যুব উৎসব ২০১৭ ও আলোচনা সভা



গত শনিবার রাশিয়ার সোচিতে বিশ্বযুব উৎসবে আসা বাংলাদেশ ডেলিগেশনের অনেকের সাথে দেখা হল যতদূর শুনেছি মোট ৮৬ জন এসেছিলেন, এখানে উপস্থিত ছিলেন ৪০ জনের মত অনেকেই এর মধ্যে দেশে ফিরে গিয়েছেন, অনেকে অন্য শহরে বেড়াতে গিয়েছেন  সময়ের স্বল্পতার কারণে আবার অনেককে খবর দেয়া যায়নি সব মিলিয়ে যারা খবর পেয়েছেন, তারা প্রায় সকলেই এসেছেন
যুব উৎসবের ঢাকঢোল অনেক আগে থেকেই বাজতে শুরু করেছিল তবে বিভিন্ন কাজকর্মে খবরটা ঠিক রাখা হয়ে উঠেনি হতে পারে এর মধ্যে আমার এসব ব্যাপারে উৎসাহও কমে গেছে তবুও উৎসবের ঠিক আগে আগেই প্যারিস থেকে কিরণের আর ঢাকা থেকে জয়নালের ফোন পেয়ে বুঝলাম ব্যাপারটা একেবেরেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না সবার সাথে না পারলেও উদীচীর ডেলিগেশনের সাথে দেখা করতেই হবে ওদের বললাম, যারা আসছেন তাদেরকে আমার কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে দিস, ওনারা উইকএন্ডে মস্কো থাকলে দেখা করবো, না হলে ফোনে আলাপ করবো
এরপর এক সময় মস্কোর বন্ধুদের কাছ থেকে পেলাম ডেলিগেশনের মস্কো আসার খবর তবে খবরটা পেলাম তাদের মস্কোয় বরণ করার ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি হয়েছিল বলেই সব স্মুথলি হয়ে গেলে হয়তো জানতামও না একটু অবাক লাগলো এটা শুনে কেন না দেশ থেকে যারা যোগাযোগ করেছিল তারা এদের থাকার ব্যবস্থাদি করার জন্য কিছু বলেনি তাছাড়া যতদূর জানি, সোচি বাদেও রাশিয়ার অনেক শহরেই এই উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ থেকে ডেলিগেশন এসেছিল মস্কো, কাজানসহ বিভিন্ন শহরে কিছু প্রোগ্রাম হয়েছিল পরে এদের অনেকেই আবার মূল ভেন্যু সোচি চলে যায় তাই স্বাভাবিক ভাবেই আশা করা যায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করেছিলেন, অথবা যারা সোচির পথে মস্কো বা অন্যান্য শহরে এসেছিলেন তাদেরকে আগে থেকেই হোটেল বুকিংএর ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন যাই হোক, এ ব্যাপারটা নিয়ে অন্তত বাংলাদেশের ডেলিগেশনের কিছু সমস্যা হয়েছিলো, যার ফলে অনেককেই ফ্লাইটও মিস করতে হয়েছে
যুব উৎসব শেষ হবার দিন দুই আগে মিজান ফোন করল
-    দাদা, সোহেল ভাইরা (যুব ইউনিয়নের সভাপতি) আমাদের সাথে দেখা করতে চান আপনারা কিছু করতে পারবেন?
-    করা তো দরকার তুমি অমলদের সাথে কথা বল আমিও বলছি
এরপর শুরু হল ফোনালাপ নানা মুনির নানা মত সময় কম কে করবে? কারা নেবে দায়িত্ব? প্রবাসী পরিষদ করতে পারবে কি না? আমি অমলকে বললাম, সময় কম, তাই এত ফর্মালিটিতে না গিয়ে আমরা যারা দেশে ছাত্র ইউনিয়ন বা বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম ওদের বল আড়ম্বর করে কিছু করার সময়, সামর্থ্য কিছুই আমাদের নেই এই মুহূর্তে তাছাড়া ওনারা আসছেন আমাদের সাথে কথা বলতে দেখা করাটাই আসল কোথায় বসালে, কি খাওয়ালে সেটা তো বড় কথা নয় যদি কেউ হাই-ফাই কিছু করতে চায় করুক আমরা যদি দশজন লোক তাদের সাথে একসাথে বসে ডালভাত খেতে খেতে গল্প করতে চাই, আমরা তাই করি আর এ নিয়ে কোন কথা উঠলে দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পার
এটা শনিবার দুপুরের কথা সন্ধ্যায় অমল ফোন করে জানালো দুব্রভকায় বসছি আমার দায়িত্ব উদীচীর চারজনকে সাথে করে নিয়ে আসা আমাদের ধারণা ছিল মস্কো থেকে জনা পনের থাকবে আর ডেলিগেট জনা চল্লিশ ওভাবেই ব্যবস্থা করা হল সন্ধ্যা সাতটা  থেকে দশটা পর্যন্ত আলচনা সভা প্লাস ডিনার কেন না পরের দিন সবার কাজ, এছাড়া ডেলিগেটদেরকে যার যার জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে তাই দেরী করা যাবে না  তবে আমাদের সমস্যা হল কোন কাজ সময় মত শুরু করা জানি না কেন এটা হয় মনে হয় বাঙ্গালী জীবনে অনেক কাজই, যেমন ঈদ, রোজা, নামাজ, পূজা, বিয়ে ইত্যাদি লগ্ন মানে ঘড়ির কাটা ধরে করে, তাই জীবনের আর সব কাজ অসময়ে করে এক ধরনের নিত্যতার সুত্র মেনে চলে এটা অনেকটা আমার বউয়ের মত ও ইমপোর্ট করা জিনিষ পছন্দ করে না আমি তাই বলি বরটা ইমপোর্টেড কিনা, ওতেই ও বিদেশী সামগ্রীর অসাড়তা বুঝতে পেরেছে, নতুন করে রিস্ক নিতে চায় না
বিভিন্ন জায়গা থেকে ডেলিগেটদের আসতে আসতে আটটা বেজে গেল প্রায় অনেকেই ছিলেন উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, যুব মৈত্রী, জাসদ, ন্যাপ, সিপিবি – এক কথায় বাংলাদেশের বাম রাজনীতির সাথে জড়িত প্রায় সব দলের প্রতিনিধি সে দিক থেকে দেখলে আধুনিক রাশিয়ায় এ রকম এক ডেলিগেশন এই প্রথম – কী সংখ্যার দিক দিয়ে কী বামত্বের ঘনত্বের দিক দিয়ে ওনাদেরই কে যেন বললেন, দেশে আমরা অনেকেই পরস্পরকে চিনলেও এক সাথে বসি না, চলি না, খাই না – আর কিছু না হোক, রাশিয়ায় এসে এটা অন্তত হল আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ওনাদের ইম্প্রেশন জানা ওনারা সেটাই জানালেন অনেকেই সমালচনা করলেন রুশ সরকারের বিশেষ করে পুতিনের যুব উৎসবের ব্যবস্থা আর ডিক্লেয়ারেশন নিয়ে অন্য কিছু আশা করিনি যারা এসেছেন, তাদের অনেকেই অল্প বয়েসী, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থাকলেও জীবনের অভিজ্ঞতা তেমন নেই এটা ওদের দোষ নয় জীবনের অভিজ্ঞতা আসে সময়ের সাথে তার উপর সবাই বামপন্থী, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এতে খারাপের কিছু নেই তবে বুঝতে হবে এ দেশের মানুষ তাদের স্বপ্নের সমাজতন্ত্রকে ত্যাগ করে নতুন পথে চলছে, নতুন জীবন গড়ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজের দেশের মানুষের কথা অনেক সময়ই না ভেবে সারা পৃথিবীর মানুষের কথা ভাবতো, নিজেদের আদর্শকে অন্য দেশে রপ্তানি করতে চাইতো আমার তো মনে হয় ঘর ঠিক না করে বাইরের কথা ভাবাও সমাজতন্ত্রের প্রতি এ দেশের মানুষের অনীহার একটা কারণ ছিল আর তাই দেশে এক মাত্র পার্টি হওয়া সত্বেও ইয়েলৎসিন যখন হাতে গণা কিছু লোক নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অবৈধ ঘোষণা করল, কোন মানুষ রাস্তায় নামলো না, টু শব্দ করল না তাই নতুন রাশিয়ায় এসে সোভিয়েত আমলের কথা ভেবে মন খারাপ করার কিছু নেই, যদিও বুঝি বিশ্বের কমিউনিস্টরা এখনও মস্কোকেই তাদের মক্কা মনে করে
একদিকে যেমন তারা যুব উৎসবের আয়জনের প্রশংসা করলেন, অন্য দিকে করলেন কঠিন সমালোচনা সেখানে বিশ্বের প্রগতিশীল যুব  সংগঠনের শ্লোগান না থাকায় বা অনেক বুর্জুয়া স্টাইলে উৎসবের আয়োজন করায় আগেই বলেছি, এ রাশিয়া সে রাশিয়া নয় এদের ভবিষ্যৎ চিন্তাও ভিন্ন আন্তর্জাতিকতাবাদের স্থান নিয়েছে জাতীয়তাবাদ এখন এ দেশে অন্য দেশে বিপ্লবের কথা বলা হয় না, বলা হয় কিভাবে এদের তরুণরা শিক্ষা-দীক্ষা, খেলাধুলায় বিশ্ব জয় করবে আর তাই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়, তা সে অংকই হোক, পদার্থবিদ্যাই, হোক আর কম্পিউটার সায়েন্স হোক – এরা চেষ্টা করে বিজয়ের সম্মান আনতে আর এজন্যেই এই উৎসবে রাজনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন শিক্ষামুলক আলোচনা সে দিক থেকে আমার মনে হয়েছে শুধু মাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ডেলিগেশন পাঠানোর ফলে আমাদের দেশ সোচির প্রোগ্রামের একটা বিশাল অংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এটা নিয়ে আপনাদের সমালোচনা ছিল হয়তো প্রগতিশীল যুব সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আপনারা ঠিক বলছেন তবে পুতিন বা রাশান জনগন একটা জিনিষ বুঝে গেছে টেকনোলোজি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকলে শুধু শ্লোগান দিয়ে কিছু হবে না আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক কিছুই জারের রাশিয়া আর সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের দ্বারা আবিষ্কৃত হলেও পলিটিক্যাল কারণে অনেক কিছুই এখানে বাস্তবায়ন করা হয়নি, আর এ কারণেই দেশ দিনের পর দিন পিছিয়ে গেছে সেই পশ্চাদ্গামীতা কাটিয়ে উঠতে হলে রাজনীতির সাথে সাথে অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করতে হবে আর সেটা করতে হলে বার নম্বর রুমের সাথে সাথে আরও অনেক রুম থাকতে হবে যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে আলচনা হবে
আপনারা বলেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাজ পড়ায় হেনস্তা করেছে পুলিশ আপনাদের কথায় মনে হয়েছে, রাশিয়ায় বুঝি কমিউনিস্ট সিম্বল অবৈধ জানি না, ঠিক কি হয়েছিলো ওখানে, তবে রাশিয়ায় এসব বৈধ  কমিউনিস্ট পার্টি পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল শুধু তাই নয়, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি জুগানভ সোচিতে উপস্থিত ছিলেন তবে এখানে একটা কথা যে কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠন মিটিং মিছিল করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয় অনুমতি সবাই পায়, তবে সবাই যে সব সময় পছন্দমত ভেন্যু পায় সেটা নয় এটা করা হয় নিরাপত্তার কারণে নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার পর এরা যে কোন জন সমাবেশ খুব সতর্কের সাথে করে এমন কি কোন কনসার্টের মঞ্চেও স্পেশাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়  কেন না সরকারের দায়িত্ব জনগনের জানমাল রক্ষা করা এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে চাই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যখন পাকিস্তান দুতাবাসের দিকে যাওয়া হয়, সরকার বাঁধা দেয় এখানেও সেটাই করতো প্রতিটি দেশের সরকার বিদেশী দূতাবাস রক্ষা করতে দায়বদ্ধ তাই কোন রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করলে রাজনৈতিক দল আর প্রশাসনের মধ্যে যে দ্বন্দ সেটা থেকেই যায়, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ইনি যা করতে পারেন, প্রশাসনের লোক হিসেবে সেটা পারেন না আর তখনই আমাদের মনে হয় লোকটা হয়তো আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে যা হোক, শুধু  এটুকু বলতে পারি এখানে রাজনৈতিকভাবে কাউকে হয়রানি করা হয় না শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের সাথে যারা জড়িত বা যারা সন্ত্রাসবাদ প্রচার করতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনা হয় আর পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ যাতে দাঙ্গায় পরিনত না হয় সে জন্যে আগে থেকেই তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যু বরাদ্দ করা হয়
ঐ সভায় কয়েকজন বলতে চেয়েছেন সোচিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্লোগান দিতে দেয়নি হতে পারে সবাই জানেন ইউরোপ, অ্যামেরিকার সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক খুব শীতল সিরিয়া, ইউক্রেন - কত সমস্যা সাম্রজ্যবাদ বিরোধী শ্লোগান সেই সমস্যাকে আরও গভীর করতো রাশিয়ার কি এই মুহূর্তে সেটা দরকার আছে? এই যে আপনারা বললেন বিভিন্ন দলের মানুষ দেশে একসাথে চলেন না, কথা বলেন না – এখানে সবাই এক হয়েছেন, তাই বলে তো আর একে অন্যের রাজনীতিকে মেনে নেননি একইভাবে এটাও দেখেন কিছু কিছু প্রশ্নে একমত হয়েছেন বলেই রাশিয়া আপনাদের এই ভেন্যু দিয়েছে আপনাদের দরকার ছিল যুব উৎসব করা, রাশিয়া চেয়েছে এই সুযোগে আপনাদের কাছে নিজের রাজনীতি তুলে ধরতে, নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে আমি ১৯৮৫ সালের মস্কো যুব উৎসবের ডেলিগেশনে ছিলাম গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের পক্ষ থেকে তখন দেখেছি সেই উপলক্ষ্যে মানুষজনকে কিভাবে মস্কো থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এখন সেটা কল্পনাও করা যায় না তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের মত করেই সব করেছে, তবে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আপনারা – সবাই ছিলেন অ্যামেরিক্যান সমাজ্যবাদ বিরোধী, তাই সোভিয়েতের খবরদারি চোখে পড়েনি, এখন পড়ছে – কারণ পথ আর মত ভিন্ন হয়ে গেছে বলে              
ওদেরই একজন বললও এই যে আপনারা সবাই এদের ভুলত্রুটি ধরা নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু একবারও তো বললেন না আপনার নিজেরা এখান থেকে দেশের জন্য কি নিয়ে গেলেন সত্যি বলতে কী, যদি ওনারা প্রশ্নের উত্তর দিতেন, খুব উপকারী হতাম আমাদের দেশে প্রচুর মেধাবী ছেলে রাজনীতি করতো, এখনও করে বলেই আশা রাখি বর্তমান বিশ্ব বাস্তবাতায় রাজনীতির ধারা পালটে গেছে হয়তো বঙ্গবন্ধুই বলেছিলেন, “আমরা পাকিস্তানীদের হাত থেকে দেশ স্বাধীন করলাম, কিন্তু এখন ঐ আমলাদের দিয়েই দেশ চালাতে হয়“ এখানেও তাই আমরা যত বিপ্লবী রাজনীতিই করি না কেন, যদি বিপ্লবের পর যাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করলাম তাদের হাতেই দেশ চালানোর দায়িত্ব দিতে হয় তাহলে সেই বিপ্লব সফল হবে কিভাবে? তাই বিপ্লবীদের সাথে সাথে আপনারা যদি বিপ্লব পরবর্তী দেশ গড়ার মানুষ না গড়েন দেশ কি নিজেদের মত করে সাজাতে পারবেন? সোচির অন্যান্য রুম থেকে আপনারা অন্তত এই শিক্ষাটা নিয়ে যেতে পারতেন
দেশ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক (ছাত্র, যুব) প্রতিনিধিদের সাথে সাথে উদীচীর লোকজনও ছিলেন এই প্রথন উদীচী অংশ নিল যুব উৎসবে কিরণ আর জয়নালের কাছে ওনাদের কথা শুনেছিলাম তাদের খুব ইচ্ছে মস্কোয় উদীচীর শাখা করা বিশেষ করে প্যারিস আর টরেন্টোতে উদীচী শাখা হওয়ার পর তারা বেশ আশাবাদী আমি বললাম “আমরা তো এখানে হাতে গণা কয়েকজন মাত্র লোক  না পারি গাইতে, না পারি নাচতে আর এসব ছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়া ঠিক হবে না আপনারা হয়তো প্রথম দিকে বুক ফুলিয়ে বলবেন, মস্কোর বুকেও আমাদের শাখা আছে কিন্তু ছ’মাস পরে যখন দেখবেন এর কোনই কার্যক্রম নেই, আপনাদেরই খারাপ লাগবে তারচেয়ে বরং দেশে যান প্রতি বছর জনা পঞ্চাশ ছেলেমেয়ে বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসে স্কলারশীপ নিয়ে চেষ্টা করেন সংস্কৃতিমনা, গান-বাজনা, আবৃতি এসব করতে পারে সেরকম কিছু ছেলেমেয়ে পাঠাতে আমাদের শুধু লোকের সমস্যাই নয়, জায়গার সমস্যাও প্রচুর ছাত্ররা এলে ওরা ইউনিভার্সিটি থেকে রিহার্সালের জন্য বিনে পয়সায় রুম পাবে আর একটা জায়গা থাকলে দেখবেন আমাদের অনেকেই এতে যোগ দেবে“ এ কথাগুলো যতটা না উদীচীর নেতাদের বলা তার চেয়ে বেশী করে বলা আমাদের বন্ধুদের যাদের স্কলারশীপের ব্যপারে হাত আছে  ভেবে দেখতে পারেন এরকম কিছু ছেলেমেয়ে পাঠানো যায় কি না! সোভিয়েত আমলেও আমরা গান-বাজনা জানা ছেলেমেয়েদের জন্য অপেক্ষা করতাম, নতুন রাশিয়াতেও তেমনটাই করি      
আগেই বলেছি আমাদের ওই আলোচনা সভায় দেশ থেকে আসা প্রায় ৪০ জন উপস্থিত ছিলেন। ওনারা আসার আগেই নিজেদের মধ্যে আলাপ হচ্ছিলো কীভাবে সভা পরিচালিত হবে। কেউ কেউ চাইছিলো সবাই যেন দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দেয়। কিন্তু সেটা করতে গেলে অতিরিক্ত ৩০ - ৪০ মিনিট চলে যাবে বিধায় আইডিয়াটা বাদ দেয়া হয়। ঠিক হয় উপস্থিত বিভিন্ন দলের নেতারা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখবেন আর এর পরে যদি কেউ কিছু বলতে চান বা কারো কোন প্রশ্ন থাকে তার উত্তর দেবেন। আমি প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে স্কেপটিক্যাল ছিলাম। প্রথমত দেশ থেকে যারা এসেছেন সবাই রাজনীতি করেন, বক্তৃতা দেয়া তাদের পেশা, তাই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখা তাদের পক্ষে কঠিন। তাছাড়া এখানে আমরা যেমন জড় হয়েছি তাদের কথা, তাদের ইম্প্রেশন শোনার জন্য, তাদেরও তেমনি আমাদের কাছ থেকে জানার আগ্রহ থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে যদি কেউ কথা বলে সেটা হবে সত্যিকার অর্থে মতবিনিময় সভা। কিন্তু আজকাল যেহেতু “কী” নয়   “কে” – এটাই মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন, মানে কী বলবে সেটা নয়, কে বলবে এ প্রশ্নটাই সামনে চলে এলো, ঠিক হোল আমরা কেউ কিছু বলবো না।  তবে শেষ রক্ষা হোল না, পুতিন বা রাশিয়া সরকারের সমালচনা করতেই কেউ কেউ দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করলো বা বলতে পারেন কেন এমন হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলো। ফলে আলোচনা তখন অন্য দিকে মোড় নিলো। শুধু আমাদের কেন, দেশ থেকে আসা লোকজনও তাদেরই কারো কোন বক্তব্যে একমত হতে না পারলে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলল। সব মিলে আলোচনা হোল অনেক বেশি প্রাণবন্ত। যেহেতু বক্তাদের সংখ্যা অনেক আর সবাইকে নামেধামে চিনি না, তাই সবার কথা উল্লেখ করবো না। আমি ব্যাক্তিগতভাবে একজনের বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আর মনে মনে চাইছিলাম তার জন্য যেন বেশি সময় বরাদ্দ থাকে। উনি আমাদের প্রিয় আকাশ ভাই, আমাদের সময়ের তুখোর ছাত্র নেতা যিনি আবেগের চেয়ে যুক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দেন, মার্ক্সের শিক্ষার আলোকে ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করেন। সভা শুরুর আগেই দেখা করলাম আকাশ ভাইয়ের সাথে। এর আগে কয়েকবার দেখা হলেও সেটা তার মনে থাকার কথা নয়। জিজ্ঞেস করলাম এতদিন পরে রাশিয়ায় এসে কেমন লাগছে। সঙ্গে আসা লোকজন যারা সবাই বাম আদর্শে বিশ্বাসী তারাই বা কীভাবে নিচ্ছে আধুনিক রাশিয়ার পরিবর্তনগুলো। এরা কেউই যে খুব ভালোভাবে নেয়নি এই পরিবর্তনগুলো তা তাদের বক্তব্য থেকেই বোঝা গেলো। আকাশ ভাই চেষ্টা করলেন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। বললেন প্রগতিশীল যুব সমাজের নিজস্ব এজেণ্ডার কথা, একই সাথে রাশিয়ার নিজের এজেণ্ডার কথা। যেখানে মিল সেখানে একসাথে চলা, মিল না থাকলে ভিন্ন পথে যাওয়া।                                    
পরে আমার মনে পড়লো আশির দশকের রাজনীতির কথা। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবি সবাই একসাথে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করতো, যদিও জানত এরশাদের পতনের পরেই তাদের পথ বিভিন্ন দিকে বেঁকে যাবে, আজকে যে মিত্র কাল সে শত্রু হবে। এটাই রাজনীতির নিয়ম। এখানে কোন চিরস্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই, যদিও কিছু কিছু মিত্রতা আমাদের ক্ষুব্ধ করে, অবিশ্বাস জাগায়। আমি ফেসবুকে প্রায়ই লক্ষ্য করি আমাদের অনেক বন্ধুরা কোন কোন প্রশ্নে সহমত প্রকাশ না করলে বা ভিন্নমত প্রকাশ করলে ক্ষুব্ধ হয়, অনেককে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দেয়। সেটা অবশ্য তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে সব প্রশ্নে সব সময় একমত হবে এমন বন্ধু কি আদৌ পাওয়া যায়। যাদের পাওয়া যায়, তারা যতটা না বন্ধু তার চেয়ে বেশি চাটুকার। এই চাটুকাররা যে কোন দল বা গোষ্ঠীর জন্য বেশি ক্ষতিকর। সত্যিকারের বন্ধুর কাজতো অন্ধভাবে সমর্থন করা নয়, বরং প্রশ্ন করে সন্দেহ জাগানো, যেন সাতবার ভেবে সিদ্ধান্ত নেই।      
সভা শেষে আমি গেলাম গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে একটা গ্রুপকে পৌঁছে দিতে। রাস্তায় কথা হোল। রাশিয়া নিয়ে, পুতিনকে নিয়ে। নব্বইয়ের দশকের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির পরে পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি প্রচুর লোক সমর্থন করে। এটা এ দেশের মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন। মনে পড়ে দশ বছর আগেও কেউ অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে টু শব্দ করতো না (ইরান আর উত্তর কোরিয়া বাদে)। যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক – একের পর এক দেশ চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেলো।  কারো টু শব্দ করার সাহস ছিল না। কিন্তু সব সময়ই কিছু শিশু বেরিয়ে আসে যে বলে, রাজা তো ন্যাংটো। এই বলাটার জন্য সাহস দরকার। ২০০৭ সালের মিউনিখের বক্তৃতায় পুতিন তাই করেছেন। ওই বক্তব্য ছাড়া আজ কি নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু গড়ার সাহস পেতাম আমরা? পুতিন দেখিয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময়ই দাঁড়ানো যায়, দাঁড়ানো দরকার। নিজ দেশের জাতীয় স্বার্থে যে কারো সাথে লড়াই করা যায়, করা দরকার। তার সব কাজকেই যে সমর্থন করতে হবে, তার সব কাজই যে ঠিক সেটা নয় – তবে বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। পশ্চিমা বিশ্ব বার বার দেখিয়েছে সভ্যতার কথা বললেও, মানবাধিকারের কথা বললেও নিজেদের স্বার্থ আদায়ে তারা সেই মধ্যযুগেই রয়ে গেছে, শুধু রেড ইন্ডিয়ান বা আফ্রিকানদের বদলে তারা আজ আরব আর এশীয়দের বা ভিন্নমতের মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে। নিজেদের অর্থবল, মিডিয়া আর অস্ত্রবল প্রয়োগ করে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করছে। সে হোক রাশিয়ান দলকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা আর হোক রাশিয়ার ডিপ্লোম্যাটিক সম্পত্তি জোর করে দখল করা। এটাই বর্তমান বিশ্ববাস্তবতা। এটাকে রুখতে হলে রাজনীতির যেমন দরকার, তেমনি দরকার শক্তিশালী অর্থনীতি আর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। সব কিছুর উপর পুতিন দেশপ্রেমিক। তাই নিজের দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেটা তার বা তাদের ভালো মনে হয় সেটাই করেন। এমন কি সেটা যদি আমাদের ভালো না ও লাগে। তবে এটাও ঠিক অ্যামেরিকা যেটা করে সারা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, রাশিয়া সেটা করে বা করার চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক আইনকানুনের মধ্যে থেকে।
পরের দিন, মানে সোমবার নিজের একটা কাজে মিকলুখো মাকলায়া গিয়েছিলাম। ভাবলাম একটু দেখা করে যাই আকাশ ভাইদের সাথে। ইচ্ছে ছিল দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলার, দেশের বর্তমান অবস্থার কথা জানার। কিন্তু ওনারা কেউই হোস্টেলে ছিলেন না। সময় বয়ে যায়, বদলে যায় সমাজ, বদলে যায় দেশ। কিন্তু আদর্শ থাকে, থাকে দেশের প্রতি ভালোবাসা। আর যতদিন ভালোবাসা থাকে, থাকে জানার আগ্রহ। আর আগ্রহ থাকলে কোন এক সময় ঠিক দেখা হবে, কথা হবে।                

দুবনা, ২৫ – ২৬ অক্টোবর ২০১৭      


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি