বোকা হওয়া অপরাধ


আপনি কি নিজেকে বোকা মনে করেন?
মনে করার কি আছে? আমি সত্যি সত্যিই বোকা।
হুম! আপনি নিজেকে অপরাধী মনে করেন?
সে আর বলতে! আমি শুধু বোকাই নই, অপরাধীও।
বেশ। তা একটু খুলে বলবেন আপনি নিজেকে এমনটা ভাবেন কেন?
এই দেখুন, সামনে নির্বাচন। আমি জানি প্রতিটি প্রার্থী মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো সত্যিই বিশ্বাস করে একদিন তারা সেটা করতে পারবে, তবে রাতারাতি যে কিছু করতে পারবে না সেটাও জানে। আবার একদল জানে এটা কথার কথা। এরা কথা দেয়ই শুধু, কথা রাখতে জানে না বা বলতে পারেন কথা দিয়ে কথা যে রাখতে হয় সেটা মনেই করে না। তাদের ভাবটা এই, যা দিলাম তা আবার রাখার কী আছে? আবার আরও একদল আছে যারা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে সেই স্বপ্নকে কিভাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা যায় সেই ধান্দায় থাকে। এরা আমাদের সোনার থালায় ভাত খাওয়াবে বলে মুখের ভাত পর্যন্ত কেড়ে নেয়।  তারপরেও আমি ভোট দিতে যাই। তার মানে আমি সব বুঝেও তাদের বিশ্বাস করি। যে সব জেনেও ঠকতে রাজি সে বোকা না তো কী?
কিন্তু এতে অপরাধের কী আছে?
বা রে! এই যে আমি ভোট দিয়ে একদল মানুষকে মিথ্যুক এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধী হতে সাহায্য করছি এটা কী অপরাধ নয়? একটু খেয়াল করলেই দেখবেন আমাদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটা বিরাট অংশ কিভাবে জনগণের সম্পদ তছনছ করছে। কীভাবে রাতারাতি তারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। আর সেটা করছে আমাদের দেওয়া ক্ষমতার বলে। তাহলে কী আমরাও তার অপরাধের ভাগী নই? আর এটাকে অপরাধ না বলে কি বলবেন আপনি? সেদিক থেকে দেখলে শুধু আমি কেন, আমরা সবাই কমবেশি দোষী।
আচ্ছা। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভোট না দিলেই তো হয়।
সেটা অবশ্য একদিকে ঠিক। কিন্তু ভোট দেওয়া আমাদের নাগরিক অধিকার। সেই অধিকারের অপব্যবহার করাটাও কিন্তু ঠিক নয়। আসলে দুটো ব্যাপার আছে – আইন আর ন্যায়। যেটা আইন সম্মত সেটা অনেক সময় ন্যায্য নাও হতে পারে ঠিক একই ভাবে যেটা ন্যায় সেটা কখনো কখনো আইনের বিরুদ্ধে যেতে পারে। রাষ্ট্র আইন তৈরি করে করে নিজের কাজ চালানোর জন্যে। এটা বলতে পারেন একটা গড়পড়তা ব্যাপার। যে কোন কালেক্টিভই চলে এ রকম গড়পড়তা হিসেব অনুযায়ী। ন্যায়ের ব্যাপারটা মানুষের নিজের, মানবিক। সেটা বিবেকের সাথে জড়িত। যেখানে আইন ন্যায়সঙ্গত আর ন্যায় আইনসম্মত সেখানে কোন ঝামেলা হয় না। কিন্তু কখনো কখনো এই দুইএর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এটাকে বলতে পারেন শাঁখের করাত। বর্তমানে ভোটের ব্যাপার অনেকটা তাই। ভোট দিয়ে মানবিক বিচারে আপনি অন্যায়কে সমর্থন করছেন, আবার না দিয়ে আইনের চোখে আপনি অন্যায় করছেন।        
কিন্তু এই যদি অবস্থা হয় তবে কি করা উচিৎ?
সবাই নিজের নিজের মত করে ঠিক করে কি উচিৎ আর কি উচিৎ নয়। তবে এটা ঠিক সমস্যা ভোটে নয়, সমস্যা রাজনৈতিক মডেলে। আমি গণতন্ত্রের কথা বলছি না, বলছি তার ইন্টারপ্রিটেশনের কথা। আমাদের রাজনীতিই কিন্তু সুযোগ দেয় মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার, মিথ্যে স্বপ্ন দেখানোর। ধরুন ব্যাংকের কথা। আপনি সেখান থেকে লোণ নিলে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। কোন কারণে আপনি চুক্তি অনুযায়ী লোণ ফেরত না দিলে ব্যাঙ্ক আইনের ব্যবস্থা নিতে পারে। জানি, আমাদের দেশে ব্যাংকিং সেক্টরে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেটাও কিন্তু হয় বর্তমানের রাজনীতির কারণে, এই রাজনীতির ফাঁকফোকর দিয়েই। আমরা যদি রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করতে পারি তাহলে এরকম অবস্থায় পড়তে হবে না।  আর সেটা করতে হলে আমাদের দল বা মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দিতে হবে। প্রয়োজনে সতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিতে হবে। দলে বিশেষ করে বড় দলে থেকে অন্যায় করা যত সহজ  একা বা ছোট দলে থেকে সেটা করা তত সহজ নয়। এবারের ভোটকে আমরা সে কাজে ব্যবহার করতে পারি। যারা সৎ, যারা শুধু স্বপ্ন দেখায় না, সেই স্বপ্নকে সফল করার জন্য কিছু করতে সচেষ্ট তাদের ভোট দিতে পারি। হ্যাঁ, আরও একটা কথা। নির্বাচন এটা রাজনীতির খেলা। কিন্তু আমাদের দেশের জন প্রতিনিধিদের দেখে মনে হয় ফুটবল মাঠে ক্রিকেটাররা খেলছে। মানে রাজনৈতিক সংস্থাগুলো আজ ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিদের দিয়ে ভর্তি। যে রাজনীতি করে না তার কাছ থেকে রাজনৈতিক ব্যবহার আশা করব কিভাবে? সে সংসদে গেলেও ব্যবসায়ীই থেকে যায়। তাই আসুন আমরা দলকে নয় প্রার্থীকে ভোট দিই, ব্যবসায়ী নয় রাজনীতিবিদকে ভোট দিই, যে ধোঁকা দেয় তাকে নয়,  নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সচেষ্ট হবে এমন লোকদের ভোট দিই। তাহলে নিজেকেও ঠকানো হবে না আবার নাগরিক অধিকার চর্চাও হবে। জিততে না পারলেও এভাবেই আমরা দেশে যারা রাজনীতির কলকাঠি নাড়ায় তাদের বুঝতে দিতে পারব যে আমরা আর বোকা থাকতে রাজি নই, ভোট দিয়ে তাদের অন্যায়ের ভাগী হতে রাজি নই।     
দুবনা, ২০ নভেম্বর ২০১৮    



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

রাজনীতি

স্মৃতি