বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা

জাগো বিস্তীর্ণ জনভুমি ওঠো মরণ যুদ্ধে
ফ্যাসীবাদের অভিশপ্ত কালো শক্তির বিরুদ্ধে
মহান ক্রোধ ফুঁসে উঠুক তরঙ্গের মত
চলছে জনতার যুদ্ধ, যুদ্ধ পবিত্র

https://www.youtube.com/watch?time_continue=2&v=tzKkAnpZDko

এ গানটা প্রথম শুনি সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে। তখনও শব্দগুলো ঠিক বুঝতাম না, তবে এর সুর আর শৌর্য তখনই মন কেড়ে নেয়। পরে শুনেছি মহান পিতৃভূমির যুদ্ধে এ গানই ছিল বিজয়ের মন্ত্র, এই গান গেয়ে মানুষ যুদ্ধ করেছে, ফ্যাসীবাদের কালো শক্তিকে পরাজিত করেছে।

সোভিয়েত জীবনে মে মাসের সবচেয়ে বড় উৎসব ছিল মে দিবস। ঐ সময় বিজয় দিবস এত ঘটা করে পালন করা হতো না, মূল প্যারেড হতো ৭ নভেম্বর মহান অক্টোবর বিপ্লব দিবসে। আর বিজয় দিবসে মস্কোসহ সারাদেশে আয়োজন করা হতো ছোট বড় মঞ্চের, যেখানে জড় হতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরা। আমরা সাধারণত যেতাম পার্ক কুলতুরি, চেয়ে চেয়ে দেখতাম বুকভরা মেডাল পড়ে ঘুরে বেড়ানো সৈনিকদের। ছবি তুলতাম, কথা বলতাম। সবাই তাদের ধন্যবাদ জানাতো মাথার উপর শান্তিপূর্ণ আকাশ এনে দেবার জন্য। তখনও অনেক বয়স্ক সৈনিক দেখা গেলেও মুলত থাকতো পঞ্চাশের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করা সৈনিকরা। যতদুর মনে পড়ে বিজয় দিবস পালন বর্তমান রূপ নেয় ১৯৯৫ সালে যখন সারাবিশ্ব বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পালন করে। তখনই “পাক্লোননায়া গারায়” শেষ হয় যুদ্ধের উপর এক বিশাল কমপ্লেক্সের কাজ। মনে পড়ে, ১৯৮৩ সালে যখন মস্কো আসি, এক রাতে আমাদের শহর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে। ঐ দিন আমাদের পাক্লোননায়া গারায় এনে বলেছিল আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিউজিয়ামসহ  অনেক কিছুই গড়া হবে, আর তারপর থেকে এখানেই হবে বিজয় দিবসের মুল অনুষ্ঠান। এরপর দেশে দেখা দিল অর্থনৈতিক ক্রাইসিস, দেশ ভাঙলো। শেষ পর্যন্ত নতুন রাশিয়ায় গড়া হোল এই মেমোরিয়াল। ১৯৯৫ সালে, মনিকার যখন এক বছরও হয়নি, আমরা গেলাম পাক্লোননায়া গারায়। সাথে ছিল রেজা। এরপর সবাই মিলে চলে যাই দুবনায়, বিজয় দিবসে যেতাম বাচ্চাদের নিয়ে ব্রাতস্কায়া মগিলায়। এখনও এই দিনে দুবনা থাকলে আমি ওখানেই যাই।

এখন রাশিয়ায় বিজয় দিবসের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় রেড স্কয়ারে। আর্মি প্যারেড থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হয়। তবে গত কয়েক বছর যে জিনিষটা আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে, সেটা “মৃত্যুহীন ব্রিগেড”। এখানে বর্তমান প্রজন্মের লোকেরা যুদ্ধের সময় নিহত তাদের আত্মীয়স্বজনের ছবি নিয়ে মার্চ করে চলে যায়। বর্তমান আঙ্গিকে মৃত্যুহীন ব্রিগেডের জন্ম ২০১১ সালে টোমস্কে। এর আগে ২০০৪ -২০০৬ এ ধরনের মার্চ হয়েছে কুজবাসে আর ২০০৭ সালে তুমেনে। এখন অবশ্য ২০০৭ সালকেই এই মুভমেন্টের শুরু বলে ধরা হয়। তাই এবার মৃত্যুহীন ব্রিগেড দশ বছর জুবিলী পালন করছে। গতবছর আমরা অনেকেই গেছিলাম মস্কোর মৃত্যুহীন ব্রিগেডের মার্চে যোগ দিতে। আবহাওয়ার কারনে এবার আর হয়ে ওঠেনি। এখন শুধু রাশিয়াতেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই মার্চ হয়, তবে বিদেশে মুলত এতে অংশ নেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক নাগরিকরা।  এটা আবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধের ভয়াবহতা আর ফ্যাসীবাদ রোধ করতে সোভিয়েত জনগনের আত্মত্যাগের কথা। ফ্যাসিবাদ রুখতে শুধু যে সোভিয়েত জনগণই প্রান দিয়েছে তাতো নয়। তাই একদিন অন্যান্য দেশের ফ্যাসীবাদ বিরোধী সৈনিকদের পরবর্তী প্রজন্ম এই মার্চে অংশ নেবে, ফ্যাসীবাদকে প্রতিহত করবে সে আশাই রাখি। কারন আমাদের ভিন্ন কোন পথ নেই।

শান্তির সময়ে আমরা মৃত্যুর কথা ভাবি না, যদিও মরণ জীবন নামক রেলগাড়ির সর্বশেষ স্টেশন। যুদ্ধের সময় আমরা মরনের অপেক্ষা করি প্রতি পদে পদে, আর এই মৃত্যু উপত্যকায় জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে পথ চলি। তাইতো যারা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন থেকে মৃত্যুকে ক্ষনিকের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে রাখে, তাদের স্মরন করি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আর অভিনন্দন জানাই নিজেদের এই মৃত্যুর রাজ্যে বেঁচে থাকার জন্য। অভিনন্দন জানাই বিজয়ের। কান্না, ঘাম আর রক্তে ভেজা বিজয়, অশ্রু ভরা চোখে এক চিলতে স্বস্তির হাসি এ বিজয়।   

সবাইকে বিজয় দিবসের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।  


মস্কো, ০৯ মে ২০১৭ 



Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি