নীরবতা
সেদিন টিভিতে একটা কথা শুনলাম,
একজন নামকরা অভিনেতা বলছিলেন এক ইন্টার্ভিউয়ের সময়। কিছু কথা, কিছু বাক্য মনে দাগ
কেটে যায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি চুপচাপ থাকতে আর একা থাকতে ভালবাসি। বলতে পারেন আমি অনেকটা নিজের প্রেমে মসগুল, নিজের সংগ, নিজের সাথে কথা বলা – এগুলো সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এমন কী একা একা খেলতেও। সেই ছোটবেলাতেই রাতে বিছানায় বসে একা একা মার্বেল, লুডু কত কীই না খেলতাম। তাছাড়া বাড়িতে সে সুবিধাও ছিল। কেউ কখনও অযথা কিছু বলত না। সবাই একটু সময় পেলেই বই বা খবরের কাগজ নিয়ে বসত। কেউবা সেলাই বা অন্য কোন কাজে। ছাত্র জীবনেও আড্ডায় বসে কখন যে নিজের অজান্তেই বইয়ের ভেতর ঢুকে পড়তাম!
আমার নিজের ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল ওদের সাথে কথা বলা মূলত ছিল ছোটদের বিভিন্ন বই পড়ে শোনানো। ওরা না হলে রাশিয়ান শিশু সাহিত্য যে এতো সমৃদ্ধ সেটা জানাই হত না, যদিও আমার নিজের শিশুকাল কেটেছে ঠাকুরমার ঝুলি, মায়ের মুখে রূপকথা, রামায়ন, মহাভারতের গল্প আর রুশ দেশের উপকথা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গল্প পড়ে। এখনও বাড়িতে আমরা যে আমরা খুব বেশি কথা বলি তা নয়। ছেলেমেয়েরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলে বসে থাকতে পারে নিজেদের কাজ নিয়ে। সপ্তাহের যে দু’দিন মস্কো থাকি সময় কাটে ছেলেমেয়েদের পাশে বসে। দুবনায় ফিরলে গুলিয়া জিজ্ঞেস করে ওদের কথা। কেমন আছে, কি বলল। সে এক ভীষণ বিপদ। কারণ আমার সব সময় মনে হয় কিছু হলে নিশ্চয়ই বলবে, বলেও তাই। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে নাক গলিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে ওরা বরং বিরক্ত হয়।
মনে পড়ে ২০০৯ সালের কথা। অনেক দিন দুবনায় থাকার পর ওরা মস্কো চলে যায়। সেভার বয়স তখন ছয়, আমার খুব ন্যাওটা। তাই প্রায়ই ফোন করে হত বা ও নিজেই ফোন করত। কিন্তু কথা তেমন হত না। অ নিজেই বলত না। দুএকটা কথা বলেই ও খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত আর আমি আমার কাজ করতাম। কিন্তু ফোন অফ করলেই আবার ফোন আসতো। আসল কথা কথা নয়, এই যে আমি আছি, পাশে, ধরাছোঁয়ার মধ্যে সেটাই আসল কথা। এখনও ওদের সাথে দূরে কোথাও যেতে আমার অসুবিধা হয় না। আগে সবাই বই পড়তাম, এখন ওরা স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত, আমি ই-বুক নিয়ে। কখনও মনে হয়না সময়টা ঠিক কাটছে না।
যদি সাথে অন্য কেউ থাকে তাদের নিয়ে হাঁটতে সমস্য হয় না। আমি হাঁটতে ভালবাসি। এ সময় সঙ্গী থাকলে তাদের কোম্পানি এঞ্জয় করি। কলিগ হলে তো কথাই নেই। ওদের সাথে ফিজিক্স, ম্যাথ বা ফটোগ্রাফি নিয়ে কথা বলে বলতে, অনেক কিছু শিখতে শিখতে সময় চলে যায়। অন্যদের সাথে গল্প করি রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। পুরনো বন্ধুরা সাথে থাকলে ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে আসে গল্পে গল্পে। তবে এসব হয় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর সময়।
সমস্যা হয় ট্রেনে, বাসে। এ সময়টা আমি পড়তে পছন্দ করি। সাথে অন্য কেউ থাকলে বই বের করে পড়তে ইতস্তত বোধ করি, আবার মন খুলে যে কথা বলব সেটাও হয় না, মন পরে থাকে বইয়ে। এক ধরণের দায়িত্ববোধের ভুত এসে ঘাড়ে চেপে বসে। মনে হয় কি ভাববে সাথের মানুষটা যদি এখন বই খুলে বসি।
শুধু সামনা সামনি কেন, ফোনেও আমার কথা আচ্ছা, বেশ, ঠিক আছে এসব শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে শুনতে আমি খুব ভালবাসি যদি শোণার মত কথা কেউ বলে। অনেক সময় এমন হয় কেউ কথা বলছে তো বলছেই আর আমি শুনছি তো শুনছিই। কোন সাড়া শব্দ নেই। ওদিক থেকে হঠাৎ প্রশ্ন আসে “আছেন তো?” “হুম!” তবে ইদানীং কালে কথা বলার থেকে কথা লেখাটাই বেশি হয়। সেটা মনে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে। বাড়ির সবার সাথে ওটাই এখন মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা। কে কোন কাজে ব্যস্ত কে জানে? তাই সামাজিক মাধ্যমে ফ্যামিলি চাটে নিউজ রেখে দিলেই উত্তর মেলে। হ্যাঁ, ফিরে আসি সেই অভিনেতার কথায়। উনি বলছিলেন যে উনি ওনার স্ত্রীর সাথে চুপ করে বসে থাকতে খুব কম্ফারটেবল ফিল করেন (Мне комфортно с ней молчать )। আসলেই তাই। পরস্পারিক বোঝাপড়া যখন ভালো হয়, তখন আর কথা দিয়ে সময় ভরাট করতে হয় না, অজুহাত খুঁজতে হয়না। চুপ করে পাশে বসে থেকে, এমন কি টেলিফোনেও চুপ করে থেকেই অনেক বেশি কথা বলে দেওয়া যায়। আমরাও মনে হয় শুধুমাত্র উপস্থিতি দিয়ে, কথা না বলে শত কথা বলি নিজেদের সাথে। পাশে আছি, কাছে আছি, ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আছি – এটা হাজার কথার চেয়েও অনেক বেশি সত্য, অনেক বেশি বিশ্বাস জাগানো। তাই হয় এরা বলে “নীরবতা – সোনার মত দামী।“ (Молчание – золото; Silence is gold)
ছোটবেলা থেকেই আমি চুপচাপ থাকতে আর একা থাকতে ভালবাসি। বলতে পারেন আমি অনেকটা নিজের প্রেমে মসগুল, নিজের সংগ, নিজের সাথে কথা বলা – এগুলো সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এমন কী একা একা খেলতেও। সেই ছোটবেলাতেই রাতে বিছানায় বসে একা একা মার্বেল, লুডু কত কীই না খেলতাম। তাছাড়া বাড়িতে সে সুবিধাও ছিল। কেউ কখনও অযথা কিছু বলত না। সবাই একটু সময় পেলেই বই বা খবরের কাগজ নিয়ে বসত। কেউবা সেলাই বা অন্য কোন কাজে। ছাত্র জীবনেও আড্ডায় বসে কখন যে নিজের অজান্তেই বইয়ের ভেতর ঢুকে পড়তাম!
আমার নিজের ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল ওদের সাথে কথা বলা মূলত ছিল ছোটদের বিভিন্ন বই পড়ে শোনানো। ওরা না হলে রাশিয়ান শিশু সাহিত্য যে এতো সমৃদ্ধ সেটা জানাই হত না, যদিও আমার নিজের শিশুকাল কেটেছে ঠাকুরমার ঝুলি, মায়ের মুখে রূপকথা, রামায়ন, মহাভারতের গল্প আর রুশ দেশের উপকথা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গল্প পড়ে। এখনও বাড়িতে আমরা যে আমরা খুব বেশি কথা বলি তা নয়। ছেলেমেয়েরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলে বসে থাকতে পারে নিজেদের কাজ নিয়ে। সপ্তাহের যে দু’দিন মস্কো থাকি সময় কাটে ছেলেমেয়েদের পাশে বসে। দুবনায় ফিরলে গুলিয়া জিজ্ঞেস করে ওদের কথা। কেমন আছে, কি বলল। সে এক ভীষণ বিপদ। কারণ আমার সব সময় মনে হয় কিছু হলে নিশ্চয়ই বলবে, বলেও তাই। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে নাক গলিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে ওরা বরং বিরক্ত হয়।
মনে পড়ে ২০০৯ সালের কথা। অনেক দিন দুবনায় থাকার পর ওরা মস্কো চলে যায়। সেভার বয়স তখন ছয়, আমার খুব ন্যাওটা। তাই প্রায়ই ফোন করে হত বা ও নিজেই ফোন করত। কিন্তু কথা তেমন হত না। অ নিজেই বলত না। দুএকটা কথা বলেই ও খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত আর আমি আমার কাজ করতাম। কিন্তু ফোন অফ করলেই আবার ফোন আসতো। আসল কথা কথা নয়, এই যে আমি আছি, পাশে, ধরাছোঁয়ার মধ্যে সেটাই আসল কথা। এখনও ওদের সাথে দূরে কোথাও যেতে আমার অসুবিধা হয় না। আগে সবাই বই পড়তাম, এখন ওরা স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত, আমি ই-বুক নিয়ে। কখনও মনে হয়না সময়টা ঠিক কাটছে না।
যদি সাথে অন্য কেউ থাকে তাদের নিয়ে হাঁটতে সমস্য হয় না। আমি হাঁটতে ভালবাসি। এ সময় সঙ্গী থাকলে তাদের কোম্পানি এঞ্জয় করি। কলিগ হলে তো কথাই নেই। ওদের সাথে ফিজিক্স, ম্যাথ বা ফটোগ্রাফি নিয়ে কথা বলে বলতে, অনেক কিছু শিখতে শিখতে সময় চলে যায়। অন্যদের সাথে গল্প করি রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। পুরনো বন্ধুরা সাথে থাকলে ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে আসে গল্পে গল্পে। তবে এসব হয় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর সময়।
সমস্যা হয় ট্রেনে, বাসে। এ সময়টা আমি পড়তে পছন্দ করি। সাথে অন্য কেউ থাকলে বই বের করে পড়তে ইতস্তত বোধ করি, আবার মন খুলে যে কথা বলব সেটাও হয় না, মন পরে থাকে বইয়ে। এক ধরণের দায়িত্ববোধের ভুত এসে ঘাড়ে চেপে বসে। মনে হয় কি ভাববে সাথের মানুষটা যদি এখন বই খুলে বসি।
শুধু সামনা সামনি কেন, ফোনেও আমার কথা আচ্ছা, বেশ, ঠিক আছে এসব শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে শুনতে আমি খুব ভালবাসি যদি শোণার মত কথা কেউ বলে। অনেক সময় এমন হয় কেউ কথা বলছে তো বলছেই আর আমি শুনছি তো শুনছিই। কোন সাড়া শব্দ নেই। ওদিক থেকে হঠাৎ প্রশ্ন আসে “আছেন তো?” “হুম!” তবে ইদানীং কালে কথা বলার থেকে কথা লেখাটাই বেশি হয়। সেটা মনে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে। বাড়ির সবার সাথে ওটাই এখন মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা। কে কোন কাজে ব্যস্ত কে জানে? তাই সামাজিক মাধ্যমে ফ্যামিলি চাটে নিউজ রেখে দিলেই উত্তর মেলে। হ্যাঁ, ফিরে আসি সেই অভিনেতার কথায়। উনি বলছিলেন যে উনি ওনার স্ত্রীর সাথে চুপ করে বসে থাকতে খুব কম্ফারটেবল ফিল করেন (Мне комфортно с ней молчать )। আসলেই তাই। পরস্পারিক বোঝাপড়া যখন ভালো হয়, তখন আর কথা দিয়ে সময় ভরাট করতে হয় না, অজুহাত খুঁজতে হয়না। চুপ করে পাশে বসে থেকে, এমন কি টেলিফোনেও চুপ করে থেকেই অনেক বেশি কথা বলে দেওয়া যায়। আমরাও মনে হয় শুধুমাত্র উপস্থিতি দিয়ে, কথা না বলে শত কথা বলি নিজেদের সাথে। পাশে আছি, কাছে আছি, ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আছি – এটা হাজার কথার চেয়েও অনেক বেশি সত্য, অনেক বেশি বিশ্বাস জাগানো। তাই হয় এরা বলে “নীরবতা – সোনার মত দামী।“ (Молчание – золото; Silence is gold)
Comments
Post a Comment