একুশের উত্তরাধিকার
একুশে ফেব্রুয়ারী। ছোট বেলায় আমরা একে বলতাম শোক দিবস। ঐ দিন আমরা প্রভাতফেরী করে রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ অন্যান্য ভাষা শহীদদের স্মরন করতাম। তারপর এক সময় শোক দিবস শহীদ দিবস বলে আখ্যায়িত হলো। আর বিগত কয়েক বছর আমরা একে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেই চিনি। শেষের নাম থেকেই বোঝা যায় এ দিনটি বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়।
কিন্তু কি এই একুশ বাঙ্গালীর জীবনে? যদিও ধীরেন্দ্রানাথ দত্তের বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রথম বহিঃপ্রকাশ, আর জিন্নাহর “উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”র বিরুদ্ধে ছাত্রদের শ্লোগান ভাষার দাবীতে প্রথম প্রতিবাদ, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরটা কিন্তু আলোর মুখ দেখেছিলো বাহান্নর এই একুশে ফেব্রুয়ারীতেই। ভাইকে হারিয়ে ক্রন্দনরত বাঙ্গালীর শোক পরিনত হয় ক্রোধে। সেই ক্রোধের আগুনে একে একে পুড়ে যায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিতগুলো। ৫৪, ৬২, ৬৯ এ বার বার গর্জে উঠে বাঙ্গালী। আর ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের মত এক চরম মুল্যে দিয়ে বাঙ্গালী পায় স্বাধীন দেশ – সোনার বাংলাদেশ। তবে এই সবকিছুর মধ্যেও একুশ এক কেন্দ্রীয় ভুমিকা পালন করেছে, করছে। আর তাই হয়তো কাকতালীয় হলেও একুশের ঠিক পাঁচ দিন পরে, মানে ছাব্বিশে জাতি নেমেছে স্বাধীনতা সংগ্রামে আর একুশের ঠিক পাঁচ দিন আগে, মানে ষোল তারিখে সে ছিনিয়ে এনেছে বিজয় সূর্য।
বিভিন্ন সময়ে এ দেশের সামন্ত রাজারা দিল্লীর শাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ালেও সেটা কখনই বাঙ্গালী জাতীয়তার লড়াই ছিল না। খুব সম্ভব ব্রিটিশ আমলের আগে এই দেশ কখনই যারা নিজেদের বাঙ্গালী ভাবেন আর বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তাদের দ্বারা শাসিত হয়নি। হয়তোবা রাজা রামমোহন রায়, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অসংখ্য মনিষী যারা বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে আমুল পরিবর্তন আনেন, বাংলা সাহিত্য, শিল্প আর সংস্কৃতিকে নতুন মাত্রা দেন, তারাই জন্ম দেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের, যদিও সেটা ছিল ভারতের মধ্যে থেকেই বাংলার স্বতন্ত্র অবস্থান। এমন কি পাকিস্তানের সৃষ্টিও হয় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করেই, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, ধর্মকে সামনে এনে। এখানে মনে রাখতে হবে যে যখন ভারত বিভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে তখন বাংলার রাজনৈতিক দলগুলো ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন বাংলার সম্ভাবনা নিয়ে আলচনা শুরু করে। তাই পাকিস্তানের জন্মের ঠিক পর পরই যখন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন এলো আর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোল, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে বাঙ্গালী একসাথে এর প্রতিবাদ করলো। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভাষাটা জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে আর ধর্ম আনে বিভাজন। আর তাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, এমনকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি – এ দুটো কখনই এক পথের পথিক হতে পারে না, আমাদের মতো দেশে, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের লোক বসবাস করে, এই দুই ধারা পরস্পর বিরোধী দুই শিবিরে অবস্থান করতে বাধ্য।
বাহান্ন থেকে শুরু করে একের পর এক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আরও বলিষ্ঠ হতে থাকে আর এই সুস্থ জাতীয়তাবাদ দ্বিজাতি তত্ত্বকে ত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুকে টেনে নেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও সে দেশের গনমানুষের সার্বিক সমর্থন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনকে আরও প্রকট করে তোলে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের লড়াইটা ছিল সমান অধিকারের জন্য লড়াই, দেশের সম্পদে সমান ভাগ পাবার জন্য সংগ্রাম। সত্যি বলতে কি, ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা এই সমান অধিকারটুকুই চেয়েছিলাম, উর্দুর সাথে সাথে বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হোক সেটাই ছিল আমাদের দাবী। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত সাহায্য তো ছিলই। তাই সমাজতন্ত্রের কথা যে আসবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। আর গনতন্ত্র? আধুনিক বিশ্বে গনতন্ত্র ছাড়া কোন রাষ্ট্র হয় নাকি?
দেশ স্বাধীন হোল। গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ – এই চার স্তম্ভের উপর দাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়ালো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙ্গালী জাতি এই প্রথম বারের মতো পেল একটা দেশ, যে দেশের ভাগ্যবিধায়ক শুধুই তারা। তাদের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের নেতৃত্ব দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু শুধু সপরিবারে নিহতই হলেন না, দেশের চলার পথটাকেই একেবারে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হোল।
বাহান্নর পর কেটে গেছে ৬৫ বছর, স্বাধীনতার পর ৪৬, কিন্তু মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জনের আন্দোলন আগের মতই যথার্থ। সত্যি বলতে কি মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন নতুন কিছু নয়। যে ধারনাগুলো মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তার অন্যতম হচ্ছে অভিন্ন ভাষা, অভিন্ন ধর্ম, অভিন্ন ভূখণ্ড বা অভিন্ন শত্রু। তাই যখনই কোন জনগোষ্ঠী অন্য এক জনগোষ্ঠীর উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে, সে প্রথমেই চেষ্টা করেছে অধীনদের মুখের ভাষা কেঁড়ে নিতে, তাদেরকে পদে পদে মাতৃভাষায় কথা বলার, কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে। আর মানুষ বারবার তার প্রতিবাদ করেছে, রক্ত দিয়ে রক্ষা করেছে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। এ নিয়ে মানুষ প্রান দিয়েছে ভারতে, প্রান দিয়েছে ঢাকার রাজপথে। ভাষা আন্দোলন শ্রীলংকায় রূপ নিয়েছে দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধের। আজও প্রি-বালটিকের দেশগুলোতে রাশিয়ান ভাষাভাষীরা মাতৃভাষায় পড়াশুনা বা কাজ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। ইউক্রাইনে প্রায় ৫০% মানুষের মাতৃভাষা রুশ হবার পরেও সে ভাষা দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। সাম্প্রতিক কালে বরং বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর এর ফলে জ্বলছে দনবাছ। তাই একুশের মাতৃভাষা দিবস শুধু আমাদের একার নয়, এটা সারা বিশ্বের মানুষের মাতৃভাষা দিবস। এই দিবসটাকে আন্তর্জাতিক করার জন্য আমাদের সরকারের প্রয়াস বিশেষ প্রশংসার যোগ্য।
দুঃখজনক হলেও সত্য দিনকে দিন আমরা বাহান্নর প্রতিশ্রুতি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। গনতন্ত্র পরিনত হয়েছে ভোটের প্রহসনে, সমাজতন্ত্র মরে ভুত হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সাথে, আর ধর্মীয় অনুভূতির প্রবল বন্যা ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সুদুর বঙ্গোপসাগরে।
আজ একদিকে সামাজিক আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাড়ছে বেশি করে বাঙ্গালী হবার প্রবনতা আবার একই সাথে বাড়ছে ধার্মিক হবার প্রতিযোগিতা। ভোগবিলাসী এই সমাজে খুব অল্পমুল্যেই বিক্রী হয়ে যাচ্ছে স্বাধীন দেশের স্তম্ভগুলো। আর এসব দেখে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে
শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রী করে যদি মানুষ থাকা না যায় তাহলে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আতাত করে কি স্বাধীনতার পক্ষে থাকা যায় বা ভোটের জন্য সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ করে কি একুশের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়?
যে ভাষার জন্য বাহান্নতে রফিক, শফিক, বরকত, জব্বাররা প্রান দিয়েছিল, যে ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, যে ভাষা একদিন দেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই ভাষার মহারথীরা আজ স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাচ্ছেন না। তাদের জায়গা দখল করছে ধর্মীয় বিভাজন। জাতীয়তাবাদ হেরে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার কাছে। একদিন শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে সম্প্রদায়িক পাকিস্তানের জন্যও লড়েছেন, পচাত্তর বছর পরে এসে আজ তার কন্যা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মদিনা সনদের পক্ষে লড়ছেন। শেখ মুজিব খুব শীঘ্রই তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন আর সময় পেয়েছিলেন এদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে মুক্ত করতে, কিন্তু শেখ হাসিনা সেই সময় কি পাবেন?
মস্কো, ১২ - ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
Comments
Post a Comment