বিশ্বকাপের রেশ

বিশ্বকাপ শেষ। একটা মাস বেশ উত্তেজনার মধ্যে কাটালো পৃথিবী। অনেক আগে ছাত্রজীবনে আমিও ফুটবল খেলা দেখতাম বন্ধুদের সাথে হৈহুল্লোড় করে। ওভাবে শেষ দেখা মনে হয় ১৯৯৬ সালে ইউরোপিয়ান কাপ। রেজা তখন মস্কো ছিল। খেলা দেখার কথা মনে হতেই মনে পড়ে ১৯৮৬ সালের কথা। মেক্সিকো বিশ্বকাপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন খেলছিল হাঙ্গেরির সাথে। যদি ভুল না করি ছয় ছয়টা গোল দিয়েছিল। প্যাট্রিস লুমুম্বার হোস্টেলগুলো থেকে সমস্ত বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে এসেছিল সেদিন। মিক্লুখো মাক্লায়া অচল করে দিয়েছিলাম আমরা। এটা ছিল আমার দেখা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এক অভূতপূর্ব ঘটনা। মিলিশিয়া এসেছিল অনেক, কিন্তু কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। মজার ব্যাপার হল সোভিয়েত ইউনিয়ন জেতার এই আনন্দমেলায় সোভিয়েত বা রাশান ছাত্ররা সেদিন সামিল হয়নি। ওদের কাছে এটা ছিল অকল্পনীয়। আমরা বিদেশিরা নেমেছিলাম। পরে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আমাদের বলে কয়ে ঘরে নিয়ে আসে। এখন দেশই বদলে গেছে। বিভিন্ন খেলায় বিজয়ের পর আনন্দমেলা এখন এদের রুটিন কাজ, এয়ারপোর্টে ফ্যানরা দল বেঁধে যায় প্রিয় দল বা খেলোয়াড়কে অভ্যর্থনা জানাতে।

আমার খেলা দেখা অবশ্য এবার মাঝেমধ্যে একটু স্কোর দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিছুদিন আগে সেভা ফুটবল খেলত, ভেবেছিলাম ওকে নিয়ে যাব খেলা দেখতে। বছরখানেক হল ও আর ফুটবলে তেমন আগ্রহ দেখায় না। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম মাঠে যেতে চায় কি না? কোন আগ্রহ দেখায়নি। তাই আমিও আর এ নিয়ে ভাবিনি। খেলা দেখেছি টিভিতে, তাও মাত্র তিন চারটে খেলা। মাঝে মস্কো গিয়ে ঘুরেছি রাস্তায় অ্যাটমোস্ফেয়ারটা উপলব্ধি করার জন্য। ছবি তুলেছি মন ভরে। ভালো লেগেছে।

বিভিন্ন কারণে বিশ্বকাপটা ছিল রাশিয়ার জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ দেশে যারা বিরোধী ছিল তাদের কথা জানি না, তবে বিদেশিরা প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে সফল আয়োজনের কথা। রাশিয়া, রাশিয়ার মানুষ, এখানকার সবকিছু এক নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেয়েছে বিশ্বের কাছে। এটা শুধু বিশ্বকাপকেই সফল করেনি, রাশিয়াকেও সফল করেছে বিশ্ববাসীর কাছে। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে যখন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে প্রশ্ন করা হয়, কে জিতবে? উনি বলেছিলেন “কোন দল জিতবে সেটা খেলার মাঠেই ঠিক হবে, তবে সংগঠক এবং রাশিয়ার মানুষ যে জিতবে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।“ কথাটা উনি ঠিক বলেছিলেন।

১৯৮৫ সালের বিশ্ব যুব উৎসবে ছিলাম আমি। সেখানেও আনন্দের কমতি ছিল না। তবে এবারকার মত স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না সেখানে। সে সব উৎসব রাজনৈতিক, বিশ্বকাপ রাজনীতির ঊর্ধ্বে না হলেও এর অরাজনৈতিক আবেদনটাই বেশি।
১৯৯১ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমন করলে কুয়েতের ভৌগলিক অবস্থান কোথায় সেটা জানার জন্য একটা অ্যাটলাস কিনেছিলাম। যুদ্ধ শেষ হয় খুব দ্রুতই, তবে অ্যাটলাসটা এখন রয়ে গেছে। বিশ্বকাপ শেষ, তবে একে ঘিরে জল্পনা কল্পনা অনেক দিন রয়ে যাবে, অনেক দিন মনে থাকবে বিভিন্ন পোস্টের কথা। “বসন্তের সতেরটি মুহূর্তে” কেট আসলে কোন দেশের মানুষ সেটা নির্ধারণ করতে গেস্টাপো প্রসবের সময় কেট কি বলে চিৎকার করে সেটা জানতে চায়। খেলাও তাই। এখানে মানুষের পোস্ট, পোস্টের ভাষা দেখে অনেক কিছুই জানা যায়। নিজেদের অজান্তেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আদর্শ – কত রকমের ভুত যে আলমারি থেকে বেরিয়ে আসে তার হিসেব কে রাখে? সমাজতন্ত্রকে দুই যুগেরও বেশি আগে নির্বাসন দেওয়ার পরও দেশ বিদেশের বামপন্থীরা রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। মিলশোভিচ বসনিয়ার মুসলমান হত্যা করেছে অভিযোগে অনেকে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে সমর্থন করে, যদিও এই ক্রোটরাই মিলশোভিচের যুগোস্লাভিয়ার পতনে সবচেয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। আবার একই সাথে ভুলে যায় আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এদের কারণে লিবিয়া, সিরিয়ায় লাখ লাখ মানুষের দুর্দশার কথা, যার কাছে মিলশোভিচ নিতান্তই শিশু। বখাটে শিশু। এটা আবারও প্রমান করে মার্ক্সবাদ যতই পড়ি না কেন, নিজেকে যতই প্রগতিশীল মনে করিনা কেন, আমাদের মগজটা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের খবরে খুব ভালো ভাবেই ধোয়া। পশ্চিমা মাধ্যমের ওয়াশিং মেশিনে ক্রমাগত ঘূর্ণনরত মানুষদের জন্য এ বিশ্বকাপ ছিল খোলা জানালা দিয়ে আসা এক পশলা উল্টো বাতাসের মত। এই বাতাস যত বেশি দিন থাকবে, যত দূর দেশে যাবে বিশ্বের জন্য, ফুটবলের জন্য ততই মঙ্গল।   
দুবনা, ১৬ জুলাই ২০১৮


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি