একুশের ভাবনা

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় দুটো নতুন দেশ। পাকিস্তানের নেতারা যতটা না নতুন দেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন ভারত বিভাগের নীল নকশা রচনায়। সেটা প্রমাণ করে ১৯৪৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিবর্তন। আর সঠিক পরিকল্পনা না থাকার ফলেই জন্মের ছয় মাসের মধ্যেই দেশের পূর্ব অংশে দেখা দেয় বিদ্রোহ। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি অফ পাকিস্তানের সভায় যখন উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব আসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। তখন পাকিস্তানের কোন প্রদেশেই উর্দু মাতৃভাষা ছিল না, আর পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ জনগণের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তাই করাচীতে জিন্নাহর সামনে দাঁড়িয়েই তিনি বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা নয়, দেশের অন্যতম একটি ভাষার স্বীকৃতি দেবার দাবী জানান। তবে সে দাবীকে উপেক্ষা করে সে বছর ১১ মার্চ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করা হয়। জ্বলে উঠে বিদ্রোহের আগুন। কিন্তু সেই দাবী কি শুধুই ভাষার দাবী ছিল? সেটা ছিল বাঙ্গালীকে শুধু ধর্মীয় নয়, ভাষাভিত্তিক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবী। এরপর সব ইতিহাস। সেই দাবীর হাত ধরে আসে বাহান্নর একুশ, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর আর সব শেষে একাত্তর। ভাষার সাথে সাথে বাঙ্গালী জাতি পায় স্বাধীন দেশ যেখানে লাল সবুজ পতাকার দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে সে গাইতে পারে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।“ ভাইয়ের রক্তে আর মায়ের কান্নায় ভেজা স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি। সূর্য ওঠার আগেই প্রভাতফেরী বের হয়, ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনার। বাঙ্গালীর এ গৌরব গাঁথা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পরে দেশে দেশে। বিশ্বের যেখানেই মাতৃভাষা বিপদের সম্মুখীন সেখানেই পৌঁছে একুশের ডাক, একুশের চেতনা।

বছর ঘুরে আবার ফিরে এল একুশে ফেব্রুয়ারি। বইমেলা, প্রভাত ফেরি, কোন কিছুতেই কমতি নেই। ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে শহীদ মিনার। ছোট বড় সবার মন আজ বেদনায় ভরা। তারা স্মরণ করছে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতদের। আর একই ভাবে অতি যত্নে ভুলে গেছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ অনেকের নাম। এখন একুশ শুধু শহীদ দিবস নয় বা শোক দিবস নয়, একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু বাহান্নতে বাঙ্গালী জাতি কি শুধুই মাতৃভাষায় কথা বলতে চেয়েছিল, শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্যই প্রাণ দিয়েছিল? নাকি নিজের ভাষায় নিজের মনের কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য ছিল তার এ লড়াই? সেই বাঙ্গালী কি স্বপ্নেও ভেবেছিল মায়ের ভাষায় নিজের মতামত প্রকাশ করার জন্য তাকে একদিন স্বাধীন দেশেই সাতান্ন ধারার মুখোমুখি হতে হবে? সে কি ভেবেছিল এ দেশেরই একদল লোক আরেক দল লোককে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে পার পেয়ে যাবে আর যাদের হুমকি দেওয়া হল তারা শালীনতা বজায় রেখে সে কথার প্রতিবাদ করলে বিচারের সম্মুখীন হবে? একুশ তো শুধু ভাষার অধিকার নয়, একুশ আমাদের দিয়েছিল রাজনীতি করার অধিকার, একুশ আমাদের দিয়েছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে জবাব চাওয়ার অধিকার। একুশ ছিল দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক পথে রাজনীতি বিকাশের লড়াই। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি? দেশের সম্পদ বানের জলে ভেসে ইউরোপ, অ্যামেরিকা, ক্যানাডার উপকূলে আশ্রয় নিচ্ছে। জবাবদিহিতা আজ অমাবস্যার চাঁদের মতই অদৃশ্য, ডুমুরের ফুলের মতই অধরা। রাজনীতি শুধু অসুস্থই নয়, রাজনীতি আজ কর্কট রোগাক্রান্ত, মৃত্যু পথ যাত্রী। আজ একুশের সব চাকচিক্যের আড়ালে আসলে অ্যান্টিএকুশের অবাধ যাতায়াত। বাঙ্গালী আজ আর ভাষাভিত্তিক জাতি নয়, সে আজ ধর্মভিত্তিক জাতি। ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করেই যাচ্ছে সরকারের উপর গণতন্ত্রের পথ থেকে, ধর্ম নিরপেক্ষতার পথ থেকে দূরে সরে যেতে। সরকারও ভোটের মোহে সেসব দাবি মেনে নিচ্ছে। সেটা আমরা দেখছি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সরকারের নীতিতে। তাই সময় এসেছে ফিরে তাকানোর, নতুন করে ভাবার কোন দেশের, কোন জাতির স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম? কিসের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষা শহীদরা। সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যাওয়ার পূর্বে এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর, যে স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ মানুষ জীবন দান করেছিল তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। কারণ ক্ষমতায় যখন একাত্তরের চেতনার সরকার সে আমলে স্বাধীনতার অঙ্গীকার যদি ধুলিস্যাত হয় তার দায় দায়িত্ব শুধু সরকারের নয় গোটা জাতির।
সবাইকে একুশের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন

দুবনা, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি