলার জন্য

আজ বাংলাদেশ, বাঙ্গালী জাতি তাদের সামাজিক জীবনে, শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় আরও বেশি করে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির দিকে তাকাচ্ছে। বিয়ে, গায়ে হলুদ,  নববর্ষ, বৈশাখী মেলা, বইমেলা এ সবই তার প্রমান। অন্যদিকে জীবনের অনেক ক্ষেত্রে বাড়ছে আরব সংস্কৃতির প্রভাব। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে রাজনীতিতে ধর্ম কোণঠাসা করছে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদকে। সমাজতন্ত্রকে অনেক আগেই কবর দেয়া হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বন্দী হয়েছে ধর্মের শেকলে। গনতন্ত্রের অবস্থাও টালমাটাল, অনেকটা অটোপাইলটে চলছে, যেমন চলে জ্ঞানশুন্য মাতালেরা। বেড়ে চলছে অন্য মতের প্রতি, অন্য পথের প্রতি অসহিষ্ণুতা। এমন কি বইমেলায়ও আসছে সেন্সরশিপ। ভাষার নয়, ধর্মীয় অনুভুতির কথা বলে বন্ধ করা হচ্ছে বইএর স্টল আর বই। আর এসব থেকে কত যে প্রশ্ন জাগে মনে

মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার
সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিস না আর খবরদার

  তাহলে কি আমরা লিখি অন্যের লেখা না পড়তে, অন্যের কথা না শুনতে? আজ আমরা সবাই লেখক, সবাই বক্তা –  শ্রোতাহীন, পাঠকবিহীন এই সভায়। সহিষ্ণুতার এই মরুভুমিতে বইমেলা এক মরুদ্যান, যেখানে লেখক, পাঠক সবাই আসে নতুন জ্ঞানের খোঁজে, নতুনকে জানার অন্বেষায়। তাই আজ লেখককে, পাঠককে  আর সর্বোপরি বইকে সেন্সরশিপ মুক্ত রাখা একুশের আহ্বান।

মস্কো, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ 


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি