রাজনীতির আজকাল

 

কয়েক দিন আগে পশ্চিম বঙ্গে নির্বাচন শেষ হল। এবার যেভাবে নাটক জমেছিল, সেটা আর কখনও হয়েছে বলে জানা নেই। ব্যক্তিগত ভাবে কখনই এসব নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ ছিল না। ১৯৬৯ আর ১৯৭২ সালে যখন কোলকাতা যাই, ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। খুব সম্ভব সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপরে গেছি ১৯৮০, ১৯৮৯ আর ১৯৯৭ সালে - জ্যোতি বসুর রাজত্বকালে। সিপিএম দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল, তাই তৃণমূলের কাছে এর পরাজয় ছিল অপ্রত্যাশিত। ২০১৪ সালে চলছে মমতার যুগ। তখন কোলকাতা একেবারে অন্যরকম। এর আগে অনেক সময় রাস্তায় দেখেছি গাদাগাদি করে মানুষ ঘুমুতে। রাতের ফুটপাত ছিল চলাচলের অযোগ্য। মমতা রাজে সেটা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দিকে দিকে ফ্লাই ওভার তৈরির হিড়িক। তবে সব আমলেই ছিল ক্ষমতাসীন দলের পাণ্ডাদের দৌরাত্ম্য। এটা মনে হয় সব দেশের না হলেও আমাদের সব দেশের বৈশিষ্ট্য। এবার অবশ্য পশ্চিম বঙ্গের  নির্বাচনের দিকে নজর দেওয়ার মূল কারণ ছিল এ রাজ্যে বিজেপির উত্থান। যেকোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি, তা সে যত মহান উদ্দেশ্য নিয়েই আসুক না কেন পরিণামে কোন বহুজাতিক ও বহু ধর্মীয় সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে সেটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। সমাজের একটা অংশকে অনবরত অসন্তোষের মধ্যে রেখে শান্তি আনা যায় না। সাময়িক ভাবে সেটা হয়তো সমাজের একটা অংশকে খুশি করে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সমাজে যে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি হয়, যে অসুস্থ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাতাবরণ জন্ম নেয় সেটা যুগ যুগ ধরে সেই দেশ, সেই সমাজকে তাড়া করে বেড়ায়। একদিন হয়তো সংখ্যালঘু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু সেই বিষাক্ত পরিবেশ থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। পাকিস্তান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। ১৯৯৬ সালে রাশিয়াতে যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় - তখন প্রথম শুনি দুই খারাপের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত কম খারাপকে বেছে নেওয়ার আহ্বান। মন্দের ভাল যাকে বলে। এর পর থেকে দেশে দেশে সেটাই দেখা যাচ্ছে। আমেরিকাও বাদ যায়নি। আগে যেখানে বিভিন্ন দল বা ব্যক্তি নিজেদের শক্তির কথা বলে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, এখন প্রায় সব দেশেই নির্বাচনী প্রচারের মূল পয়েন্ট হয় প্রতিপক্ষের দুর্বলতা। আমি ভাল নই, তবে ও আরও খারাপ - এটা প্রমাণ করাই যেন আজকের দিনের নির্বাচনের মূল মন্ত্র। আমি ভাল নই এটা তারা বিনয় থেকে বলছে না, এটাই বর্তমান রাজনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি। আর এটা করতে গিয়ে রাজনীতিকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এর সাথে যোগ হয় ধর্ম আর আঞ্চলিকতা। ফলে মানুষ, মানুষের ভাল মন্দের কথা হারিয়ে যায় নির্বাচনী প্রচার থেকে। 

এক দিকে দেশে দেশে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে, ফরমালি অনেক দেশে গণতন্ত্র আছেও, কিন্তু বাস্তবে দেশে দেশে মানুষ হারাচ্ছে তার স্বাধীনতা। সে হচ্ছে বড় বড় মিডিয়া আর কোম্পানীর কাছে জিম্মি।  এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রথম শ্রেনীর গণতান্ত্রিক দেশেও ভিন্ন মতকে ট্রল করে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্র বা অন্যান্য ব্যাপারগুলো আজ ডগমায় পরিণত হচ্ছে। দেশে দেশে বামেরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। কেন? ভারতবর্ষে প্রথম নাম আন্দোলন গড়ে ওঠে বিপ্লবীদের হাত ধরে। সে সময় রাজনীতিতে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন মূলত ব্রিটেনে পড়াশুনা করা যুবকেরা, যারা সেখানে গিয়ে, সেখানকার সমাজ দেখে বুঝতে পারেন ভারতেও জনগণের জন্য এমন একটা সমাজ তৈরি করা যায়। সেখান থেকে জন্ম নেয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, জন্ম নেয় জাতীয় আন্দোলন - অহিংস, সহিংস সব ধরণের। আর এই বিপ্লবীদের এক অংশ দেশে গড়ে তোলে বাম আন্দোলন। সে সময় অধিকাংশ নেতা কর্মী ছিলেন ত্যাগী।  তারা পাওয়ার জন্য নয়, দেশকে, দেশের মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্য রাজনীতি করতেন। এদের অনেকে নিজেদের ক্যারিয়ার উপেক্ষা করে রাজনীতি করতেন। এসব আমাদের দেশের সত্তরের আর আশির দশকের বাম রাজনীতিতেও চোখে পড়ত। এরপরে আসে ভোগবাদী আদর্শ।   ভোগের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ ত্যাগের কথা শুনতে চায় না। সবাই শুধু নিতে চায়, দিতে চায়না কিছুই। আর এই মানসিকতা নিয়ে যারা রাজনীতি করতে আসে তারা সমাজকে কী দেবে, যদি নেওয়াটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা মনে পড়ে। তখন অনেকেই পার্টি করত শুধু মাত্র সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করার জন্য। এতে অবশ্য পুরোপুরি এদের দোষ দেওয়া যায় না। তখন পার্টি মেম্বার না হলে কোথাও উন্নতি করা যেত না, এমনকি প্রচণ্ড প্রতিভাবান লোকেরা পর্যন্ত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে পারতেন না শুধুমাত্র পার্টি মেম্বার না হবার ফলে। এখন এসব আমরা দেখি বিভিন্ন দেশে - উন্নতি করতে চাও, সমস্যা ছাড়া কাজ করতে চাও? সরকারি দল কর। তাই সব দেশের সরকারি দলে যখন লাখ লাখ বসন্তের কোকিল এসে জড়ো হয়, এটা শুধু মানুষের দোষ নয়, সিস্টেমই এমন। আর এই সিস্টেম ভোগবাদের উপর গড়ে ওঠা সমাজ।  সিস্টেম যদি চাকরির ক্ষেত্রে মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি না মেলাত, হয়তো এমনটা হত না। বর্তমানে ভোগবাদী আদর্শই মনে হয় বামদের থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেবার অন্যতম প্রধান কারণ।  তাছাড়া ভোগবাদী সমাজ সব সময় সরকারের কাছ থেকে কিছু একটা আশা করে। তারা আশা করে অপেক্ষাকৃত অল্প পরিশ্রমে ভাল বেতন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধ্যাতীত সুযোগ সুবিধা। আর এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জনগণের সামনে বিভিন্ন ধরণের মূলা ঝুলাতে বাধ্য হয়, মানে অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দেয়, দিতে বাধ্য হয়। ফাইনানশিয়াল ক্যাপিটালের মত বর্তমানের রাজনীতি গড়ে উঠছে পিরামিডের মত। সবাই যে যেভাবে পারছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আর পিরামিডের মতই কিছু লোক এসবের ফল ভোগ করছে। রাজনীতি হয়ে উঠছে ধর্মের মতই। ধর্ম মৃত্যুর পরে স্বর্গ সুখের প্রতিশ্রুতি দেয়, এরা স্বপ্ন দেখায় ইহলোকেই স্বর্গ সুখের। তবে কম লোকই যেমন স্বর্গের ভিসা পায় এ জগতেও খুব কম লোকই সেই স্বর্গ সুখ পায়। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বীরদর্পে পৃথিবীতে পদচারণা করছিল, তখন সারা বিশ্ব ছিল দুই ক্যাম্পে বিভক্ত। বর্তমানে হাতে গণা কয়েকটি দেশ বাদ দিকে প্রায় সর্বত্রই বাম রাজনীতির মন্দা চলছে। শুধু তাই নয়, শুরু হয়েছে নতুন মেরুকরণ। সেটা ধর্ম, আঞ্চলিকতা, ভাষা বিভিন্ন ধারণার উপরে ভিত্তি করে আসছে। কিন্তু সমস্যা হল - এসব ধারণাকে ব্যবহার করা হচ্ছে ডগমা হিসেবে, ফলে এতে যত না পজিটিভ তার চেয়ে বেশি নেগেটিভ এলিমেন্ট চলে আসছে। বিরোধী দল বলতে কিছুই থাকছে না আর যেখানে আছে সেখানে দুই মেরুর মাঝামাঝি কিছুই থাকছে না। ফলে পালটে গেছে রাজনৈতিক পরিবেশ। পশ্চিম বঙ্গ সহ বিভিন্ন দেশে আজ যে রাজনৈতিক অরাজকতা সেটা নতুন বিশ্ব বাদের ফল, যার নাম ভোগবাদ। 

দুবনা,  ০৮ মে ২০২১ 





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি