গণতন্ত্র


কয়েক দিন আগে রবীন আক্ষেপ করে লিখেছিল “৯০এর গনঅভ্যুথানের সময়টা রাজনীতির ময়দানে বেশ সক্রিয় ছিলাম। রাস্তায় দাড়িয়ে একগাদা পুলিশ, বিডিআর এর সামনেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতাম, স্বৈরাচারী এরশাদ! সেই সময়টা এখন নস্টালজিয়ার মতো মনে হয়, আহা! স্বৈরাচারকে স্বৈরাচার বলার মত গনতন্ত্রটুকু তো ছিল! অনেকদিন দেশের বাইরে, ঠিক কি ঘটছে সেটা জানি পত্রপত্রিকা থেকে আর ফেসবুকে। তবে এটা ঠিক, সামরিক জান্তার সময়েও আমরা মিটিং মিছিল করেছি। বাধানিষেধ যেমন ছিল, আইন অমান্য করার সুযোগও তেমনই ছিল। এক দিকে মিটিং বা মিছিলে গুলি চলেছে, ট্রাক উঠেছে, অন্য দিকে এসব বাধাবিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে সংগ্রামী ছাত্র জনতা আন্দোলন করেছে, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। তাই আজ যখন বিভিন্ন আন্দোলনের উপর বাধা আসে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে, গণতন্ত্রের রূপ নিয়ে।   
ইতিহাস থেকে যেটুকু জানা যায়, বাঙ্গালি বীরের জাতি। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানই এই জাতিকে সর্বপ্রথম একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, কী প্রাক ইসলামিক যুগে, কী সুলতানী আমলে বাঙ্গালি বারবার বিদ্রোহ করেছে। ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস তো বাঙ্গালির বিদ্রোহের কাহিনী। পাকিস্তানও তাই। বাংলাদেশেও বাঙ্গালি বারবার বিদ্রোহ করেছে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে প্রায় সব সময়ই বিভিন্ন দলীয় স্বৈরশাসন মেনে নিয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিম বঙ্গেও। কী বাম ফ্রন্ট, কী তৃণমূল সবাই নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য রাজনৈতিক ক্যাডার ব্যবহার করেছে, করছে। সেটা বাংলাদেশেও ঘটেছে, ঘটছে। গণতন্ত্রের কথা বলে, গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থায় ক্ষমতায় এলেও প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলই বিরোধী মতকে শক্ত হাতে দমন করেছে, করছে। কেন এমন হয়? কেন সামরিক শাসনামলে স্বৈরাচারকে স্বৈরাচার বলার গণতন্ত্র থাকে, অথচ নির্বাচিত সরকারের সময় ২১ আগস্ট বা আন্দোলনকারীদের হাতুড়িপেটা করার মত ঘটনা ঘটে? ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারী হতে হবে এটা মনে হয় আমাদের মাঝে মন্ত্রের মত ঢুকে গেছে। ফলে ক্ষমতায় যেই থাকুক বিরোধী দলের প্রতি তারা সবসময়ই সন্দিহান। তারা বিরোধী দলকে রাষ্ট্রকাঠামোর একটা অপরিহার্য স্তম্ভ বলে মনে না করে এক প্রয়োজনীয়, এমন কি শত্রু শক্তি বলে মনে করে। দল থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করে দেখতে না পারার কারণেই এমনটা ঘটে। সামরিক শাসনকালে গণতন্ত্রের পক্ষের দলগুলো এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করে বলে জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়, আর তাই বারবার ফিরিয়ে আনে গণতন্ত্র। কিন্তু সামরিক জান্তা চলে গেলেই শুরু হয় নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, জনগণ হয় দ্বিধাবিভক্ত, গণতন্ত্র হয় পশ্চাৎপদ। কিন্তু মানুষ কী করবে? কমরেড সেলিমের মতে “ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত চুলার” ডিলেমায় জনগণ দিশেহারা। কিন্তু যাবে কোথায় তারা? কোন তৃতীয় শক্তি কি আছে যার কাছে গণতন্ত্রকে দেখভাল করার ভার দিতে পারে জনগণ? রাজনীতিও মার্কেট ইকনমির মত, সাপ্লাই কম থাকলে অসৎ ব্যবসায়ীরা লো কোয়ালিটির জিনিস চড়া দামে বিক্রি করবে সেটাই স্বাভাবিক। দোষ জনগনের নয়, দোষ অসৎ রাজনীতিবিদদেরও নয়। দোষ সেই সমস্ত সচেতন রাজনীতিবিদ আর বুদ্ধিজীবিদের যারা সব বুঝেও জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী কোন বিকল্প উপস্থিত করতে পারে না। তিন দলীয় (দুই বড় দল আর সেনাবাহিনী) খেলা মারাত্মক এ কারণেই যে দু দলের এক হয়ে তৃতীয় পক্ষকে ঘায়েল করা যত সহজ, চার বা বেশি পক্ষ থাকলে সেটা তত সহজ নয়। এক মাত্র জনমতকে প্রভাবিত করার মত শক্তিশালী কিছু দলের আবির্ভাবই দেশকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। সেটা হলে স্বৈরাচারকে স্বৈরাচার বলার গণতান্ত্রিক অধিকার লাভের জন্য সমরিক শাসনের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
দুবনা, ১৭ জুলাই ২০১৮            

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি