পি এফ ইউ এর একদিন
সকালে উঠে তৈরি হলাম ভার্সিটি যাবার
জন্য। প্রেসারটা মেপে দেখি সব ঠিক আছে। ৯ টায় ক্লাস। বসে আছি ছাত্রদের অপেক্ষায়।
ক্লাস নেই ডিপার্টমেন্টেই, তাই প্রয়োজনে চা  খাওয়া যায়। বসে আছি আর বসে বসে নেট করছি।
ছাত্রদের টিকির দেখা নেই। এটা অবশ্য অপসনাল ক্লাস -  পাঁচ জনের আসার কথা। গত তিন ক্লাসে ঘুরে ফিরে
দুজন দুজন করে চারজন মাত্র এসেছে। আজ সেটাও নেই। অবশ্য ওদের যে দোষ তাও নয়। সোমবার
ওদের ক্লাস শুরু ৯.৫৫ থেকে। আমার যাতে দুবনা থেকে আরও একদিন আসতে না হয়, তাই কথা হয়েছে
ওরা ৯ টায় আসবে, আমি ১০.১০ পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে ওদের ছেড়ে দেব।  যাই হোক – কোন একটা কারণে কারো দেখা নেই। যতদুর
মনে হয় ওরা ডিপ্লোমার জন্য শিক্ষক খুঁজতে ব্যস্ত। ঘড়িতে যখন ১০ টা বাজল, ভাবলাম
কেউ আর আসবে না।  চায়ের জল বসিয়ে  ফোন করলাম ইউরি পেত্রোভিচকে। এমন সময় এক ছেলে
এসে হাজির।
-      কাকে চাই?
-      আমাদের ক্লাস ছিল ১০৭ নম্বর রুমে, ওখানে কাউকে দেখলাম না।  তাই অন্যদের খোঁজে এলাম।
-      ক্লাস করতে চাও? 
-      হ্যা। 
-      এস তাহলে। কোন গ্রুপ তোমার?
-      এন এফ ৪০১।
-      ওকে। গত তিন লেকচারে আমরা লরেন্স ট্রান্সফরমেশন, টেনসর এসব
নিয়ে বলেছি। আজ বলব ইউক্লিড আর রিমান জিওমেট্রির উপর। যেহেতু তুমি প্রথম বারের মত
কিছু কিছু রিপিট করব। 
-      ঠিক আছে।
একটা পার্ট শেষ করে জিজ্ঞেস করলাম 
-      কটা বাজে এখন?
-      পৌনে এগারোটা।
-      হুম। আমার নেক্সট ক্লাস 
শুরু ১০.৫০ এ। আজ তাহলে ছুটি। তা তুমি এতো দিন ক্লাসে আসনি কেন?
-      একটু প্রব্লেম ছিল তাই।
-      দেখ ছোট প্রব্লেমটা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বড় না হয়ে যায়। কি
নিয়ে পড়ার ইচ্ছে?
-      জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে।
-      ঠিক আছে। আমি ১ টার দিকে এখানে থাকবো, অথবা নেক্সট সোমবার
এসো কথা হবে।
-      দুবনা থেকে এক ভদ্রলোকের আসার কথা ছিল আমাদের ক্লাস নিতে। আমি
ভেবেছিলাম ওনার সাথে কথা বলবো এ ব্যাপারে। 
-      আমিই দুবনা থেকে এসেছি। 
-      খুব দুঃখিত।  জানতাম
না।
-      ঠিক আছে। এখন তো জানলে। 
ও চলে গেলো। আমি গেলাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স
পড়াতে। যেতে যেতে ভাবলাম সলিডিটির অভাব আছে আমার। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি চর্বি
নেই, মাংস নেই – ১০০% সলিড বডি। তবে ওদের মনে হয় এরকম সলিডিটি দরকার নেই। কয়েকদিন
আগে আমার কোল্যাবোরাটর ভিক্তরের সাথে কথা বলছিলাম। বললাম 
-      কেউ কোন প্রশ্ন করে না।               
-      ছাত্ররা কখনই খুব একটা প্রশ্ন করে না।
-      আমার মনে হয় কি, ওরা কিছু জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ বোধ করে।
-      কেন?
-      আমি ওদের বলেছি আমাকে বিজন বা সাহা বলে ডাকতে। ওরা তো টিচারদের
নাম আর বাবার নামে ডেকে অভ্যস্ত।
-      হতে পারে। তা বললেই তো পার তোমাকে ডক্টর সাহা বা প্রোফেসর
সাহা বলে ডাকতে?
-      মাথা খারাপ। 
-      তা ছাত্রদের এখন কি পড়াও?
-      মাক্সওয়েল সমীকরন। তবে ওরা ভেক্টর আনাল্যসিস ভালো জানে না,
ওটাও দেখাচ্ছি। এই যেমন অপারেটর নাবলা। লেভি-সিভিতা টেনসর ব্যবহার করে কিভাবে
সহজেই ভেক্টর গুন করা যায় এসব।
-      লেভি-সিভিতা মানে? তোমার দেখছি মাথা খারাপ। এসব বোঝার সময়
ওদের এখনও আসেনি। এজন্যেই সেভা তোমার কাছে পড়তে চায় না। 
ক্লাসে আসতে একটু দেরি হল। ছাত্ররা
বেশ খুশি। আজ পড়ালাম ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিকস। বুঝেছ কিনা জিজ্ঞেস করলে ঘাড় নাড়ায়, আর
এমনভাবে নাড়ায় যে সেটা হ্যাঁ কি না, সেটাই বোঝা কষ্ট। 
যাহোক ক্লাস শেষে ফিরে এলাম
ডিপার্টমেন্টে, চা খেয়ে বাসায় ফিরবো, হঠাৎ  মনে পড়লো এখানে তো ডাক্তার বসে, দেখিয়েই যাই প্রেসারটা।
-      কি সমস্যা?
-      গতকাল থেকে প্রেসারটা হাই হয়ে আছে। যদি একটু দেখতেন।
প্রেসার মেপে বললেন 
-      ১২০/৮০।  দাঁড়ান,
আরেকবার দেখি।
সেকেন্ড টাইম একই রেজাল্ট। বললাম 
-      আমার স্পন্দেলাইসিস আছে ঘাড়ে, ওখান থেকেই কি না কে জানে।
-      হতে পারে। আমি আপনাকে ঘাড়ের দুটো ব্যয়াম দেখাচ্ছি। প্রতিদিন
করবেন। ঠিক হয়ে যাবে। আর এই যে মলম এটাও ইউজ করবেন। 
বলেই একটা মলম হাতে নিয়ে আমার ঘাড়ে
মেখে দিলেন।             
-      আসলে আমাদের দেশটা ঠাণ্ডা কি না? ভার্সিটি শেষ করে দেশে
গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-      আমি ভার্সিটি শেষ করেছি অনেক আগেই।
-      তাই? দেখে তো মনে হয় কুড়ি বছর বয়েস।
-      এখন তিপান্ন ছুই ছুই। আমি এখানে পড়েছি আশির দশকে, সোভিয়েত
আমলে। 
-      হ্যা, তখন এই রুমে ওষুধের দোকান ছিল, পলিক্লিনিক ছিল এখানে।
পরে তা মিকলুখো মাকালায়া চলে যায়। 
-      হ্যা মনে আছে সব।
-      এখন এখানে শিক্ষকতা করেন?
-      হ্যা, পার্ট টাইম। কাজ করি দুবনায়।
-      এদিকে এলে বেড়াতে আসবেন। প্রেসার মেপে দেবো। 
-      ঠিক আছে। উঠি। 
-      এখন আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দিচ্ছি। আসুন আনপাকেও দিয়ে
দেই।
-      ঠিক আছে। ভেবেছিলাম দুবনায় নেব। 
-      এক জায়গায় নিলেই হলো। তাছাড়া আপনাকে জার্নি করতে হয়। টিকা
নেয়া খুব দরকার।
ইঞ্জেকশন নিতে আমার বরাবরই ভয়। 
-      রিল্যাক্স।  ব্যস। হয়ে
গেছে।   
-      স্পাসিবা (ধন্যবাদ)।
-      নি বলেইচে। প্রিখাদিচে। (অসুস্থ হয়েন না। আসবেন।)
আমি আসলে খুব ভালো রুগী। সব ডাক্তারদের
কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার পাই।  এতো বছরের
সোভিয়েত আর রাশিয়ান জীবনে খুব কমই মানুষের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেয়েছি। ক’ দিন
আগে এক ভিপুস্কনিক লিখলো এ দেশে খারাপ ব্যবহারের কথা। দুই একজন এটাকে  সমর্থনও করল। আমার কেন যেন মনে হয় কোথাও ভালো বা
খারাপ ব্যবহার পাওয়া নিজের উপরেও অনেকটাই নির্ভর করে, যদি না চারপাশের লোকজন খুব
বেশি বাইয়াস হয়। 
মস্কো, ০২ অক্টোবর ২০১৭  

Comments
Post a Comment