শ্রীলাশের আত্মা

টং
যেন দূর থেকে ভেসে এল শব্দটা। ঘুমের ঘোরে ওটা ঠিক শব্দ কিনা সেটা বুঝে ওঠার আগেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল শ্রীলাশ।
টং
টং
টং
যে অন্ধকার ভেদ করে আলো পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে না, অবলীলায় এই টুং টাং শব্দ কেমন করে যেন ঢুকে যাচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবল শ্রীলাশ।
টুং টং টাং
না, আর পারা যায় না। একটু বিরক্তই হয়ে উঠলো শ্রীলাশ।
টুং টং টিং ট্যাং
শান্তিতে দেখি ওরা মরতেও দেবে না। ঘুমের মধ্যেই শ্রীলাশের মুখ ফস্কে কথাগুলো বেরিয়ে এল। আর "মরা" শব্দটা কানে যেতেই একেবারে লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল।
হ্যাঁ, সব মনে পড়ছে। সব মনে পড়ছে ওর। গতকাল পর্যন্তও ও অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করত এই সব শব্দ শোনার জন্য। এগুলো শব্দ নয়, সঙ্গীত। প্রতিটি টুং টাং ছিল জীবনের প্রতীক। এসব শব্দই ওকে জানাত আরও একজন ওর পোস্টে লাইক দিল, কমেন্ট করল। জানাত ওদের বন্ধুত্বের কথা। কিন্তু সে ছিল গতকাল। সেই আলো ভরা পৃথিবী, সেই কোলাহল, সেই আড্ডা, আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, উজ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আর ছিল বিশাল নীলাকাশ। ও জানতো ওই নীলাকাশ অনেক দূরে একেবারেই কালো অন্ধকারে ভরা। কিন্তু তা যে এত কালো শ্রীলাশের সেটা জানা ছিল না। হঠাৎ করেই সব কোলাহল কোথায় যেন হারিয়ে গেল, কেউ যেন রেডিও বা টিভি অফ করার মত মহাবিশ্বের সব শব্দকেই সুইচ অফ করে দিল। সূর্য, তারা সব একসাথে নিভে গেল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মুখ সব হারিয়ে গেল সেই আঁধারে। তারপর শ্রীলাশের আর কিছুই মনে নেই। ওর নাম যে শ্রীলাশ সেটাও ও জানতো না। পরে কে যেন ওকে বলল ও আসলে এখন শুধুই লাশ, তবে চাইলে শুধু লাশ না বলে নিজেকে শ্রীলাশ বলে পরিচয় দিতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা উপযোগী নাম ওরা খুঁজে পায়। আর সেই সাথে দিয়ে গেল একটা অতি প্রাচীন মডেলের স্মার্ট ফোন (এতই সেকেলে যে স্মার্ট বলতেও লজ্জা লাগে) যেখানে ও ফেলে আসা বন্ধুদের কাছ থেকে মেসেজ রিসিভ করতে পারবে, মানে দেখতে পারবে বন্ধুরা কে কি ভাবছে ওকে নিয়ে, কে কি বলছে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার কোনই অপশন নেই।
কি আর করা। উপায় নেই। তাই ও দেখতে শুরু করল বন্ধুদের কাছ থেকে আসা মেসেজগুলো। না, নতুন কিছুই নেই। ও যেমনটা করেছে, ওর বন্ধুরাও তাই করছে। সবাই যেন কপি পেস্ট করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে
রেস্ট ইন পিস। Rest in peace. RIP.
একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল শ্রীলাশ। প্রতি মিনিটে মিনিটে এমন মেসেজ পাঠালে শান্তিতে আর রেস্ট নেব কখন? তোমরা মর্যাদার সাথে যেমন কাউকে বাঁচতেও দেবে না, তেমনি মর্যাদার সাথে মরতেও দেবে না। এমনকি মৃত্যুটাও আর প্রাইভেট রাখতে দেবে না, তাকেও পাবলিক প্রোপার্টি করেই ছাড়বে। রাগে ওর চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। কিন্তু হায় হাতই তো নেই, তা চুল ছিঁড়বে কি দিয়ে আর চুল থাকলে তো ছিঁড়বে। শ্রীলাশ তার সাকারত্ব ছেড়ে এখন নিরাকার হয়েছে, সে এখন শুধুই আইডিয়া। এটাই কী আত্মা!!!!

দুবনা, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০
 
 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি