যুব উৎসব ২০১৭



গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হোল, কথা হোল অনলাইন চাটে প্যারিস থেকে কিরণের  সাথে, টরেন্টোর আজিজ ভাইয়ের সাথে, ঢাকা থেকে জয়নালের সাথে। সবগুলোর বিষয় ছিল উদীচী। সামনে বিশ্ব যুব উৎসব, উদীচীর ডেলিগেশন আসবে – মস্কোয় কিছু করা যায় কি না? সোভিয়েত আমলের সেই জৌলুষ না থাকলেও অনেকেই এখনও এসব ব্যাপারে মস্কোর দিকে তাকান, মস্কোয় কিছু করা যায় কী না সে কথা ভাবেন। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। আমি মস্কোর বাংলাদেশী কমিউনিটির বাস্তবতার কথা বলছি। ইউরোপ আমেরিকার যেখানে লাখ লাখ বাঙ্গালীর বাস, এখানে মাত্র কয়েক শ’, তাও আবার অধিকাংশই রুটি রুজির খোঁজেই ব্যস্ত। রাশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা এসব সংগঠনের অনুকুলে নয়। তাছাড়া এখন  ছাত্রদের মধ্যেও দেশীয় রাজনীতি ঢুকে যাওয়ায় এখানে দেশীয় রাজনীতির চর্চাই বেশি হয়, সংস্কৃতির নয়। আর আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল উপদল। সব মিলিয়ে কোন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ার মত পরিবেশ নেই, আর গড়তে পারলেও সেটা ঠিক মত চালানোর শক্তি বা সামর্থ্য নেই আমাদের। রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন চালানোর জন্য আদর্শ, শ্লোগান, কিছু মিটিং আর জমায়েত যথেষ্ট হলেও সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য দরকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, দরকার সেই সব লোক যারা গাইতে বাজাতে পারে, নাটক করতে পারে, মানে যারা মঞ্চে উঠে এখানকার বাংলাদেশীদের (আপাতত) মনে  কিছুটা হলেও দেশীয় সংস্কৃতির ছাপ এঁকে দিতে পারে। কিন্তু সত্যটা এই মস্কোয় যারা এসবের সাথে জড়িত তাদের উদীচীর ব্যানারে জড়ো করার পরিবেশ বা শক্তি এই মুহূর্তে নেই। উদীচীর ব্যাপারে এই মুহূর্তে কিছু হবে কিনা জানি না, তবে এসব কথায় একটা উপকার হয়েছে। ভুলেই গেছিলাম বিশ্ব যুব উৎসবের কথা, সেটা নতুন করে মনে পড়েছে।              
যদিও অনেক আগে থেকেই এখানে বা দেশের বন্ধুরা যুব উৎসব নিয়ে কথা বলছিল, বিভিন্ন কাজকর্মে তা ভুলেই গিয়েছিলাম। গতকাল টিভিতে এক ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার দেখালো, যিনি ১৯৮৫ সালে ডেলিগেট ছিলেন। সন্ধ্যায় যখন ফিরছি অফিস থেকে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে, হঠাৎ মনে পড়লো, বাহ রে আমিও তো ১৯৮৫ সালের যুব উৎসবের ডেলিগেট ছিলাম। ১৯৮৩ সালে মস্কো আসার পর থেকেই আমি আমাদের বাংলাদেশ কোরাস দলের সদস্য হই, যতটা না গান করার গুনে তার চেয়ে বেশি ছেলে শিল্পীর অভাবের কারণে। বিভিন্ন সময় শুভ, ওয়াজেদ, শফিক আমাদের সাথে গাইলেও ধীরে ধীরে সবাই কেটে পড়েছিল। মুল কারণ ছিল ঘন ঘন রিহার্সাল। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মস্কো মেলা, বিজয় দিবস, সম্মেলন – এসব তো ছিলই, আরও ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তাই আমাদের ব্যস্ততার ঘাটতি ছিল না। ১৯৮৫ সাল ছিল গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ বছর পূর্তির বছর। তাই ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত একটানা চলে আমাদের প্রোগ্রাম। ফেব্রুয়ারীতে হোটেল রাশিয়ায় গ্র্যান্ড কনসার্টে অংশ নেয়া ছাড়াও ছিল কয়েকটা রেকর্ডিঙের কাজ। পার্থদার নেতৃত্বে আমাদের গ্রুপে ছিল আলোময়দা, রুচিরা আপা, মিন্টুদা, পলি আপা, হাই ভাই, নীলা আপা, বাপ্পা, রুমা। তাসমিনা, নাইম ভাই এরাও আসতো, তবে এই মুহূর্তে মনে নেই ওরা তখন ছিল কি না। ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানের পরেই শুরু হয় যুব উৎসবের প্রস্তুতি। এসব বড় অনুষ্ঠানে শুধু আমরাই নই, শতাধিক দেশের ছেলেমেয়েরা জড়িত থাকতো, তাই অনেক সময়ই অন্যদের সাথে রিহার্সাল  হতো।  মস্কো ও মস্কোর আশেপাশের কত শহরে যে গিয়েছি গান গাইতে। গান গাইতাম বিভিন্ন কলকারখানার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সাধারণ শ্রমিকদের সামনে। এ দেশের লোকজন হিন্দি ফিল্মের গান অনেক জানলেও আমাদের গাওয়া দেশাত্মবোধক গান বা গণসঙ্গীতের সাথে তেমন পরিচিত ছিল না, তবুও আসতো দল বেঁধে আমাদের গান শুনতে। সাথে যদি ল্যাটিন অ্যামেরিকার, বিশেষ করে আলেন্দের দেশ চিলির গ্রুপ থাকতো, তাহলে তো কথাই নেই। আরও ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ সাউথ আফ্রিকার কোরাস। খুব ভালো গাইত ওরা। বিশাল দল। ছেলেমেয়ে মিলে জনা তিরিশের মত।
উৎসব শুরু হবার কয়েকদিন আগে থেকেই মস্কোর বিভিন্ন পার্কের স্টেজে গাইলাম আমরা। কেভিএনএর মাস্লিয়াকভ আমাদের গান রেকর্ড করলেন পার্ক কুলতুরীতে। আস্তানকিনোর টেলিসেন্টারেও হোল কয়েকটা রেকর্ডিং। দেশে তখন আন্দোলনের জোয়ার। সিপিবি, যুব ইউনিয়নসহ বামপন্থী দলগুলোর পালে বিপ্লবের হাওয়া। কথা ছিল বিশাল ডেলিগেশন আসবে – নির্মলেন্দু গুন, আসাদুজ্জামান নূর সহ অনেক জনপ্রিয় কবি ও শিল্পীরা, ছাত্র ও যুব নেতারা। তবে এরশাদ সরকার শেষ মুহূর্তে তাদের সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার অনুমতি না দেয়ায় স্থানীয় ছাত্ররাই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে, শুরু হয় কে যাবে, কে যাবে না এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা। আমরা অবশ্য বরাবরই এর বাইরে ছিলাম, আমরা ছিলাম এন্টারটেইনার। ওপেনিং বা ক্লোসিং সেরেমনি আমাদের জন্য নয়, তাই গনেশদাকে আমার জেনিত ক্যামেরায় স্লাইড ভরে বলেছিলাম আমার জন্য কিছু ছবি তুলতে। উৎসবের এক পর্যায়ে ভেদেএনখায় ডীন রীডের সাথে গেয়েছিলাম We shall overcome. তখন নিজেকে মনে হয়েছিলো ইতিহাসের এক অংশ। ৩২ বছর পরে নিজেই ভুলে গিয়েছি সেসব কথা। ঠিক এই মুহূর্তে টিভিতে দেখাচ্ছে সেই উৎসবের কিছু কিছু অংশ। এইমাত্র গরবাচেভের বক্তব্য দেখাল। তখন যে উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম তার বক্তব্য শুনে আজ তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।
উৎসব শেষে আমরা প্রায় পুরো দলটাই গিয়েছিলাম কাজাখস্তান - আলমা-আতা, ৎসেলিনাগ্রাদ (অধুনা আস্তানা – কাজাখস্তানের রাজধানী)। ওখানেও বিভিন্ন পাইওনীয়ার ক্যাম্প আর সাবখোজে (যৌথ খামার) গেয়েছিলাম গান, নিয়ে গিয়েছিলাম শান্তির বানী –
Дети разных народов,
Мы мечтою о мире живём.
В эти грозные годы
Мы за счастье бороться идём.
В разных землях и странах,
На морях-океанах
Каждый, кто молод, дайте нам руки,
В наши ряды, друзья!

Припев:
Песню дружбы запевает молодежь,
Молодежь, молодежь.
Эту песню не задушишь, не убьёшь,
Не убьёшь, не убьёшь.
Нам, молодым, вторит песней той
Весь шар земной.
Эту песню не задушишь, не убьёшь,
Не убьёшь, не убьёшь.

Помним грохот металла
И друзей боевых имена,
Кровью праведной алой
Наша дружба навек скреплена.
Всех, кто честен душою,
Мы зовём за собою.
Счастье народов, светлое завтра -
В наших руках, друзья!

Припев: тот же

Молодыми сердцами
Повторяем мы клятвы слова,
Подымаем мы знамя
За священные наши права.
Снова чёрные силы
Роют миру могилу.
Каждый, кто честен, встань с нами вместе
Против огня войны!

দুবনা, ১৪ অক্টোবর ২০১৭ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি