ভালবাসা

শৃঙ্খলা আমার কাছে শৃঙ্খলের মত মনে হয়, তাই সারা জীবন ওটাকে এড়িয়ে চলতে চাই। স্কুলে প্রায়ই দেরি করে যেতাম, কলেজেও তাই। ভার্সিটিতে কত ক্লাস যে ফাঁকি দিয়েছি তার হিসেব কে রাখে। মনে আছে, একবার রুশ ভাষার ক্লাস শেষ হবার মিনিট দশেক আগে ক্লাসে ঢুকলে ম্যাডাম বললেন "না এলেই তো হত"। আমি বললাম, "হত, তবে পরের ক্লাসটা যাতে মিস না করি তাই এলাম।" উনি খুব মাইন্ড করেছিলেন। ভাগ্যিস পড়েছিলাম তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় আর কাজ পেয়েছিলাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটে যেখানে কিছুই রুটিন মেনে করতে হয়না। এক্ষেত্রে আমার অবশ্য বেশ কিছু সাথী আছে। সেটা হল রুশ দেশের ঋতু। বিশেষ করে বসন্ত। সরকারি ভাবে মার্চের ১ তারিখে কাজে জয়েন করার কথা থাকলেও ও শুরু করে মে মাসে। তবে মের বসন্ত আমাকে দেশের মার্চের কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন সবে পাতা গজানো গাছের উপর বসন্ত বাতাস হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার কানে ভেসে আসে চৈত্রের দুপুরে বাঁশ ঝাড়ের শব্দ। শন শন শন শন - শো শো শো শো। আমি কান পেতে রই। মনে হয় আমি যেন বাড়ির বারান্দায় বসে আছি আর চৈত্রের বাতাস কালবোশেখির রিহার্সাল দিচ্ছে। আবার যখন ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামে আমি চলে যাই আষাঢ়ে। ঝরছে তো ঝরছেই। আর যদি দৈবক্রমে এ সময় ভোলগার তীরে থাকি মনে মনে গেয়ে উঠি "ভরা ভাদরের ভরা নদী"। আবার কোন কোন দিন হুট করে ঠাণ্ডা নেমে আসে আকাশ থেকে। তখন মনে হয় বসন্ত পথ হারিয়ে শীতের দেশে চলে এসেছে। চেরিওমুখা ফুটতে শুরু করে তখন। চারিদিকে মন মাতাল করা গন্ধ। আবার বলা নেই কয়া নেই চলে আসে গ্রীষ্ম। লোকজন নেমে পড়ে রৌদ্র স্নানে। আমিও ভাবি ভোলগায় সাঁতার কাটার কথা। সাহস পাইনা। জলের তাপমাত্রা মাত্র ১৪ ডিগ্রী। তবে তখন বন জেগে ওঠে। ফুলে ফুলে ভরে যায় চারিদিক। সাদা, হলুদ, নীল। ছোট বড় সব ধরণের গাছে। লাইলাক পথের দুপাশে স্বাগত জানায়। আপেল গাছ ভরে যায় ফুলে ফুলে। এসব অবশ্য নতুন নয়। তবে মনে হয় এই প্রথম এভাবে দেখছি। এর আগে যখন সবাই মিলে দুবনা ছিলাম সারা দিন চলে যেত বাচ্চাদের নিয়ে স্কুল স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করে। পরে ওরা মস্কো চলে গেলে আমি ঘুরতাম আমার মত। তিন বছর আগে গুলিয়া দুবনা এলেও একসাথে থাকতে শুরু করেছি বছর দেড়েক। করোনা কারণে অনেক সময় বাড়িতে কাটে, প্রায়ই এক সাথে ঘুরতে যাই এদিক সেদিক। গত পঁচিশ বছরে দুবনার যেসব জায়গায় যাওয়া হয়নি, এখন সেসব জায়গা ঘুরে বেড়াই। নতুন করে দুবনা চিনি, একে অন্যেকে চিনি। ইদানীং আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুরা আমার ছবি দেখে হতাশ। একই গাছাপালা, একই নদী কত আর তোলা যায়। আমি ওদের বোঝাতে পারি না এক নদীতে যেমন দুইবার নামা যায় না, একই জায়গায়ও তেমনি দুইবার যাওয়া যায় না। আমরা ছবি তুলি তো ভালবেসে। ভালবাসার, ভাললাগার ছবি তুলি। পৃথিবীর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি আরও বেশি করে।

দুবনা, ২২ মে ২০২১ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি