বিচার
গতকাল থেকে ফেসবুকে অনেকেই তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে লিখছে। আমি তার ফ্যান নই। 
তিনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড নন। আমি তার ফলোয়ারও নই। তাই তার লেখা বা তার 
সম্পর্কে লেখা আসে বন্ধুদের মাধ্যমে। আমার টাইম লাইনে আবার খুব কম সংখ্যক 
মানুষের স্ট্যাটাস আসে। সবার লেখা দেখার সময় আমার নেই। যাদের লেখা পছন্দ 
করি, যাদের বিশ্বাস করি তাদের লেখাই শুধু এখানে আসে। সেখান থেকে কিছু লেখা 
বেঁছে বেঁছে আমি প্রতিদিন পড়ি। নিজেও লিখি। তবে সেটা মূলত অন্যদের জানাতে 
যে আমি এখনও বেঁচে বর্তে আছি, তাই তাদের এখনও আমাকে শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে 
নিজেদের স্বস্তি লাভের কিছু নেই। যাহোক, যতদূর
 জানি তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে  ভাল মন্দ দু' ধরণের লেখাই নেটে ঘোরাফেরা করে। তবে আমার এখানে যা আসে 
সেগুলো মূলত তাকে সমর্থন করে, এমনকি কিছু কিছু লেখা তো তাকে রীতিমত বন্দনা 
করে। তাই গতকাল যখন একটু বিপরীত স্রোত দেখলাম, অবাক হলাম। সেখানে অবশ্য কোন
 লেখার কারণে জাহাজে বিদ্রোহ তার উল্লেখ ছিল, ছিল লিংক। সেটা পড়ে ব্যাপারটা
 বুঝলাম। নিজেরও এ ব্যাপারে দু' কথা বলার সাধ সামলাতে পারলাম না। 
আগেই
 বলেছি আমি তার লেখার ভক্ত নই। হাতে যেটুকু সময় থাকে চেষ্টা করি সেই লেখাই 
পড়তে যা আমাকে কোন না কোন ভাবে সমৃদ্ধ করে। সেটা হতে পারে ভাষা বা ভাষার 
ব্যবহার শেখায়, ভাবতে শেখায়। এক কথায় লেখাটা যেন শিক্ষামুলক হয়। আরও কিছু 
লেখা পড়ি - যদি তা সোভিয়েত ইউনিয়নে আমাদের দিনকাল নিয়ে হয়। সেটা অবশ্য 
নস্টালজিয়া থেকে। তসলিমা নাসরিনের লেখায় ওনার নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা, 
ওনার নিজের ভাল মন্দের উপস্থিতি খুব বেশি, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে যেসব 
স্ট্যাটাস আসে। অনেকটা ডাইরির মত। সেখানে মাঝেমধ্যে চিন্তার খোঁড়াক থাকলেও 
অপ্রাসঙ্গিক কথা অনেক। অন্তত আমার জন্যে। তারপরেও কখনও সখনও পড়ি। এভাবেই 
তার লজ্জা পড়া। নিঃসন্দেহে সেটা দেশের সামাজিক চিত্রের একটা অমূল্য দলিল। এ ঘটনা 
অহরহ ঘটছে। তবে আমার চোখে সেটা কালজয়ী মনে হয়নি, ইস্যু ভিত্তিক বলেই বেশি 
মনে হয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটা আমার চোখে লেগেছে, তা হল সেখানে তিনি 
মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা তিন লাখ বলে উল্লেখ করেছেন। আমি তার ঘনিষ্ঠ, 
তার লেখা পড়ে এমন অনেককে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাইনি। ফলে 
সংগ্রহে তার অনেক বই থাকার পরেও পড়া হয়নি। 
ছাত্রজীবনে একটা গল্প 
শুনেছিলাম এক বন্ধুর মুখে, বিভিন্ন সময়ে সেটা বলেছি,  আমার বিভিন্ন লেখায় 
তার উল্লেখ আছে। তাই সংক্ষেপে বলছি। একজন স্বনামধন্য আর্টিস্ট যখন জানতে 
পারেন যে তার একইরকম বিখ্যাত এক লেখক বন্ধু হোমোসেক্সুয়াল, তিনি বন্ধুর 
সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। অনেক পরে তাদের দেখা হলে লেখক বলেন, দেখ, আমি 
সন্তানের পিতা, একজন স্বামী, একজন লেখক। হাজারটা আমার পরিচয়। অথচ তুমি একটা
 মাত্র পরিচয়ে আমাকে ত্যাগ করলে। আসলে সব মানুষই ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে। কারও 
সব যে আমার ভাল লাগবে তার কোন মানে নেই। যে গায়ক তাকে আমি গানের জন্যই 
ভালবাসি, সে কেমন প্রেমিক সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমরা আসলে 
নিজেরাই আমাদের কোন কারণে ভালোলাগার মানুষগুলোকে দেবতার আসনে বসাই আর যখনই 
তাদের কোন ব্যাপারে স্খলন (সেটাও আমাদের দৃষ্টিতে) ঘটে আমরা রে রে করে তেড়ে
 যাই তার দিকে। আমরা ভুলে যাই, সেই লোকের নিজেরও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, 
আছে ভালোলাগা, মন্দলাগা, আছে নিজের মত করে কোন ব্যাপারে মত প্রকাশের 
অধিকার। একজন লোক প্রচণ্ড খারাপ হতেই পারে, কিন্তু সে যদি কোন ভাল কাজ করে 
আর কেউ সেটা নিয়ে লেখে সমস্যা কোথায়? এই যে আমরা সব সময় আমাদের মতকে অন্যের
 ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাই সেটাই কি মৌলবাদ নয়? আমি কাউকে প্রশংসা করলেই আমাকে 
কারও কাছ থেকে টাকা নিতে হবে? তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে যে বা যারা এই 
অভিযোগ করেন তারা অন্যদের প্রশংসা করার জন্য টাকা বা অন্য কোন সুবিধা নেন? 
একজন লোকের তো এমনিতেও কারও কোন কাজ ভালো লাগতে পারে। জানি আপনাদের অনেক 
যুক্তি আছে, আপনারা হাজারটা যুক্তি দেখাতে পারবেন আপনাদের লেখার স্বপক্ষে। 
কিন্তু এটা কেন মানতে পারেন না যে তিনি এমনিতেই লিখছেন। আর যদি মানতে নাই 
পারেন তবে এত দিন কেন তাকে নিজেদের লেখায় দেবতার আসনে বসিয়েছেন? আসলে আমরাই 
আমাদের ভালোলাগার মানুষদের তা সে লেখক হোক, কবি হোক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব 
হোক, অতিরঞ্জিত ভাষায় বিশেষিত করে, তোষামোদ করে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসি 
যখন তারা মনে করেন তারা যা বলবেন সেটাই বেদবাক্য, সেটাই ঠিক। আর তখন আমরাই 
নিজেদের তৈরি ফ্রাঙ্কেন্সটাইনকে দোষারোপ করব সুবিধাবাদী বলে আর আমাদের 
ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ছাটাই করলে হাহুতাশ করব - কই আমি তো তাকে তেমন খারাপ 
কিছু বলিনি, অনেকেই আরও কঠিন ভাষায়, আরও খারাপ ভাষায় তাকে আক্রমণ করেছে। 
নিজের আগেবকে সংযত করুন, নিজের বিচারকে নিরপেক্ষ করুন - দেখবেন উঠতে বসতে 
এমন হতাশ হতে হবে না।  
দুবনা, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Comments
Post a Comment