নববর্ষের কথা

বছর ঘুরে আবার নতুন বছর দুয়ারে দাঁড়ায়ে, অপেক্ষায় কখন আমরা তাকে ঘরে তুলে নেব ধানদূর্বা দিয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে, শঙ্খ্যঘণ্টা বাজিয়ে আমার ছোট বেলায় এটা ছিল আর দশটা দিনের মতই সকাল থেকে খদ্দেররা আসতে শুরু করতো, বকেয়া টাকা শোধ করতো, দই-মুড়কী খেয়ে বাড়ি ফিরতো মনে পরে আগের দিন থেকেই গুদাম ঘর সাজাতাম, কাগজ কেটে সাজানোর দ্বায়িত্বটা আমিই নিতাম এটা ছিল আনন্দ উৎসব ঘুম থেকে উঠে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানানো, কোলাকুলি করা, ঠিক যেমনটা হয় বিজয়া দশমীতে আর ঈদে তাই এখন যখন শুনি এই নববর্ষ পালন নিয়ে হাজারো কথাবার্তা, অবাকই লাগে

যদিও নববর্ষ তখন পালিত হতো মূলত হিন্দু পাড়ায়, এটা কখনও হিন্দু উৎসব বলে মনে হয় নি গুদাম ঘরে ঐ দিন গণেশের পুজা হতো, আর এক মাত্র এ পুজাতেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই পুজার ঘরে ঢুকতো ব্যাবসায়ীদের কাছে খদ্দের হল লক্ষ্মী, আর লক্ষীর তো কোন জাত নেই আমরাতো বটেই বাড়ির কাজের লোকেরাও পেতো নতুন জামাকাপড়, মানে লুঙ্গীগামছা মনে পড়ে বিশাল এক পিতলের থালায় খুব সাবধানে পাকিস্তানী এক টাকার একটা মুদ্রা ফেলতাম, যাতে শব্দে গণেশ বিরূপ না হয় আর যেহেতু আমাদের খদ্দেরদের বেশীর ভাগই ছিল মুসলমান, তাই নববর্ষকে (হালখাতা বলতাম তখন) হিন্দু পার্বণ ভাবার কোন অবকাশ ছিল না
যাই হোক, নববর্ষ নিয়ে বিভিন্ন কথা শুনে আবার বসলাম এর উৎসের খোঁজে বাংলা নববর্ষ যা আমরা পালন করি – এটা সম্রাট আকবরের অবদান ঐ সময়ে ভারতে অনেকগুলো সৌর পঞ্জিকা থাকার পরেও আকবর এই পঞ্জিকা তৈরি করার নির্দেশ দেন অমর্ত্য সেন এটাকে আকবরের বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহ থেকে করার কথা বললেও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এর পেছনে ধর্মের চেয়েও প্রাগমাটিজম ছিল বেশি ইসলামী হিজরি পঞ্জিকা ব্যবহার করে খাজনা আদায়ে সমস্যা হতো, তাই তিনি সৌর পঞ্জিকা তৈরি করতে বলেন আর এ জন্যে তিনি দুটো ঘটনা জুড়ে দেন বাংলা আর হিজরি দুটো পঞ্জিকারই শুরু হয় নবীর মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার দিন থেকে, দুটো পঞ্জিকাই হাতে হাত মিলিয়ে চলে ৯৬৩ হিজরি সাল (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত যে বছর আকবর সিংহাসনে আরোহন করেন এর পর থেকে দু’জনের পথ দু’দিকে বেঁকে যায়, হিজরি সন চলে চাঁদের সাথে, বাংলা সূর্যের পিছু নেয় যদিও আকবর তার দখলকৃত ভারতের সর্বত্রই এই পঞ্জিকা চালু করেন, তার মৃত্যুর পর শুধু মাত্র বাংলায় এই পঞ্জিকা টিকে থাকে এমনকি বাঙ্গালী হিন্দুর পুজা-পার্বণ এই পঞ্জিকার ভিত্তিতেই হয়, যদিও এ ক্ষেত্রে সূর্য-চন্দ্র দু’টোর অবস্থান মিলিয়েই হিন্দু পূজাপার্বণ বা বিয়ের লগ্ন ঠিক করা হয় তাই যারা বাংলা পঞ্জিকাকে হিন্দু পঞ্জিকা বলে রাতের ঘুম নষ্ট করেন, একটু ইতিহাস ঘেটে দেখুন

তবে আমার আগ্রহ অন্য কারনে পৃথিবীর অধিকাংশ পঞ্জিকাই সৌর পঞ্জিকা এমন কি প্রাচীন মিসরেও সৌর পঞ্জিকা চালু ছিল ভারত বর্ষেও আর্যভট্ট বলেন তিনি কলিযুগের ৩৬৩০ সনে জন্ম নেন যা ছিল ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ মায়া সভ্যতায়ও সৌর পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয় তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেন অন্যেরা চাঁদের পঞ্জিকা ব্যবহার করে নি উত্তরটা মনে হয় আরব দেশের প্রকৃতির সাথে জড়িত সৌর পঞ্জিকা সরাসরি জড়িত ফসলের সাথে, যেখানেই কৃষি কাজ হতো, সেখানেই ইচ্ছা অনিচ্ছায় মানুষকে ঋতুর কথা ভাবতে হতো, আর ঋতু সূর্যের অবস্থানের সাথে জড়িত অন্য দিকে আরব দেশে কৃষি কাজ হতো বলে জানা যায় না ঐ সময়ে তাদের চলাচলও ছিল রাতের বেলায়, যখন মরুভূমি শীতল হয়, চলার উপযোগী হয় তাই তাদের চলতে হতো চাঁদের উপর নির্ভর করে আমাদের যেমন সূর্য, তাদের তেমনি চাঁদ আর তাই তো আরব সভ্যতায় চাঁদের এত কদর এই চাঁদ, এই সূর্য এগুলো ধর্মের সাথে যতটা না জড়িত, তার চেয়ে বেশি প্রকৃতির সাথে, আর এই প্রকৃতির সাথে জড়িত বিভিন্ন অঞ্চলের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি তাই অন্ধভাবে কোন কিছুর অনুকরন না করে বা কোন কিছুর বিরোধিতা না করে আমরা যদি গভীর ভাবে প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির সংযোগ খুঁজার চেষ্টা করি, দেখবেন জীবনটা কত সহজ হয়ে গেছে
শুভ নববর্ষ     



পুনশ্চঃ সকালে দিদিকে কল দিলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাবো বলে। দিদি বললও,”ভাই, আজ চৈত্র সংক্রান্তি। আমাদের নববর্ষ তো আগামী কাল।” ওদিকে ফেসবুকে চঞ্চল লিখেছে, “নববর্ষ আজ না কাল?” এ এক মহা যন্ত্রণা। ভাষার জন্য প্রান দিলাম, অথচ আমরা ফাল্গুন নয়, ফেব্রুয়ারী পালন করি। আমাদের স্বাধীনতা দিবস মার্চে, চৈত্রে নয়। বিজয় আমরা পেয়েছি ডিসেম্বরে, অগ্রহায়ন আর পৌষের মিলনের দিনগুলোতে নয়। বাংলাদেশের সরকারী কাজকর্ম হয় খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা ধরে। দেশের ৯২% মানুষ তাদের ধর্মকর্ম করে হিজরি পঞ্জিকা মেনে। বাকী যারা রইল, মানে হিন্দু আর বৌদ্ধরা তাদের অনুষ্ঠান করে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী যেখানে ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের দিনক্ষন ঠিক হয় চন্দ্র–সূর্যের অবস্থানের উপর। তাই বাংলা নববর্ষ কখনও হয় ১৪ এপ্রিল, কখনও ১৫। তাই ১৪ এপ্রিলের গায়ে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনের মানে পয়লা বৈশাখের পেরেক মেরে দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটা সন্দেহের বিষয়।  


দুবনা, ১৪ এপিল ২০১৭        


            

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা