জেলহত্যা ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা



মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার                                                                                 সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিস না আর খবর্দার।।
জানি এ লেখাটা পড়ে অনেকে এ ভাবেই বলবেন, তবুও কিছু প্রশ্ন আসে মাথায়, জানতে ইচ্ছে করে তার উত্তর যদিও ১৯৬৮ সাল থেকে প্রায় সব ঘটনাই কমবেশি আমার মনে আছে, সেগুলো, বিশেষ করে রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করার শক্তি তখন ছিল না (এখনো আছে কী?) একাত্তরের ঘটনাবলী বেশ মনে আছে, মনে আছে একাত্তর পরবর্তী দেশের কথাও বাহাত্তরে শেখ মুজিব দেশে ফিরলেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মানুষের সে কী উচ্ছ্বাস, সে কী আশা-আকাংক্ষা মুজিব দেশে এলে যেন মুহূর্তের মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটা প্রাণ ফিরে পাবে, এক সোনার কাঁঠির স্পর্শে বঙ্গবন্ধু উপশম করবেন দেশের মানুষের সব ব্যথা-বেদনা আওয়ামী লীগ শুধু নির্বাচনে নয়, যুদ্ধজয়ী দল দলে দলে মানুষ যোগ দিচ্ছে আওয়ামী লীগে, গড়ে উঠছে লাল বাহিনী, মুজিব বাহিনী আরও কত কী! তারপর এল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বাকশালের ঘোষণা দেশের ভিতরের পরিস্থতির দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগলো সাম্প্রদায়িক দলগুলো প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু না করলেও তাদের জায়গায় এল বিভিন্ন চীনপন্থী হঠকারী দল দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হল সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা যতদূর মনে পড়ে চারিদিকে এক থমথমে ভাব, যদিও মুজিবের প্রতি আস্থা হারায়নি মানুষ, অন্তত আমাদের এলাকার হিন্দুরা, যারা মাত্র কিছুদিন আগে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘরবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পালিয়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছে আর বিজয়ের পর শেখ মুজিবের ডাকে নতুন আশায় বুক বেঁধে নতুন জীবন গড়তে শুরু করেছে ঐ সময় বাড়িতে প্রায়ই শুনতাম, একাত্তরের এতো বড় ঝড়ের হাত থেকে বাঁচলাম, এবারও ঠিকই এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠবো তখন শেখ মুজিব দেশের অবিসংবাদী নেতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার শেখ মুজিব, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ – এগুলো যেন প্রতিশব্দ
বুদ্ধি হবার পর থেকেই শেখ মুজিবকে আমি দেখেছি এই ভুমিকায় – যিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য তাই অনেক পরে ২০১১ সালে যখন তার “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” পড়ি, ভারত বিভাগে তার ভূমিকা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো আর তখন মনে হয়েছিল আমি যেভাবে শেখ মুজিবকে দেখি, আমার আগের জেনারেশন, যারা প্রত্যক্ষ ভাবে দেশ ভাগের ফল ভোগ করেছেন (আমরা যে এখনো সেই ফল ভোগ করছি সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই) তারা কি ভাবতো এই মহান নেতা সম্পর্কে? কিন্তু তখন আর জিজ্ঞেস করা যায় সে রকম  কেউ ছিল না, ছিলেন শুধু দ্বিজেন কাকু, তাকেও জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি, আর হবেও না
যাহোক, ফিরে আসি আবার যুদ্ধ পরবর্তী সেই দিনগুলোতে এখনো মনে পড়ে কিভাবে রাতের পর রাত আমরা প্রতিবেশীদের বাড়িতে মেঝেতে ঘুমোতাম আর্থিকভাবে স্বচ্ছল আর এলাকায় সম্মানিত হবার সুবিধা অনেক, তবে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে যেহেতু প্রথম আঘাতগুলো (চুরি, ডাকাতি, খুন) তাদের উপর নেমে আসে, তাই তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য কারো ঘরে ঘুমানোর অসুবিধাটা সইতে হয় এতো কিছুর পরেও কিন্তু সেখ মুজিবের প্রতি আমাদের আস্থা কমেনি, আমরা বিশ্বাস হারাইনি তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে যখন বাজারে শুনলাম শেখ মুজিব স্বপরিবারে নিহত – বিশ্বাস হয়নি মোটেও দৌড়ে গেছি বাড়ি আর ভেবেছি বাড়িতে বিবিসি বা আকাশবাণী থেকে অন্য খবর পাবো বাড়ি ফিরে দেখি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে রেডিওর ওপর চেষ্টা করছে বিবিসি, ভয়েস অফ অ্যামেরিকা এসব শোনার জন্য, খবরটা যে ভুল সেই খবর পাওয়ার জন্য সে খবর আর পাওয়া হয়নি কোনদিনও
এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা এই বুঝি একাত্তরের মতই আওয়ামী লীগ ঝাপিয়ে পড়বে, দলের বিপথগামী নেতাদের দূর করে আবার দেশকে একাত্তরের চেতনার পথে ফিরিয়ে আনবে  কিন্তু সেটা হয়নি অনেক দিন পরে ১৯৯১ সালে প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নে একদা অসীম শক্তিশালী সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ইয়েলৎসিনের এক কলমের খোঁচায় নাই হয়ে গেল এতো এতো ডেডিকেটেড কর্মী থাকার পরও একজন নেতা পাওয়া গেল না যে কিনা দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করবে সারা দেশ, গোটা পার্টিটা নীরবে দাঁড়িয়ে পার্টি তথা দেশের বিলুপ্তি গ্রহণ করে নিল     
তখন বাড়িতে কেউই সক্রিয় রাজনীতি করতো না যদিও দেশ বিদেশের রাজনীতি সম্পর্কে খবরাখবর রাখত এছাড়া নির্মলদা, রতনকাকু এরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খবর নিয়ে আসতো বিকেলে সবাই যখন বাসায় ফিরত, আলাপ আলোচনা হতো কী ঘটতে পারে অদুর ভবিষ্যতে তবে যতদূর মনে পড়ে তখন কেউ কখনই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোন তৎপরতার কথা বলে নি বরং আওয়ামী লীগের কোন নেতা মোশতাকের মন্ত্রী সভায় যোগ দিল এটাই ছিল আলোচনার আর একই সাথে ঘৃণার বিষয় সবাই একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে চার নেতার কেউ যদি আজ জেলের বাইরে থাকতেন তাহলে ঘটনা এদিকে মোড় নিত না তারা নিশ্চয়ই একাত্তরের মতই আর একবার দেশকে শত্রুমুক্ত করতেন সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো চার নেতার খবর শোনার জন্য    
তারপর ৩রা নভেম্বর সেই ১৫ ই আগস্টের মতই সবাইকে হতবাক করে দিয়ে জেল হত্যা হলো, বঙ্গবন্ধুর মতই নির্মম ভাবে নিহত হলেন একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের স্থপতিরা ঘুরে গেল ইতিহাসের চাকা শুরু হোল উলটো রথ আইয়ুব ইয়াহিয়ার পরে শুরু হোল জিয়ার সামরিক শাসন এরপর দলীয় রাজনীতির সুযোগ এলে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরে এল - যতদূর মনে পড়ে মালেক গ্রুপ আর মিজান গ্রুপ এই দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের পুরানো নেতাদের অধিকাংশই মালেক গ্রুপে যোগ দিল এর অনেক পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালেক গ্রুপের নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নেন আর এক সময় মিজান গ্রুপের অস্তিত্ব বিলোপ পায়
আজ আমরা যখন আবার ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা দিবসের মুখোমুখি, প্রশ্ন জাগছে মনে – জেলহত্যা কি রোধ করা যেতো না? সেনা বাহিনীর একটা বিরাট অংশ যেখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল না, আওয়ামী লীগের সক্রিয় প্রতিবাদ কী আরও আগেই মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারত না? বাঁচাতে পারতো না তাদের চার জাতীয় নেতাদের? যে কারণেই হোক, তখন সেটা করা হয়নি বা করা যায়নি কিন্তু এ নিয়ে পার্টির ভেতরে কী কোন আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে? আওয়ামী লীগ কী দেশের সেই ক্রান্তিকালে তার ভূমিকা সম্পর্কে কোন অবজেক্টিভ পর্যালোচনা করেছে? দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একই সাথে চলছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নৈতিক অধঃপতন দেশের যেকোনো সংবাদপত্রের হেডলাইন দেখলেই সেটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর এসবের একটা বড় কারণ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতন্ত্রের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব শুধু নিজেদের সাফল্যের গীত গাওয়া আর ভুলত্রুটির পর্যালোচনা না করা, করলেও জুজুর ভয়ে সেটা প্রকাশ না করা রাজনীতির এই অস্বচ্ছতাই দেশের সব কিছুকে অস্বচ্ছ করে তুলছে এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে, স্বচ্ছ ও সুস্থ রাজনীতির ধারা চালু করতে হবে আজ জেলহত্যা দিবসের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ ঐ সময়ে তার কর্মকাণ্ডের সঠিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে সেই ধারা চালু করতে পারে, একই সাথে বাংলার এই চার কৃতি সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে  

দুবনা, ৩১ অক্টোবর ২০১৭   


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি