ছেলেধরা
ইদানীং
কালে পত্রপত্রিকা, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে বিদেশে বাংলাদেশের কর্মজীবী
মানুষদের দুর্দশার কথা শোনা যায়। আর এসব পড়ে আমার মনে পড়ে ছোটবেলার বিভিন্ন গল্প।
আমাদের ছোটবেলায় চারিদিক ছিল বিপদসংকুল। রাতের বেলায় বাঁশ ঝাড়
আর তেতুল গাছে নাচত ভুত-পেত্নীরা। বর্ষায় খালবিল গিজগিজ
করত চুলপেচানীতে। আর পাড়ার বাইরে যেসব রাস্তাঘাট ছিল সেখানে আড়ি পেতে থাকতো ছেলেধরা। শহরে চার দেয়ালের মাঝে
বা ছোট পরিসরে বড় হওয়া
বাচ্চাদের হয়তো এত ভৌতিক পরিবেশ দেখতে হয়নি, তবে আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠেঘাটে বড় হওয়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের
ইচ্ছে করেই এটুকু ভয়ভীতি ধরিয়ে দেওয়া হত
যাতে তারা সবার অগোচরে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও চলে না যায়। শুনেছি ছেলে ধরারা নাকি ছোট বাচ্চাদের ধরে শহরে তাদের দিয়ে
ভিক্ষে করাতো বা তাদের অঙ্গ
প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দিত। বড় হয়ে অবশ্য এসব বিশ্বাস করা বাদ দিয়েছিলাম। বুঝতাম চুলপেচানী অক্টোপাসের গ্রামীন সংস্করণ। ভুতেরাও পালিয়েছিল শিক্ষার আলোয়। ছেলেধরাও মনে হত নিছকই
বাচ্চাদের ভয় দেখানোর গল্প। পরে বুঝলাম আক্ষরিক অর্থে না হলেও ব্যাপারটা ফেলে দেওয়ার মত
নয়। কসোবাসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিদ্ধস্ত্ব এলাকায় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
বিক্রয়ের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। শুধু বাচ্চা নয়, বয়স্ক মানুষদের ধরে নিয়ে ভিক্ষুক বানানোর কথাও শুনেছি অনেক। শুনেছি তাদের সিণ্ডিকেটের কথা। তবে এসবই আইনের বাইরে বিভিন্ন দুষ্টচক্র দ্বারা পরিচালিত, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন
দেশের সরকার আইনী ব্যবস্থা পর্যন্ত
নেয়। কিন্তু বর্তমানে আইনের মধ্যে থেকেই বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে যারা আপাত দৃষ্টিতে ভিন্ন মনে হলেও আসলে আধুনিক কালের ছেলেধরা। এই ছেলেগুলো আমাদের অভাব এবং লোভ, আর ছেলেধরা হল চারিদিকে ওঁত পেতে থাকা বিভিন্ন এজেন্ট যারা মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে হয়
শেষ সম্বল কেড়ে নেয়, নয়তো ঘোর বিপদে ফেলে দেয়। দেশের আনাচে কানাচে গড়ে
ওঠা বিভিন্ন এজেন্সি যারা অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মানুষদের বিশাল অংকের টাকার
বিনিময়ে বিদেশে পাঠায় উচ্চ বেতন আর সহজ কাজের লোভ দেখিয়ে, আর পরিণামে শত শত মানুষ
হারায় তাদের শেষ সম্বল, অসংখ্য নারী বিদেশের মাটিতে হয় ধর্ষণের শিকার। এরাই কি আধুনিক ছেলে ধরা নয়? আর এটা শুধু যে বিভিন্ন বেসরকারি এজেন্সি করে
তাই নয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এসব কর্মজীবী মানুষদের দুঃখ দুর্দশার কথা জেনেও বিদেশি
মুদ্রার লোভে, রেমিট্যান্সের লোভে এদের বিদেশে পাঠায়। সেভাবে দেখলে এসব মন্ত্রণালয়ও ছেলেধরা। ছোটবেলার
সেসব ছেলেধরারা যেমন হতভাগ্য বাচ্চাদের আয়ে নিজেরা বাহাদুরি করত, আজকের আমলারা,
আজকের এলিটরাও বিদেশ বিভূঁইয়ে এই সব খেটে খাওয়া মানুষের পাঠানো রেমিট্যান্সের
টাকায় গড়ে ওঠা বিদেশি মুদ্রার পাহাড় দেখিয়ে নিজেদের উন্নয়নের হিসেব কষে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা গায়েব
হয়ে যায়, বাসের চাকায় পিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের মৃত্যু
সংবাদে মন্ত্রী হাসে – এসব কিসের আলামত? আজ রাজনীতিবিদ মানেই ছেলেধরা, যারা আমাদের
মাথায় হাত বুলিয়ে ভোট নেয়, টাকা নেয়, মানসম্ভ্রম নেয় আবার এ নিয়ে কথা বললে আমাদের
ট্যাক্সের টাকায় পালিত পুলিশ লেলিয়ে আমাদেরই শায়েস্তা করে। এক সময় রাজনীতি মানে
ছিল আদর্শ, এখন সেটা শুধুই ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্য রাজনীতিবিদ আজ শয়তানের কাছে আত্মা
বিক্রি করতেও পিছ পা হয় না। যেকোনো উপায়েই হোকনা কেন অর্থ আর ক্ষমতার এই
স্বর্গোদ্যানে ঢুকতে আধুনিক ছেলেধরাদের খপ্পরে পড়ে কত মানুষ যে আজ পথে বসছে তার
হিসেব কে রাখে?
Comments
Post a Comment