কানা

অনেক দিন আগের কথা, তা সে ছোট বেলার আগের বছর তো হবেই, যখন মা, মেঝমারা দিন শেষে বড়দার বিল্ডিংএর দক্ষিনের বারান্দায় বসে চুল বাঁধতো আর গান গাইতো। মা শোনাত রামায়ন, মহাভারত আর লক্ষ্মীর পাচালী, আবার কখনো নিয়ে বসতো ঠাকুরমার ঝুলি! ঐ সময়ই মা মাঝে মধ্যে এ গল্পটাও করতো

শীতের শুরু। জমিতে রবি শস্য লাগানোর ধুম পড়ে গ্যাছে। বাড়িতে বাড়িতে কামলার ছড়াছড়ি। কামলা মানে দিনমজুর, যারা বছরের এই সময় জমিতে কাজ করে, বিনিময়ে পায় মজুরী। বিধু বাবুর বাড়িতে এবার অনেক কাজ, অনেক কামলা। দিন শেষে ওরা কাজ থেকে বাড়ি ফেরে, আর বিধু বাবু কাজের হিসেব নেয় বসে বসে।
- তা তোমরা সারাদিন করলেটা কি? এভাবে কাজ করলে অনেক জমিই তো পতিত থেকে যাবে?   
- আর বইলেন না বাবু, আমরা তো তাড়াতাড়িই করতে চাই। যত দোষ ঐ   কানার। ওর জন্যে কাজে ঢিলা পরে।

এবার কামলাদের মধ্যে এক কানা ছিলো। সবাই ওকে দোষ দেয় সব কাজে। বিধু বাবু কিছু বলে না, চুপ করে শুনে যায়। এক দিন বিধু বাবু ঠিক করল জমিতে যাবে নিজেই, দেখবে কে কেমন কাজ করছে। দূর থেকে দেখে সবাই বসে বসে হুক্কা খাচ্ছে, আর কানা একা একা কাজ করে যাচ্ছে। তবে বাবুকে আসতে দেখে কামলারা উঠে দাঁড়ায়, হাত লাগায় কাজে।

-   ঐ মাহাম, এই জায়গাটা আগাছা ভর্তি, এখানে কে কাজ করেছে?
-   বাবু ওটা কানার কাজ।
-   এখানে বেগুন গাছটা হেলে পড়েছে। এটা কে করল?
-   বাবু, ওটাও কানার কাজ।

এভাবে বিধু বাবু যেটাই জিজ্ঞেস, উত্তর আসে ওটা কানার কাজ। কিছু না বলে বিধু বাবু বাড়ি ফিরে আসে। সন্ধ্যায় সবাই বাড়ি ফিরলে বিধু বাবু সবাইকে টাকা দেয় আর বলে কাল থেকে আর কাজে আসার দরকার নেই। কাল থেকে শুধু কানাই কাজ করবে আমার জমিতে। সব কাজই যদি কানাই করে, তাহলে তোমাদের রেখে আর লাভ কি?

তখন গল্পটা শুনে হাসতাম, এখন বুঝি এটা আমাদেরই গল্প। আমরা সব সময়ই আমাদের ব্যর্থতার বোঝা কানার ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। এটাই মনে হয় আমাদের জাতীয় চরিত্র। অন্তত দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে সেটাই মনে হয়। কী সরকারীদল, কী বিরোধীদল – সবাই একে অন্যকে দোষ দিয়ে যায়। কাজ করলেও দোষ না করলেও দোষ – সেই ব্রাহ্মণের আগে বা পিছে হাঁটার মত। আর বিরোধিতা করতে করতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে অনেক সময় সেটা স্ববিরোধীতা হয়ে যায়। তখন মনে পরে ছাত্র জীবনের কথা। আমাদের গনমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছেলে ছিল, সব দিকেই ভালো, তবে সব কিছুরই বিরোধিতা করতে হবে – যেন এটাই জীবনের লক্ষ্য। ছাত্র সংগঠনের এমন কোন সভা নেই যেখানে সে বিপক্ষে ভোট দেয় নাই বা নিরপেক্ষ থাকে নাই। ১৯৮৭ সালে বন্যার পরে যখন দেশে ত্রান পাঠানোর প্রস্তাব আনা হল, সে সেখানেও ভোট দানে বিরত থাকলো। না, ব্যাপারটা এই নয় যে সে চাঁদা দেয় নি, তবে ঐ যে, নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে – তাই চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও বিরুদ্ধে বলতেই হবে। আমার মনে হয় দেশে রাজনীতিবিদদের একই রোগে পেয়েছে। তাই সরকার যাই করুক না কেন, তার বিরোধিতা করতেই হবে। আর এতে করে এদের কার্যকলাপ স্ববিরোধী তো হয়ই, অনেক সময় দেশের স্বার্থ বিরোধী হয়। মনে হয় এদের শ্লোগান লেনিনের সেই বিখ্যাত উক্তি “যত খারাপ তত ভালো” বা “The worse the better” আর এটা যে  কয়েক দিন আগে সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহত র‍্যাবের এক শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাকে নিয়ে কিছু কিছু রাজনীতিবিদের মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে তাই নয়, বলতে গেলে সামরিক জান্তার পর দেশে গনতন্ত্রের বা ভোটের রাজনীতি চালু হবার পর থেকে হরহামেশা এমনটাই ঘটছে। দেখবেন, দেশে যে কাজই হোক না কেন, সবই যদি খারাপ হয়, আর সবই যদি কানায় করে, তবে জনগন রাজনীতি থেকে আপনাদের যেন চিরতরে অব্যাহতি না দেয় সেই দিন এনে দিন খাওয়া কামলাদের মত।    


দুবনা, ০৫ এপ্রিল ২০১৭         



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা