মে ডে

আজ পয়ালা মে, মে ডে। অনেক আগে, যখন ছোট ছিলাম, কী উত্তেজনা নিয়েই না অপেক্ষা করতাম এই দিনটির জন্য। তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাব করি। তরা প্রগতি সংঘ। তখন বিভিন্ন সময়ে দেয়াল পত্রিকা আর ম্যাগাজিন বের হত। তখনই মে ডে উপলক্ষে প্রথম ছড়া লেখা আমার – এখন চল্লিশ বছরের বেশী পরে প্রথম লাইনটা শুধু মনে আছে –
আঠারো শ’ ছিয়াশিতে
শিকাগোর রাজপথে
নেমেছিল হাজারো শ্রমিক

তবে ঐ সময় মে ডে ছিল নেহাতই এক উৎসব। এর পর কলেজে উঠে ছাত্র ইউনিয়ন করা শুরু করলাম, তারপর খেলাঘর, উদীচী। এমন কি সিপিবি’র সাথেও যোগাযোগ গড়ে উঠলো। মনে পড়ে, যদি কখনো বাড়ির কাজের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম, আমার বাবা, যিনি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে, নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, বলতেন “তুমি না বাম রাজনীতি কর, সমাজতন্ত্রের কথা বল।“ হ্যা, কথাটা ভীষণ সত্য। শ্রমিকদের কথা বললেও তখন বাড়ির কাজের লোকদের কথা মনে আসতো না। তারা ছিল নেহাত বদু ভাই, শুটু ভাই, মদন মামা, পচা কাকা। আর শ্রমিকরা ছিল অনেক দূরে, আমেরিকার শিকাগোর রাস্তার সাদা মানুষগুলো।

এরপর ১৯৮৩ সালে চলে আসি স্বপ্নের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে। ঐ সময় এ দেশে ঘটা করে পালিত হতো পয়লা মে, নাম ছিল “আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস।“ ঐ সময় ৯ মে বিজয় দিবসের থেকেও অনেক বড় করে এই দিনটি পালিত হতো এ দেশে। এ উপলক্ষ্যে পয়লা আর দোসরা মে ছুটি থাকতো। সকালে উঠে চলে যেতাম পার্ক কুলতুরীর প্রগতি প্রকাশনের সামনে। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে বেলুন আর লাল পতাকা হাতে এঙ্গেলসের স্ট্যাচুর পাশ দিয়ে লেনিন লাইব্রেরীকে হাতের ডাইনে রেখে ঢুকতাম রেড স্কয়ারে। লেনিন মুসলিয়ামে দাঁড়ানো সিপিএসিউ নেতাদের হাত নাড়াতে নাড়াতে চলে যেতাম হোটেল রাশিয়ার ওখানে মস্কো নদীর বিপরীতে।    

গ্রীষ্মের ছুটিতে ১৯৮৭ আর ১৯৮৯ সালে দেশে ফিরে আজাহার ভাইয়ের সাথে কত যে সভায় গেছি কৃষক, শ্রমিক আর ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের। শুধু দিনেই নয়, রাতও কাটিয়েছি সেই সব মানুষের সাথে। কিন্তু আমি কখনো তাদের মধ্যে সেই সর্বহারাকে দেখতে পাইনি যার শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু ছিল না। সব সময়ই মনে হয়েছে, কোথাও একটা কাজ পেলেই, কোন রকমে জীবন চলার একটা ব্যবস্থা হলে সে অনায়াসে অন্য দলে চলে যেতে পারে। আসলে এখন আর সেই সামন্ত সমাজ নেই – যখন মালিকরা দাসদের বিক্রী করত, আর স্পারতাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহ হতো। আজ আমরা সবাই নিজের নিজের মালিক। আজ আর আমাদের মালিকরা আমাদের বিক্রী করে না, আমরা নিজেরাই আমাদের বিক্রী করি। হ্যা, আমাদের নিজেদের বিক্রী করার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু আমাদের অধিকাংশ মানুষেরই নিজেদের বিক্রী না করার স্বাধীনতা নেই। আর এর একটাই কারন, আমরা সবাই আমাদের সীমাহীন চাহিদার দাস।

আজও আমরা অনেকেই মিটিং মিছিলে যাবো, চায়ে চিনি কম হলে কাজের মেয়েকে বকবো, মিটিঙে পৌঁছুতে দেরী হলে ড্রাইভারের উপর এক হাত নেবো। এ এক অদ্ভুত জগত, আমরা জনতার কথা বলি, অথচ নিজেকে জনতার একজন বলে মনে করি না, আমরা শ্রমিকের স্বার্থের কথা বলি, অথচ আমাদের নিজেদের স্বার্থ শ্রমিকের স্বার্থের ঠিক বিপরীতে অবস্থান করে। এক সময় আমরা যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম (এখনও করি), নিজেদের সমাজতন্ত্রের সৈনিক ভাবতাম, আজ আমরা সবাই কমবেশি প্রতিষ্ঠিত, সবারই শৃঙ্খল ছাড়াও অনেক কিছুই হারানোর আছে। তারপরেও আমরা মে ডে পালন করি, বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাই। মুখোশটাতো আর ইশ্বরদত্ত নয়, অনেক কষ্ট করে, অনেক পয়সা খরচ করে তৈরি করতে হয়। ফেলতে কষ্ট লাগে। এখন রাশিয়ায় এই দিনটির নাম “বসন্ত ও শ্রম দিবস”।  সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা আর সুন্দর পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়ে


মস্কো, ০১ মে ২০১৭ 



Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি