ফোনালাপ

হ্যালো! কাকু?
----
জানেনই তো আমার খারাপ থাকবার সময়, সুযোগ, সামর্থ্য - এসব কখনই ছিল না। বলতে পারেন আমার অবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নের মাংসের দোকানের মত। কোন অপশন নেই। তাই ভালই থাকি। ভাল থাকতে হয়। জানেন আজকাল রুশরা কি বলে? "বেঁচে থাকা ভাল, তবে ভালভাবে বেঁচে থাকা আরও ভাল" এটাকে নতুন আঙ্গিকে বলে "বেঁচে থাকা ভাল, তবে ভালভাবে বেঁচে থাকা খুব কঠিন।" তাই বলতে পারেন আমরা কঠিন রকমের ভাল আছি।
----

কি বললেন? আপনাকে আমি শুনতে পারছি না। লাইনে মনে হয় ডিস্টার্ব। যাহোক, আমি তো জানি আপনি কী জানতে চান, বলে যাচ্ছি। রেকর্ড করছি। যদি সব শুনতে না পারেন, জানাবেন, পরে ই-মেইল করে পাঠিয়ে দেব। 

----

ও, সেই লেখাটা? একাত্তরের উপরে? আপনি যেটা বই করতে বলেছিলেন? হ্যাঁ, লেখা শেষ করেছি তাও কয়েক বছর। না, প্রকাশ করা হয়নি। কেউ প্রকাশ করতে চায় না। পাণ্ডুলিপি দেখে পরে কিছু বলে না। না না, আমি কিন্তু বই প্রকাশ করব বলে আপনাকে কথা দিইনি, লিখব বলেছিলাম। লিখেছি। সুতরাং আমার সোবেস্ত চিস্তা, মানে বিবেকের কাছে আমি শীতের তুষারের মতই পরিষ্কার। আপনাকে বলা হয়নি, আমি করোনায় ভুগে হাসপাতালে ছিলাম, সে এক লাইফ টাইম অভিজ্ঞতা। এখনও প্রি-করোনা ফর্ম ফিরে পাইনি। সবাই বলছে করোনার পরে নাকি জগতটাই বদলে যাবে, তাহলে আপনিই বলুন আমি কীভাবে আগের ফর্মে ফিরব?   

----

ছেলেমেয়েরা? সবাই ভালই আছে। বড় হয়ে গেছে। অনেক সময় মনে হয় ওরাই আমার অভিভাবক। আমার ভালই লাগে। সারা জীবন ছোট থাকার মজাই আলাদা। আপনার মনে আছে মস্কোয় আমরা দু' জনে কখনও কখনও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতাম। কথার অনেকটাই জুড়ে থাকত দেশভাগ। ইদানিং দেশভাগের উপর বেশ কিছু বই পড়লাম। ইতিহাস, সাহিত্য। আপনার বন্ধুর আগুনপাখি পড়লাম, নীলকন্ঠ পাখি খোঁজে পড়ছি এখন। আরও বেশকিছু বই যোগাড় করেছি সেই সময়ের উপর। আমার একসময় মনে হয় দেশভাগ অবশ্যাম্ভাবী ছিল না। এটা ছিল স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার খেলা। এখন সন্দেহ জাগছে। শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতির হাত ধরে সমাজ ছিল দ্বিধাবিভক্ত। শুধু ধর্ম নয়, ছিল মধ্যবিত্তের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। যদিও একসময় আলাদা বাংলার দাবী উঠেছিল, তবে সেটার ভাগ্যও পাকিস্তানের মত হত কিনা বলা কষ্ট। কারণ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল চরম অবিশ্বাস। বাংলা ভাগের পরে যখন হিন্দু উচ্চবিত্তের পশ্চিম বঙ্গে চলে যাবার সুযোগ ছিল, কিন্তু অবিভক্ত বাংলায় তার সে সুযোগ ছিল না। আর দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অবিশ্বাস, যে টেনশন ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছিল - শুধু ক্ষমতা নয় (রাজনৈতিক ক্ষমতা তখন মুসলিম লীগের হাতেই ছিল), অর্থনৈতিক ও চাকরির ক্ষেত্রেও একটা বিরাট ধরণের রিসাফল ঘটত। এটা যদি গৃহ যুদ্ধে পরিণত হত অবাক হবার কিছু ছিল না। তবে তখন বাবুদের যাবার কোন জায়গা থাকত না। ভারত বাঙালিদের গ্রহণ করত না। বাঙালি হিন্দুদের একটাই অপশন - ভারতেই হোক আর পাকিস্তানেই হোক দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ হয়ে থাকা। হতে পারে এটা অন্যভাবে যেত। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু মুসলমান শুধু বাঙালি হয়েই থাকত। তবে এসব লেখা পড়ে তখনকার যে সামাজিক চিত্র পাই,  তাতে সেই সম্ভাবনা কম ছিল।       

----

কাজকর্ম? চলছে। লেখালেখি টুকটাক করি। আসলে কথা বলার লোক তো কম। ফেসবুক সে অর্থে ভাল সার্ভিস দিচ্ছে। শুনেছি জাপানে নাকি অফিসের সামনে বসের একটা পাপেট থাকে। অসন্তুষ্ট কর্মচারী সেই পুতুলে চড় থাপড় দিয়ে মনের ক্ষোভ কমায়। আমার এখানে  কাজের মানে ফিজিক্সের উপর কথা বলার লোকের লোকের অভাব নেই, তবে আমাদের দেশের, সমাজের ব্যাপার নিয়ে কথা বলার মানুষ নেই। তাই ফেসবুকেই মনের ঝাল মেটাই। সবাই আজকাল ব্যস্ত। অধিকাংশ লোকই আজকাল নিরপেক্ষ ভাবে কোন ঘটনার বিচার করতে চায় না। ভোগবাদী আদর্শ আমাদের মানসিক ভাবেও কোন না কোন দলের, কোন না কোন আদর্শের (?) প্রতি অন্ধ করে তুলেছে। সত্যটাও আজ আর দল নিরপেক্ষ, জোট নিরপেক্ষ, স্বার্থ নিরপেক্ষ নেই। তাই অন্যদের সাথে যোগাযোগ তেমন নেই।

---- 

ববি? ভাল আছে। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার দস্তয়েভস্কি সংখ্যা বের করছে। জানেন তো দস্তয়েভস্কি আমার প্রিয় লেখক। চেষ্টা করছি ওই পত্রিকার জন্য কিছু লিখতে। দেখি কী দাঁড়ায়। 

---- 

ও, আপনার তো রেস্ট নেবার সময় হয়ে গেল। আপনার সাথে মনে মনে প্রায়ই কথা বলি। দুবনায় তো বন, নদী এসবের অভাব নেই। আপনি একবার আসবেন বলেও আসতে পারলেন না। নেক্সট টাইম। জন্মদিনের এই একটা সুবিধা। এই অজুহাতে প্রিয় মানুষদের ফোন করা যায়। কেউ কেউ অবশ্য ফোন করতে মানা করে। আপনি সেটা করবেন না বলেই তো আপনাকে ফোন করি। আর কী? আবার এক বছর অপেক্ষা। রাখছি। চিয়ার্স!

দুবনা, ২৯ মে ২০২১   






Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি