বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

বিজ্ঞানের কল্যাণে আজকাল প্রায়ই বাড়িতে কথা বলা হয়। আশির দশকের প্রথম দিকে যখন দেশ ছাড়ি তখন চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। টেলিফোন তখন ঢাকাতেই সবার ছিল না, গ্রামে তো দূরের কথা। এখন সময় বদলে গেছে। দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মেসেঞ্জারের প্রবেশের ফলে দূরদূরান্তের বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। চাইলেই রিং করে বলা যায় “দিদি, কেমন আছিস?” পৃথিবীটা সত্যিকার অর্থেই ছোট হয়ে এসেছে।
দিদি কিছুদিন আগেও স্কুলে শিক্ষকতা করত, তাই সাধারণত শুক্রবার ওকে ফোন করতাম। ওই অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে। তাই গত শুক্রবার ফোন করে জানতে চাইলাম
-       বাড়িতে নতুন মুখ এল?
-       নারে ভাই। ডেট পিছিয়ে নিয়েছে। আজ সূর্যগ্রহণ কি না!
-       তার উপর ১৩ তারিখ, শুক্রবার। - হেসে বললাম আমি।
আমার জন্ম ১৯৬৪ সালে। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে ১২ ভাই আর পাঁচ বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। এভাবেই কাটে এগারো বছর। ১৯৭৫ সালে সুধীরদার মেয়ে ভ্রমরের জন্মের পর আমি একটু হলেও বড় হওয়ার সুযোগ পাই। যদিও ভ্রমরের আগে বাপি আর মিঠুর জন্ম, তবে ওসব হয়েছে ইন্ডিয়ায়। দেশ বিভাগের এই এক ফল। আমরা কখনই সব ভাইবোন এক সাথে হতে পারিনি।  সুবোধদা দেশ ছেড়েছে আমার জন্মের অনেক আগেই, স্বপনদা আমার ছয় মাস বয়েসে। তাই ফ্যামিলি গেট তুগেদার আমাদের কখনই হয়নি। ওই সময় মানুষের, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের জন্ম হত আঁতুড় ঘরে। পাড়ায় বন্ধুদের ভাইবোন জন্ম নিত এভাবেই। ভ্রমরের জন্ম অবশ্য মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে। শ্যামলদার ছেলেরাও গফরগাঁও জন্ম নিয়েছে। তাই দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত বাড়িতে কাউকে জন্মাতে দেখিনি। এখন অবশ্য আমাদের পরের জেনারেশন বড় হয়েছে। ওদের ছেলেমেয়ে হচ্ছে। তবে এখন আর কেউ আমাদের মত করে জন্ম নেয় না। সবাই আসে সিজারীয়ায়ন পদ্ধতিতে। আমার ছেলেমেয়েরা মস্কোয় জন্ম নিয়েছে, হাসপাতালে, তবে নর্মাল ডেলিভারী। এখানে মা বা শিশুর স্বাভাবিক জন্মে কোন জটিলতা দেখা না দিয়ে অস্ত্রপ্রচার করা হয় না। তবে দেশে এটা অনেকটা ব্যবসার মত হয়ে গেছে। ডাক্তাররা এখন আর স্বাভাবিক জন্মে আগ্রহী নন।
আমার বড় ছেলেমেয়েদের জন্ম হয় স্বাভাবিক ভাবে। প্রসব বেদনা ওঠার পর এ্যাম্বুলেন্স ডাকি। বাকীটা ডাক্তাররাই করে। সেভার জন্মের সময় আমরা চেয়েছিলাম একজন নির্দিষ্ট ভদ্রমহিলা এটা করুক। উনি ছুটিতে যাবেন বিধায় বললেন ২ রা জানুয়ারী ডেলিভারি করাতে। রাজী হয়ে গেলাম। সেভার জন্মের দু সপ্তাহ পরে যখন মস্কো গেলাম বার্থ সার্টিফিকেট নিতে, ভদ্রমহিলা বললেন
-        ছেলে তো দেখছি ভাগ্যবান। আপনার সাথে এক দিনে জন্ম।
আমি তো  অবাক। আমার জন্ম তারিখ ২৫ শে ডিসেম্বর। পরে মনে পড়ল স্কুলে ছোট মাষ্টারমশাই ওটাকে ২ রা জানুয়ারী করে দিয়েছিলেন। যাই হোক  অনেকদিন পরে ২ জানুয়ারী তার মর্যাদা ফিরে পেল। তাই আজকাল যে জন্ম তারিখটা ঠিক করা যায় সেটা জানা ছিল। কিন্তু দিদির কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সূর্যগ্রহণ বলে জন্মের তারিখ বদলে নেওয়া? কুসংস্কারের সেবায় বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা!
অবশ্য খুব বেশি ভাবতে হল না। মনে পড়ে গেল কিভাবে বিজ্ঞানের সমস্ত আবিষ্কারকে ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্মের প্রচারে ও প্রসারে যা কিনা বিজ্ঞানকে স্বীকার পর্যন্ত করে না। প্রচার থেকে শুরু করে ধর্মের নামে খুন এসবই এখন হয় বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে। বিজ্ঞানেরও আজ গণতন্ত্রের মতই অবস্থা। মানুষ যেমন গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রেরই গলা টিপে ধরে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষও তেমনি বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে নিজেদের কুসংস্কারগুলোকে পাকাপোক্ত করতে।      

দুবনা, ১৮ জুলাই ২০১৮ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি