ভ্যাক্সিন

 


সোভিয়েত আমলে ভিন্ন মতের কদর ছিল না, তাই পছন্দ না হলেও সরকার বা পার্টির বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলত না। তবে নতুন রাশিয়ায় সে সমস্যা নেই। ফলে সরকারের সমালোচনা হরহামেশাই হয়। বিশেষ করে সৃজনশীল মানুষদের আড্ডায়, কেননা তারা সব সময়ই অতৃপ্ত। আমার মেলামেশা যেহেতু মূলত বিজ্ঞানীদের আর ফটোগ্রাফারদের সাথে তাই সেটা বেশ টের পাই। আমার ভূমিকা এসব আলোচনায় অনেকটা প্যাসিভ, কারণ এরা কেউ হয় অতি ভক্ত অথবা অতি শত্রু। আর আমি চেষ্টা করি ব্যক্তিগত ভালোলাগা মন্দলাগায় না গিয়ে কোন ইস্যু ভিত্তিতে সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা বিচার করতে। গত বৃহস্পতিবার বরাবরের মত ফটো ক্লাবে ঢুকলাম।

- প্রিভিয়েত বিজন!
- প্রিভিয়েত!
- কী খবর?
- চলছে।
- ভ্যাকসিন নিয়েছিস?
- আমি তো অসুস্থ ছিলাম। আরও কিছুদিন পরে অ্যান্টিবডি টেস্ট করাব। তারপর যদি ডাক্তার বলে ভ্যাকসিন নেব।
- ভয় পাস না?
- দেখ, আমি তো মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েই জন্মেছি। সেটা জেনেও তো জীবন উপভোগ করছি। তাহলে?
- না, মানে ভ্যাক্সিনে এত বেশি রাজনীতি!
- সেটা ঠিক। এখানে রাজনীতি, অর্থনীতি সব একাকার। তবে আমি তো এ দেশেরই বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী সমাজটা ভেতর থেকে জানি। তাই ভয় পাই না।
- ঠিক বুঝলাম না।
- দেখ, ভ্যাক্সিনটা যদি রাজনীতিবিদরা তৈরি করত তাহলে হয়তো ভয় পেতাম। যারা তৈরি করেছে তারা নামকরা বিজ্ঞানী। রাস্তা থেকে ধরে আনা কেউ না। দীর্ঘ সময় সাফল্যের সাথে কাজ করে তারা আজ এই পর্যায়ে এসেছেন। বিজ্ঞানীরা তাদের কষ্টার্জিত সুনাম রক্ষা করার ব্যাপারে খুবই নিষ্ঠাবান। নিজেকে, নিজের কলিগদের দেখে জানি। কোন রেজাল্ট প্রকাশ করার আগে চুলচেরা বিশ্লেষণ করি, বার বার পরীক্ষা করে দেখি কোন ভুল হল কি না। তাই বিজ্ঞানীরা যেহেতু ভ্যাক্সিন তৈরি করে আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন, তাতে তাঁদের অবিশ্বাস করার কারণ দেখি না।
- কিন্তু অনেক ভ্যাক্সিন নিয়ে মানুষ তো মারাও যাচ্ছে। আস্ট্রজেনিকা নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে।
- সবাই তো মারা যায়নি। কিছু মানুষ। সব ওষুধ তো সব মানুষের স্যুট করে না। কারও এলার্জি থাকতে পারে। হয়তো যে সব লোক মারা গেছে, তাদের এই ভ্যাক্সিন দেওয়া ঠিক হয়নি। সব ওষুধের সাইড এফেক্ট থাকে। এই এফেক্ট ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। তাই বেশির ভাগ মানুষ যখন উপকার পাচ্ছে, তাই শুধু রাজনীতি বলে এটা সরিয়ে রাখা ঠিক না।
- ভ্যাক্সিন নিলেও তো অনেকেই অসুস্থ হয়।
- দেখ, এটা অনেকটা জন্ম নিয়ন্ত্রণের মত। জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষেধক ব্যবহার করলে সন্তান হবার বা অসুস্থ হবার সম্ভাবনা কম থাকে, কিন্তু তাতে তো ১০০% গ্যারান্টি নেই। কয়েকদিন আগে একজন বাংলাদেশের ডাক্তার এটাকে সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সীট বেল্ট ব্যবহার করা না করার উপর কিন্তু দুর্ঘটনার পরিমাণ নির্ভর করে না, এতে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে না। তবে সীট বেল্ট দুর্ঘটনায় বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ায়। ভ্যাক্সিনও তাই। ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরেও কেউ কেউ আক্রান্ত হতে পারে, তবে বিরাট সম্ভাবনা আছে যে অসুখটা হবে লাইট ফর্মে, অসুস্থ হলেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আমি নিজে অসুস্থ ছিলাম, হাসপাতালে ছিলাম। অবস্থা খুব জটিল না হলেও করোনা পরবর্তী ছোটখাটো জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাই ভ্যাক্সিন নেওয়াটাই মনে হয় ভালো। এর একটা সাইকোলজিক্যাল দিকও আছে। ভ্যাক্সিন নিয়ে মানুষ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যতটা আত্মবিশ্বাস পায়, ভ্যাক্সিন না নিয়ে ততটা পায় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভ্যাক্সিন নেওয়া মানেই করোনার হাত থেকে রেহাই পাওয়া নয়, তাই সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে। ছোটবেলায় বিশাল বাঁশ ঝাড় বা তেঁতুল গাছের নীচ দিয়ে একা যেতে যখন ভয় পেতাম, অনেক সময় হয় তুলসী পাতা পকেটে রাখতাম নয়তো রাম নাম নিতাম। ভূতে ধরেনি কারণ ভূত নেই। কিন্তু ওই বয়সে, যখন ভূতেরা বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াত, এসব মনে সাহস দিত। সেক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন শুধু সাইকোলজিক্যাল নয়, বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত প্রতিষেধক। তবে একটা জিনিস গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি - ভ্যাক্সিন নিই বা নাই নিই - আমরা সবাই মরব - দু' দিন আগে আর দু' দিন পরে।

দুবনা, ০১ মে ২০২১



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি