যুদ্ধ

উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন, যুদ্ধ যুদ্ধই। সেখানে অনেক নিরপরাধ মানুষ মারা যায়। তবে অনেক সময় যুদ্ধটাই শান্তির জন্য পথ করে দিতে পারে। বিগত আট বছরে দনবাসকে ঘিরে এমন একটা স্থবির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে কোন পক্ষ থেকে এক ধরণের ইনিশিয়েটিভ দরকার ছিল। 

যদি শান্তিকামী যেকোনো মানুষের পক্ষ থেকে দেখি বা ইউক্রাইনের পক্ষ থেকে দেখি তাহলে এই আক্রমণ গ্রহণযোগ্য নয়। আবার যদি দনবাসের মানুষের পক্ষ থেকে দেখি তাহলে তাহলে এই যুদ্ধ তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করেছিল ভারত কখন যুদ্ধে নামবে। আমরা আজ যারা ইউক্রাইনের শিশুদের নিয়ে চিন্তিত তারা যদি একই ভাবে দনবাসের শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হত ঘটনা এতদূর নাও যেতে পারত। শিশুদের জাত নেই, দল নেই। এদের নিয়ে রাজনীতি করা গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের প্রহসন। এই আমেরিকা ১৯৭১ সালে লাখ লাখ হতভাগা মানুষকে দেখতে পায়নি যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এই সব নরপিশাচরা আমেরিকার প্রসন্ন দৃষ্টি এড়ায়নি।

সিনেমা থেকে যেটুকু জানি মাফিয়ারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে এলাকা ভাগ করে নেয়। ফলে নিজেরা যেমন মারামারি করে মরে না, একই ভাবে সাধারণ মানুষও স্বস্তিতে থাকে, যদিও এই শান্তির জন্য তাদের কিছু কিছু স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হয়। 

আচ্ছা, এই যে ন্যাটোর সদস্যরা নিজেদের স্বাধীন মনে করে তারা কি সত্যই তাই? তাদের কিন্তু এমনকি নিজেদের অস্ত্র তৈরির কারখানা থাকলেও আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানির অস্ত্র কিনতে হয়। মানে সব দেশই কোন না কোন ভাবে নিজেদের স্বাধীনতায় কিছুটা হলেও ছাড় দেয়। ১৯৯১ এর পরে ন্যাটোর কি আদৌ দরকার ছিল? কমন সেন্স বলে - না। দরকার ছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সেটাকে টিকিয়ে রেখে অস্ত্র বিক্রি করার। আমেরিকার মানুষ যখন নিজেদের দেশে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিবাদ করে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিবাদ করা উচিৎ। পৃথিবী এখন অনেক ছোট গেছে। তাই যেকোনো যুদ্ধের আঘাত কোন না কোন ভাবে সেখানেও লাগবে।

এই যুদ্ধে কে কতটা দায়ী সেটা খুঁজে লাভ নেই। রাজনীতিবিদরা আর মিডিয়া মিলে ইচ্ছাকৃত ভাবে এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে মূলত নর্থ স্ট্রীমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য। যারা বলেন ইউক্রাইন যার সাথে খুশি তার সাথে যাবে তারা কি ভাবেন তাহলে একই ভাবে বলা চলে জার্মানি যার কাছ থেকে খুশি তার কাছ থেকে গ্যাস কিনবে? যেকোনো মানুষই নিজের পক্ষে যুক্তি বের করতে পারে কিন্তু সে যদি অন্যের যুক্তি মানতে না চায় তাহলে চলবে কেমনে? জীবনটাই তো এক ধরণের সমঝোতা। মাছ কিনতে গেলে জেলের সাথে দামের ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে হবে, চাকরি করতে গেলে বেতনের ব্যাপারে। আমরা যদি অন্যের সাথে সমঝোতা ছাড়া দুই পা-ও এগুতে না পারি - তাহলে যেখানে লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত সে ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে পারি না কেন? ১৯৯১ থেকে সমস্ত ভোট দেখায় ইউক্রাইন দুই ভাগে বিভক্ত। বিভক্ত রাশিয়া আর পশ্চিমের প্রশ্নে, বিভক্ত সোভিয়েত উত্তরাধিকার প্রশ্নে, বিভক্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ের প্রশ্নে, বিভক্ত কারা সত্যিকারের হিরো আর কারা হিটলারের অনুসারী তাদের প্রশ্নে। এই দুই অংশের উপর কী রুশ পন্থা কী পশ্চিমা পন্থা - জোর করে আরোপ করা মানেই গৃহ যুদ্ধ লাগানো। আর এ থেকে বেরুনোর পথ এই দেশকে নিউট্রাল রাখা যেমন ফিনল্যান্ড। তাতে ইউক্রাইন যেমন লাভবান হবে তেমনি ইউরোপে উত্তেজনা কমবে।

যদি আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব সত্যিকার অর্থেই ইউক্রাইনের মানুষের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত হয় (তারা এতদিন সেটা ছিল না, তাদের লক্ষ্য এই দেশকে রাশিয়ার বিপক্ষে দাড় করানো) তাহলে এই যুদ্ধ বন্ধ করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার বলে মনে হয়। পশ্চিমা মিডিয়া আর আমেরিকা ও ব্রিটিশ সরকার বলতে গেলে বাধ্য করেছে রাশিয়াকে যুদ্ধে নামতে (যেটা আমার মতে রাশিয়ার এক ধরণের পরাজয়) এখন তাদের উচিৎ সেটা বন্ধের জন্য এম্বারগো নয়, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। অবশ্য যদি বুদ্ধি বলে কোন বস্তু এদের মাথায় থাকে।

দুবনা, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা