রাজা

যদি ইউক্রাইন সম্পর্কে সত্য জানতে চান তাহলে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে নিন্দা করার সাথে সাথে কেন সেটা হল সেই প্রশ্ন করুন। ক্যারিবিয়ান ক্রাইসিস, রাশিয়ার দরজায় ন্যাটো এসব সবাই বলছে। কিছু দিন আগে রাশিয়া আমেরিকা ও ন্যাটোর কাছে কিছু দাবি জানায়। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইউক্রাইনকে ন্যাটোর সদস্য না করা কারণ এটা রাশিয়ার জন্য জীবন মরণ প্রশ্ন। আমেরিকা বা ন্যাটো এই দাবিতে কর্ণপাত করেনি। আর তখনই জানা ছিল ঘটনা এখানে শেষ হবে না। যদি এ নিয়ে আলোচনা করবে বলত, তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও শান্ত হত। আলোচনা করার অর্থ দাবি মানা নয়, তবে মানা হতে পারে সেই রকম আশ্বাস দেওয়া। সেটা না করে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রাইনে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। অবশ্য এটা তারা করছে কয়েক বছর ধরেই। আর প্রায় প্রতিদিনই একটার পর একটা আক্রমণের নতুন তারিখ দিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাইডেনের মুখ রক্ষার জন্য হলেও রাশিয়ার ইউক্রাইন আক্রমণ না করে উপায় ছিল না। এর মানে যুদ্ধটা রাশিয়ার চেয়ে পশ্চিমা বিশ্বের বেশি দরকার ছিল। তারা সেদিক থেকে সফল। একটু খেয়াল করলে দেখবেন এই নর্থ স্ট্রীম-২ কে কেন্দ্র করেই এত ঘটনা। জার্মানি যদি এটা চালু করার অনুমতি দিত ইউক্রাইন বুঝত যে রাশিয়াকে যুদ্ধে নামিয়ে আর লাভ হবে না। আবার জার্মানি অনুমতি দেবে না বললেও এই যুদ্ধ হত না। ইউক্রাইন আর আমেরিকা রাশিয়াকে যুদ্ধে নামিয়েছে নর্থ স্ট্রীম বন্ধ করার জন্যই। এক কথায় পশ্চিমা বিশ্ব আর ইউক্রাইন সব করেছে যাতে এই যুদ্ধ লাগে। 

এই রাজনীতিতে কেউই মানুষের কথা ভাবেনি। মানুষের কথা ভাবলে দনবাসের মানুষ ৮ বছর অনবরত গোলাগুলির মধ্যে জীবন কাটাত না। আমরা যখন ইউক্রাইনের স্বাধীন চয়েজের কথা বলি তখন কেন ভুলে যাই দনবাসের মানুষের কথা? দনবাসে কি শুধুই ভাষার সমস্যা? এখানকার কয়লার খনি অলিগারখদের দখলে যারা মানুষের জন্য গত ৩০ বছরে কিছুই করেনি। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভাষার উপর আঘাত সব মিলে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। এটা তাকে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করেছে। তার পরেও যুদ্ধ কারও কাম্য নয়। না ইউক্রাইনের মানুষের না দনবাসের মানুষের। কিন্তু এটা কি ওদের হাতে ছিল? ইউক্রাইনের ভাগ্য এমনকি ইউক্রাইন সরকারের হাতেও ছিল না। অনেক দিন সেখানে সব সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। আমেরিকা চাইলে এদেশের যেকোনো আমলাকে যেখানে খুশি বসাতে পারে। আর সে জন্যে অনেক সময় আমেরিকার স্বার্থ নয়, বাইডেনের পারিবারিক স্বার্থ কাজ করে। মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে তারা বাংলাদেশের এক মন্ত্রীকে সরাতে বলেছিল। সে মন্ত্রী ভালো হোক আর মন্দ হোক - কিন্তু এটা কি একটা স্বাধীন দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নয়। একই ঘটনা ঘটেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়। এটা এ জন্যেই বলা যে আমেরিকার স্বার্থ আর কোন দেশের জনগণের স্বার্থ এক নয়। এর সাথে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এসবের কোনই সম্পর্ক নেই।      

কিছু দিন আগেও পুতিন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, এখন তিনি নিন্দিত। নর্থ স্ট্রীম স্থগিত। দুই স্লাভিক জাতি পরস্পরের শত্রু। এতগুলো বিজয় একটা গুলি খরচ না করে। মানে আমেরিকা আবার যুদ্ধে জিতে গেল। এটা সেই গল্পের মত যখন এক উকিল অপেক্ষাকৃত গরীব ভাইকে ধনী ভাইয়ের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় মামলা করার জন্য। ফলে ধনী ভাইয়ের বাড়ির কিছু অংশ তো বটেই গরীব ভাইয়ের পুরো বাড়িটাই উকিলের হস্তগত হয়।
 
রাশিয়ার বিশেষজ্ঞরা কি এটা অনুমান করতে পারেননি? নিশ্চয়ই করেছেন। তবে? আমার ধারণা এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছিল যে রাশিয়া বাধ্য হয় এই অজনপ্রিয় পথে যেতে। যদিও ঐ সময় পশ্চিমা মাধ্যম প্রায় এক লাখ রুশ সৈন্যের উপস্থিতির কথা বলেছে সীমান্ত এলাকায় তারা দনবাসে ১২০ হাজার ইউক্রাইনিয়ান সৈন্যের উপস্থিতির কথা বলেনি। ইউক্রাইনের এই সৈন্যরা মিনস্ক চুক্তি ও যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে প্রায় প্রতিদিনই সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি আক্রমণ করছিল। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, তুরস্ক ইত্যাদি দেশ থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র তার এই রণাঙ্গনে জড় করে। এক কথায় অলআউট যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। হয়তোবা তাদের উপর ম্যাসিভ আক্রমণের খবর ছিল গোয়েন্দাদের কাছে আর এটাই রুশ আক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ পরে লাশের উপর কাঁদার চেয়ে আগে থেকে মানুষ বাঁচানোর ব্যবস্থা নেওয়া অনেক ভালো। তার একটা নৈতিক দিক থাকে। যুদ্ধ নৈতিক নয়, তবে সব নৈতিকতাই আপেক্ষিক। 

আবারও বলছি এটা শুধুই ধারণা। কিন্তু অবস্থা যে এরকম মোড় নেবে সেটা দু পক্ষই জানত। এম্বারগোর কথাও অজানা ছিল না। কথা হল রাশিয়া কি পারবে এই এম্বারগো কাটিয়ে উঠতে? ২০১৪ সালের চেয়ে রাশিয়ার সার্বিক অবস্থা এখন ভালো। ১৯৯০ দশকের অভাবী সময়, বিগত প্রায় ২০ বছর বিভিন্ন এম্বারগোর মধ্যে থেকে রাশিয়া অনেক বেশি প্রস্তুত। কিন্তু রাশিয়া যদি ইউরোপে তেল গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করে ১৯৪৫ সাল থেকে শান্তিতে আর আদরে বেড়ে ওঠা ইউরোপ কি পারবে সেটা কাটিয়ে উঠতে। আমেরিকা রাশিয়ার উপর ততটা নির্ভরশীল নয়। তাদের এম্বারগো নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে নয়। তারা কিন্তু রুশ আলুমিনিয়াম এই স্যাংসনে ফেলেনি। ইউরোপ এম্বারগো আরোপ করেছে আগে পিছে না ভেবেই। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে আকাশ সীমা বন্ধের রাজনীতি। রাশিয়ার আকাশ অনেক বড়। সেটা বিশ্ব বানিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। আসলে বর্তমানে আন্টিরুশ সেন্টিমেন্ট পশ্চিমে ভালো বিক্রি হয়, এটাই তাদের এক করে। কিন্তু এর বাজার দর কত সেটা বোঝা যাবে যখন গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে। মুখে রুশ বিরোধী কথা বলা আর তার জন্য নিজের আরাম আয়েশ ত্যাগ করা এক কথা নয়। এক কথায় যদি ইউরোপ তথা পুঁজিবাদী বিশ্ব লাভ লোকসানের হিসাবে ভুল করে তাহলে বিশ্ব ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হবে আর করোনার পরে তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। 

বিগত অনেক বছর যাবত অবাধে নিজের মত অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া আমেরিকা চেষ্টা করবে যেভাবেই হোক নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে, দেবে মরণ কামড়। সেই কামড় কার মৃত্যু ডেকে আনবে সেটাই দেখার বিষয়। এক সময় বাংলাদেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে রাজ কনডম বলে একটা বিষয় ছিল। রাজা বাইডেন এখন সেই রাজার রূপ নেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়। সেটা অবশ্য মন্দের ভালো, কারণ তাতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে মানব সভ্যতা ধ্বংসের মুখামুখি হবে না। 

দুবনা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ 
 

 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা