ছুটির নিমন্ত্রনে তুমি আমায়

গত দু’দিন হোল একটা চিঠি ভাইরাল হচ্ছে ফেসবুকে। প্রথমে দেখি লিপির পোষ্টে, পরে অনেকেই লিখেছেন এ ব্যাপারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই অন্তত যারা রেগুলার বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, তারা যে হরহামেশাই বানান ভুল করেন এটা নতুন কিছু নয়। সুমিত বলে আমার এক ভারতীয় বন্ধু আছে। ও আমাকে এ নিয়ে ঠাট্টা করলে বলি  
-       একটা গল্প শোন। ইন্সপেক্টর এসেছেন স্কুল পরিদর্শনে। এক ছাত্রকে কাপড় বানান লিখতে বললে ও লিখেছে “কাপুর”। ইন্সপেক্টর তো রেগে অস্থির। কাপড় বানান লিখতে পারে না। অবস্থা খারাপ দেখে হেডমাস্টার বললেন “ আরে, এতো রাগের কি আছে। কাপড়ের জায়গায় না হয় কাপুর লিখেছে, গামছা তো লেখেনি।“
-       তা তুই যত হাল্কা করেই দেখিস না কেন, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তেমন নয়। তোদের দেশে এই ভাষাকে কেন্দ্র করে বিপ্লব ঘটে গেল, দেশ স্বাধীন হোল, এমন কি একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোল জাতি সংঘ থেকে। এটা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরেও এই ভাষা নিয়ে তোদের অবহেলা বলতে পারিস এক ধরণের অপরাধ।
-       দেখ, আমি গ্রাম থেকে আসা। পড়াশুনা গ্রামের স্কুলে, মফস্বল শহরের কলেজে। তারপর এ দেশে আসা। জানি না ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে কেমন, আমাদের স্কুলে সে আমলেও এসবের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না। ইংরেজি বানান যাতে ভুল না লিখি সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যতটা নজরদারি ছিল, বাংলার ক্ষেত্রে তেমন ছিল না। এখানে আমরা ভাষা কোর্স করেছি। আমার ছেলেমেয়েরা এ দেশের স্কুলে পড়েছে, পড়ছে। উচ্চারণ আর বানান এদের যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়, আমাদের দেশে সেটা হয় না। ভাবখানা এই, বাঙ্গালী হয়ে জন্মেছ, বাংলা এমনিতেই শিখবে। আর ঐ যে তুই একুশের কথা বললি, কি বলব? আমাদের স্মরণশক্তি খুব ছোট। বাহান্ন তো প্রাগৈতিহাসিক। একাত্তর তো সেদিনের কথা। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিলো, আর এখন আমরা আবার সেই ধর্মকেই সামনে নিয়ে আসছি, সাম্প্রদায়িকতা আজ ভোটের রাজনীতিতে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র। বলতে পারিস ”উইপন অফ মাছ ডেস্ট্রাকশন”।
-       তা যা বলেছিস।
যা হোক লিপির আপলোড করা সেই চিঠি পড়ে মনে হচ্ছিলো হাইস্কুলের কোন এক খারাপ ছাত্রের পরীক্ষার খাতায় লেখা দরখাস্ত। হতেই পারে। ভালো ছাত্র, খারাপ ছাত্র সব সময়ই ছিল। এর চেয়ে কত ভুলভাল লেখা দেখেছি। এমন কি স্বাক্ষর দেখেও কিছু মনে হয় নি – সুরেন্দ্র কুমার সিনহা – অবলুপ্ত প্রায় হিন্দু সমাজে তেমন বেশী না থাকলেও এ নাম এখনো একেবারে বিরল নয়।  কিন্তু খটকা লাগলো একেবারে শেষের লাইনে এসে যেখানে লেখা ছিল “প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশ”। প্রথমত প্রধান বিচারপতির কাছ থেক এ রকম বানানভুল আশা করা যায় না। কারণ বিচার বিভাগের লোকেরা, যারা রায় লিখেন, তারা বানান, দাড়ি, কমা এসব ব্যাপারে স্বাভাবিক ভাবেই খুব সতর্ক – কারণ একটা কমার এদিক সেদিক বিচারের রায়কে বদলে দিতে পারে। তাছাড়া এ রকম স্ট্যাটাসের লোকেদের স্বাক্ষর সাদামাটা হয় না, যা যে কেউ চাইলেই নকল করতে পারে। এমন কি এটা যদি সত্যি সত্যি বিচারপতির লেখা হয়ে থাকে, যে কোন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই এটার সত্যতায় সংশয় প্রকাশ করবেন। এই চিঠিটা প্রকাশ করায় বিচারপতি সিনহার কতটুকু ক্ষতি হয়েছে বলতে পারব না, তবে এতে করে যে দেশের আর বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ধুলিস্যাত করা হয়েছে - সেটা ঠিক। আর যারা এটা করেছেন – দেশের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আর এরা যদি দেশের চালক হন, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে – দেশটা আজ কার হাতে?

দুবনা, ০৫ অক্টোবর ২০১৭  


      
  

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি